রিজওয়ান, মঞ্চে প্রতিধ্বনিত বিপ্লবের ডাক

শিমুল সালাহ্উদ্দিনশিমুল সালাহ্উদ্দিন
Published : 15 Sept 2017, 07:42 AM
Updated : 15 Sept 2017, 07:42 AM


আলোকচিত্র:গনি আদম

জাতশিল্পীর জন্য এই মৃতের নগরী প্রস্তুত না। প্রস্তুত না এমনকী এর শিল্পীসমাজও। সৈয়দ জামিল আহমেদের জন্য আমার তাই দুঃখ হয়। এক মৃত, প্রতিবাদহীন, ভালোবাসতে পারার সামর্থ্যহীন সমাজকে তিনি শুনিয়েছেন জীবনের, প্রতিবাদ করার, ভালোবাসতে পারার গল্প, বহুমাত্রিক পূর্ণ এক থিয়েটার মাধ্যম ব্যবহার করে। আফসোস, এই দেশের থিয়েটারের রথিমহারথিরাও থিয়েটার বলতে কেবলই 'মেথড অ্যাকটিং' বোঝেন।

ঢাকার মঞ্চ এমন ঘটনা কখনো দেখেনি আগে। প্রায় দুই যুগ পর শ্রেণিকক্ষের বাইরে নাট্যনির্দেশনা দিলেন দেশের বরেণ্য নাট্যজন সৈয়দ জামিল আহমেদ। আমেরিকা প্রবাসী কাশ্মিরী বংশোদ্ভুত কবি আগা শাহিদ আলীর `দ্যা কান্ট্রি ইউদাউট আ পোস্ট অফিস' অবলম্বনে এ নাটকের নাম রিজওয়ান। নাট্যকার অভিষেক মজুমদার, কাব্যনাটকটির ভাষান্তর করেছিলেন ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে নাটবাংলার এ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে, উদ্বোধনী দিন ছাড়া, প্রতিদিন, দুটি করে মঞ্চায়ন হয়েছে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ, ১০ দিনে ঊনিশটি মঞ্চায়ন।

মঞ্চায়নের সংখ্যা শুনে আপনার মনে হতে পারে, তাহলে তো সহজ এক নাটক হবার কথা, বায়ে হাতকা খেলের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা করে ফেলেন এ নাটক। নাটকটি দেখার অভিজ্ঞতা না থাকলে, আপনি বুঝবেনই না কত বড় এক ঘটনা রিজওয়ান। শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্যের কতটা চূড়ায় অবস্থান করে এই নাটকের দলটি, তাদের দশদিনের এ 'নতুনের অভিযান'সম এক দুর্লঙ্খ অভিযাত্রা শেষ করেছে। অসামান্য টিমওয়ার্কের জন্য যেকোন দর্শকের স্যালুট পাবে রিজওয়ানের প্রযোজক নাট্যদল, নাটবাংলা।


আলোকচিত্র:লীনা পরভীন
বিপর্যস্ত এক গোলাপ বাগানের গল্প রিজওয়ান। স্বর্গ আর নরকের মাঝে দাঁড়িয়ে দেশহীন মানুষের হৃদয়ে গহীন ক্ষত উঠে এসেছে দুই ভাইবোন ফাতিমা ও রিজওয়ানের বয়ানে- যা কেবল ভৌগোলিক সীমায় না থেকে, হয়ে উঠেছে সার্বজনীন।

পরাধীন মানুষের গল্পে, এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাঙালির বিযুক্তি অনুভব করার কোন কারণ নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বা পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালির সাথে পাকিস্তানীদের আচরণের, ঘটে যাওয়া হাজারো ঘটনার সাথে মিল পাবেন আপনি এ নাটকের দৃশ্যে দৃশ্যে, বয়ানের সাজেশনে সাজেশনে।

একটু ভাবলেই দর্শক এ নাটকের বক্তব্যকে সম্পর্কিত করতে পারবেন, আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিপীড়িতের সংগ্রামের সাথে। ধর্মান্ধতার কবলে ছিন্নভিন্ন কোন এক ভূখণ্ড, কাশ্মীর, পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ বলে প্রখ্যাত সেই ভারতপীড়িত দেশের বিপর্যস্ত মানবতার কথা উঠে এসেছে সৈয়দ জামিল আহমেদের এ নাটকে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, অধিবাস্তব এক সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে চরিত্র ও ঘটনার ত্রিমাত্রিক প্রতিকী সংযোগ 'রিজওয়ান' এর নাট্যভাষা। অস্থির আশঙ্কাজনক ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী সকল জাতিগোষ্ঠির প্রতি প্রকৃত মানবিক আত্মত্যাগের সাংস্কৃতিক আহ্বান রিজওয়ান।


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
'রিজওয়ান' নামের প্রাণচঞ্চল এক তরুণ এর কেন্দ্রিয় চরিত্র। সে হাওয়ায় গাড়ি চালাতে পারে,পানিতে নৌকা আর মাটিতেও পারে চালাতে গাড়ি কেননা তার মায়ের কথামতে সে এসেছে হাওয়া, মাটি আর পানি থেকে যেখানে অন্যরা কেবল এর একটি থেকে আসে।
কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে কাহিনীর আবর্তন। সেখানকার পাহাড়ঘেরা এক এলাকায় ঝিলের ধারে বসবাস রিজওয়ানদের। জন্ম জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে রিজওয়ানদের আসা যাওয়া আছে সেখানে যুগের পর যুগ কিন্তু পাহাড় আর ঝিল সেখানে চিরকালীন। রিজওয়ানের জনগোষ্টির প্রাণ তাদের দেহ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে তা প্রবেশ করেছে সেই ঝিলে সেই পাহাড়ে। আর সেই স্থানান্তরিত প্রাণ মৃত্যুহীন চিরকালিন। তাই ঝিল পাহাড়ের অধিকার তারা ছেড়ে দেবে না কিছুতেই। সেনা আগ্রাসন হয়,হয় খুন ধর্ষণ। নাটকে অসাধারণ ব্যঙ্গতায় চিত্রিত হয় ধর্ষণ নামে হিম ঠান্ডা এক 'প্রাকৃতিক মৃত্যু'। সেটি ফাতিমার, রিজওয়ানের বোনের। পৃথিবীর মানুষের প্রাকৃতিক মৃত্যুর অধিকারের এক অধিবাস্তব চিত্রকল্প।
রিজওয়ানকেও হত্যা করা হয়। তার আগে রিজওয়ানকে অভিযুক্ত করা হয় তার প্রিয়জনদের হত্যা এবং মৃতদেহগুলি বাড়িতে লুকিয়ে রাখার অভিযোগে।


আলোকচিত্র:লীনা পারভীন
জীবন -মৃত্যুর দুই পর্বের মানব জনম নিয়ে গভীর এক বার্তা আছে এই নাটকে। মৃত্যুর পরের জীবনকে অভিহিত করা হয়েছে অনুভূতিহীন হিসেবে। আর প্রচলিত ধারণা ও অভিজ্ঞানকে আঘাত করে আরো বলা হয়েছে মৃত্যু যন্ত্রণার কোন বিষয় নয়। মৃত্যুচিন্তা যারা করেন যারা মৃত্যুকে এক অভেদ্য অপার রহস্যের বিষয় বলে নিয়ত ভাবতে চান তাদের জন্য এই নাটকে রয়েছে আলাদা এক মাত্রা।

রিজওয়ান নাটকের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ফাতিমার সংলাপ, জান্নাত যদি কোথাও থেকে থাকে তা এ মাটিতে, অসাম্প্রদায়িক এ ডাকই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক বলে মনে করি নাটবাংলার মতো আমিও।

আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
পরীক্ষণ থিয়েটার হলের প্রায় প্রতিটি কোণ ব্যবহার করেছেন নাটকের পরিকল্পক ও নির্দেশক সৈয়দ জামিল আহমেদ। দুর্দান্ত মঞ্চ, আলোক পরিকল্পনার সাথে অভিনব থিয়েটার ডিজাইনে এ নাটক দর্শকদের সামনে তুলে ধরে নটনটিদের শরিরীসামর্থের প্রায় চূড়ান্তরূপ। ফাতিমা চরিত্রে অভিনয় করা মহসিনা আক্তার শেষ মঞ্চায়নের পর বলছিলেন, 'আমরা টানা দুই মাস মহড়া করেছি, তার আগে ক্যাম্প করেছি এই নাটকের জন্য মৌচাক গিয়ে। প্রতিদিন এতো চাপ চাপ চাপ, স্যার একটা সেকেন্ড ছাড়েন নাই, আমরা ইয়াং বয়সে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, কিন্তু স্যার আছেন, আমাদের সাথে মৌচাকে যেখানে ক্যাম্প করেছি সেখানে স্যার আমাদের মতোই থেকেছেন, প্রচণ্ড পরিশ্রমের একটা প্রোডাকশন করেছি আমরা, কিন্তু আনন্দ খুঁজে পেয়েছি বা স্যার আনন্দ তৈরি করতে পেরেছেন বলে এটা আমরা সম্ভব করতে পেরেছি, আমি নিজে দুবার পা মচকেছি, কিন্তু দেখেন টানা ঊনিশটা শো কিন্তু করলাম''।

দারুণ কোরিওগ্রাফিতে ও পোষাক নির্বাচনে প্রযোজনাটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন নায়লা আজাদ নূপুর। আলোক প্রক্ষেপণেও দেখা গেছে জামিল আহমেদের জাদু। ননলিনিয়ার, সুরিয়ালিস্টিক, মেটাফর্মিক, ৩৬০ ডিগ্রী মঞ্চের ব্যবহার, ইফেক্ট লাইট আর ব্যকগ্রাউন্ড সাউন্ডের অসাধারণ ব্যবহার, সব মিলিয়ে এক অসাধারন আধুনিক থিয়েটার পারফর্মেন্স হয়েছে রিজওয়ান— আমার কাছে যা এক শিল্পোত্তীর্ণ প্রযোজনা।


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন

তবে এ প্রযোজনা স্বার্থক হবার জমিন সৈয়দ জামিল আহমেদ তৈরি করেছেন তার একজীবনের চর্চায়। ঢাকার মঞ্চনাটকের গত একদশকের দর্শকদের ভুলে যাবার কোন কারণ নেই তার শিক্ষার্থী সুদীপ চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক থিয়েটারপ্রচেষ্টাগুলো। আমার মনে হয়, সে কাজগুলো এই প্রযোজনার রসগ্রহণে প্রস্তুত করেছে দর্শকদের। সেসব ছাড়াও বলতে হবে প্রাচ্যনাট, নাগরিক, ঢাকা থিয়েটার বা থিয়েটারের নাট্যপ্রচেষ্টার কথাও।

সৈয়দ জামিল আহমেদের কাজে-চিন্তায় আছে নতুনের সন্ধান। এ নাটকের মাধ্যমে তিনি নাটকের মূল ধারায় দীর্ঘদিন পরে নির্দেশনা দিচ্ছেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ নাটকের মূল চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ অনেকেই জামিল স্যারের সরাসরি শিক্ষার্থী। ফলে তাদের দিয়ে প্রায় গেরিলা আর্মি কায়দায় এ প্রযোজনাটি করানো সম্ভব হয়েছে। শুনে অবাক হবেন, এ প্রযোজনায় কাজ করতে অনেকেই তার নিশ্চিত চাকরিটি ছেড়ে এসেছেন, অনেকে এসেছেন বিদেশের স্বপ্নের পড়াশুনা ছেড়ে, অনেকে সংসার আর স্বাভাবিক ছন্দের জীবনের আরাম ও নিশ্চয়তা ছেড়ে। গ্রুপ থিয়েটারভুক্ত কোনো দল এভাবে কাজ করতে পারে না, সম্ভবও নয়। সৈয়দ জামিল আহমেদ দেখালেন, যে থিয়েটার করতে হলে এভাবেই করতে হবে, সব ছেড়েছুড়ে, একেবারেই যাবে না লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া।
চলতি বিশ্বের সংঘাতময় রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন শৈল্পিকভাবে তিনি তুলে ধরেছেন এখানে, না দেখলে এবং উপলব্ধি না করলে সেটি বলে বোঝানো কঠিন। রাজনীতির আদিম নিয়ামক যে পেশিশক্তি এবং ভূমি, তাকে তিনি দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন শাসক আর শোষক— এই দুই বর্গকে কেন্দ্রস্থলে রেখে। এর মাধ্যমে একদিকে পরিস্ফুট হয়েছে সমকালীন বিশ্ব রাজনীতি, অন্যদিকে নির্দেশকের রাজনৈতিক ও নান্দনিক অভিজ্ঞান। যে অভিজ্ঞান আদতে এক বিপ্লবের ডাক, আমরা তা বুঝতে পারি না বলে, নির্দয় পাথুরে দেয়াল মানবপাহাড়ে তা প্রতিধ্বনিত।

মঞ্চ


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
৩৬০ ডিগ্রী, প্রায় মাছির চোখ লাগবে দর্শকের এ নাটক দেখতে। পরীক্ষণ থিয়েটার হলের সকল সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন নির্দেশক। তবে বিশালায়তনের, বহুমাত্রিক এ মঞ্চ সামলাতে নটনটিদের প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে, প্রথম কয়েকটি মঞ্চায়নে পরিশ্রমের ছাপ সংলাপ প্রক্ষেপণে থাকলেও পরের মঞ্চায়নগুলিতে তা কেটে গেছে। কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতির নান্দনিক বিন্যাসে মঞ্চ সাজানো। সেই ঝিলম নদী, নদীর বোট, জনপদ ও সুউচ্চ পাহাড় নাট্যবিষয়ী জীবনের অঙ্গাঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ তো সেখানকার সুউচ্চ পর্বতকে মেঘ হয়ে উড়ে যাবার কল্পনাই করেছেন। বাংলাদেশে অন্য কোনো নির্দেশক এ বিষয়কেন্দ্রিক নাটক নির্দেশনা দিলে হয়ত মঞ্চে সে জনপদকে ডিজিটাল ছবি/সাজেশন কিংবা নানাভাবে আনতে তৎপর হতেন। সৈয়দ জামিল আহমদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পুরোমঞ্চটাই কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতি ও জীবনযাত্রার আদলে বিন্যস্ত করেছেন। এমনকি স্বর্গ-মর্ত্যও। এক্ষেত্রে তার অনবদ্য সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

প্রতীকের ব্যবহার

কাব্যনাট্যের মঞ্চায়ন। ফলে, নির্দেশক কবির ব্যবহৃত প্রতীকগুলোর স্বার্থক দৃশ্যরূপ করেছেন মঞ্চায়নে। জান্নাত, কাশ্মিরী কিশতিতে চিঠি আসা, আলোর ব্যবহারে দর্শকের মনোযোগ সীমিত করে তোলা কোন এক দৃশ্যবিন্দুতে, আকাশ থেকে নেমে আসা নৌকার সাজেশন সবই প্রচণ্ড স্বার্থকভাবে করতে পেরেছেন নির্দেশক।

বিষয় নির্বাচন


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
এখানেই সবচেয়ে বড় সাধুবাদটা পাবেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। শিল্পী যে কাউকে কোন কিছুকে পরোয়া করে না তার সৃজনপ্রক্রিয়ায়, তার সাহসটা তিনি দেখিয়েছেন রিজওয়ান নির্বাচন করে। আগা শাহীদ আলীর এ কবিতা প্রবাসে নিরাপদ মাটিতে বসে লেখা হলেও, তাতে আছে নির্যাতিতের স্ফূলিঙ্গ। নির্যাতন নিপীড়নের শিকার কী নির্দেশকও হন নাই, অবমূল্যায়নের চেয়ে বড় নির্যাতন আর কী আছে! রিজওয়ান তাই ভেতরে ভেতরে ফুঁসে থাকা এক মঞ্চশিল্পীর গভীর আর্তনাদ, প্রতিবাদ, বিপ্লবের ডাক।

উপযোগিতা


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
মঞ্চ নাটক করা হয় দর্শকের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত করার জন্য। জাগ্রত করার কাজটির আগের কাজ মঞ্চে আসতে বাধ্য করা। ঊনিশদিন ধরে এতগুলো শো হাউসফুল হয়েছে, এর মানেই এ নাটকের উপযোগিতা ছিলো। এবং হাজারো মুগ্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়াও বলছে, এর উপযোগ তাদের তৃপ্ত করেছে। ঢাকার মঞ্চে রিজওয়ান একটা বিস্ময়কর ঘটনা বহু কারণে। ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন কাশ্মীরে জোর যুদ্ধ করে, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে দি কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস নিয়ে রক্তপাত হয়, তখন ঢাকা শহরে রিজওয়ানের মতো তীব্র রাজনৈতিক নাটক হতে পারে, এবং ভারত সমর্থিত এই সরকারের কোন ভ্রুকুটি কিংবা জুজুর ভয়কে জামিল আহমেদ পাত্তা দেন না, আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালি যে শিরদাঁড়া সোজা করে রাখে, জামিল আহমেদ আমাদের সেই মোকাম।

আলো, পোশাক, উপস্থাপন কৌশল


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
'রিজওয়ান'কে একধরনের পরিবেশনা বা পারফরমেন্স বলাটাই বোধ হয় বেশি যৌক্তিক। ইউরোপীয় দেশগুলোর থিয়েটারে নানা ধরনের নানা বৈচিত্রসমৃদ্ধ পোস্ট মডার্ন এপ্রোচ দেখা যায়। (ইউটিউবের কল্যানে সেসব আর দুর্লভ নয়) বিভিন্ন মাধ্যম বিশেষত ইলাস্ট্রেশন আর্ট, অ্যাক্রোবেটিকস বা শারীরিক কসরত, মুভমেন্ট, ড্যান্স, মিউজিক, অভিনয়, বিষয়বস্তু সবকিছু মিলিয়ে দৃশ্যকল্প তৈরি করার কৌশলে এসময়ের পরিবেশনার প্রয়াস খুবই প্রচলিত। এ নাটকে দেশীয় নাট্যের বর্ণনাকৌশলে ছোট ছোট দৃশ্য ইমেজের মাধ্যম্যে মেটাফোরিক্যাল জীবন বাস্তবতার অমানবিক রূপ তুলে ধরা হয়েছে। নাটকে ছিলো নানা ম্যাজিকাল মোমেন্ট। মৃত আত্মা রিজওয়ানের সঙ্গে ফাতেমার দেখা হবার দৃশ্যটা এতই স্পর্শকাতর যে আমাদের আত্মা কেঁদে ওঠে 'বাবাকে বলো না আমি মারা গেছি।'

রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন, রক্তকরবী ও চিত্রাঙ্গদা; সেলিম আল দীনের কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল; মমতাজউদ্দীন আহমদের 'সাত ঘাটের কানাকড়ি; এস এম সোলাইমানের 'এই দেশে এই বেশে'; শেক্সপিয়রের 'দি টেম্পেস্ট; বের্টোল্ড ব্রেখট-এর ' দি রাইজ এন্ড ফল অব দ্য সিটি অব মহাগনি' এবং 'দ্য মেজারস্ টেকেন; কলকাতায় ইউরিপিদিসের 'ইফিজিনিয়া ইন টরিস' এবং 'গুড উইমেন অব সিজুয়াল'; সেলিম আল দীনের চাকা নাটকের ইংরেজি ও হিন্দি অনুবাদ 'The Wheel' ও 'পাহিয়ে'; পালাগানের আঙ্গিকে 'কমলা রানীর সাগর দীঘি', পদ্মাপুরানের রুপান্তর 'বেহুলার ভাসান';সংযাত্রার আঙ্গিকে 'সং ভং চং','শ্যামার উড়াল' বা 'বিষাদসিন্ধু'-র পর রিজওয়ান, এ নাটক নিশ্চিতভাবেই বদলে দেবে আমাদের নাট্যকর্মীদের চিন্তাপ্রক্রিয়া।


আলোকচিত্র:লতিফ হোসেইন
একাডেমিকভাবে থিয়েটার বলতে সাধারণত নাট্যশালা, ঘটনাস্থল, নটভবন, নাটমন্দির, অভিনয়মঞ্চ, অভিনয়গৃহ, রঙ্গমঞ্চ, রঙ্গালয়, রঙ্গশালা, কর্মক্ষেত্র–এসব বোঝায়। আমার কাছে থিয়েটার হলো সেই প্রত্যয় যেখানে অভিনয়শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে একটি যোগাযোগ সংঘটিত হয়। আক্ষরিকভাবে এক শব্দে প্রকাশ্য হলেও দুটি ধারণা। 'রিজওয়ান' আমার দেখা সেরা নাটক নয় কিন্তু সেরা থিয়েটার। এর থেকেও ভাল কাহিনির নাটক বাংলাদেশে হয়েছে, কিন্তু থিয়েটার হয় না। বাংলাদেশের থিয়েটার বা মঞ্চে যা হয় তা হলো, কিছু গল্প বলা হয়। কিন্তু কিভাবে সেটা বলা হবে এটা নাট্যকারের বিষয় বা দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। কিন্তু ভাল নির্দেশনার কারণে সেই নাটকগুলো প্রকৃতপক্ষে থিয়েটার হয়ে ওঠে না। 'রিজওয়ান' অসাধারণ কোনো গল্প নয়। কিন্তু অসাধারণ থিয়েটার।

শুরুতেই যখন নিকষ নিরবতার মধ্যে দর্শক আসন গ্রহণ করেন, দেখতে পান মাথার ওপর হাঁটছে সৈন্যদল, শুনতে পান নিজের হৃদস্পন্দন, তখনি আন্দাজ করতে পারেন অন্য একটি জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তিনি (দর্শক)। অসাধারণ এই পরিস্থিতির নির্মাণ। 'বিচ্ছিন্নতার বোধ' তৈরি করা হয় মঞ্চের নানা অংশে অভিনয়শিল্পীদের শরীরভঙ্গির চলন ও খলবলানো দিয়ে। তারপরই শুরু হয়, চোখের ওপরে, শূন্যে ভাসমান ফাতিমার সংলাপে রিজওয়ান— আজ রাতে এক ঝড় এসেছে…

প্রথমদিকে ধোঁয়াশাপূর্ণ, কাব্যের অন্ধকার অংশের মতো এই নাটকের কাহিনী বোঝা না যেতে থাকলেও মর্মস্পর্শী অভিনয় যখন সামনে, উপরে, নিচে, ডানে, বামে, পেছনে হতে থাকে তখন দর্শককে একটি বিশেষ শারিরীক ও মানসিক কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে নিয়ে যান সৈয়দ জামিল আহমেদ। দর্শক মুখে হাত দিয়ে একদিকে তাকিয়ে থাকলেই হচ্ছে না। তাকেও কাজ করে যেতে হচ্ছে। শুধু বাইরে নয় ভিতরেও। ফলে তিনি নিজেও আসলে একজন অভিনেতায় পরিণত হচ্ছেন। এই ঘটনা 'রিজওয়ান' ঘটাতে পেরেছে।

মঞ্চে কিছু খণ্ড খণ্ড ইমেজ, ইলিউশন সৃষ্টি করেছেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। অঙ্ক বিভাজনের উত্থন-পতন বা ট্যাজিক চরিত্রগুলোর কোনো দ্বন্দ নেই। আলো-ছাঁয়ার যে ঝিল বানানো হয়েছে সেটা কেবল ঝিল নয়, মানুষের কল্পিত স্বর্গের সোপান বা পুলসিরাত। সব মিলে আস্ত একটা চিত্রপট। অথবা একগাদা চিত্রপট।

ফাতিমা এই অসংখ্য ইমেজকে কথক হিসেবে উপস্থিত হয়ে এটি পূর্নাঙ্গ ছবি করতে চেয়েছে বা জোড়া দিতে চেয়েছে পাবলো পিকাসোর গুয়ের্নিকার মতো। ফলে রিজওয়ানের জন্ম বেড়ে ওঠা, রিজওয়ান ও তার বোন ফাতিমার স্মৃতি-স্বপ্ন, বিয়োগ-বিচ্ছেদ হয়ে উঠেছে অশান্ত-রক্তাক্ত-যুদ্ধ বিদ্ধ মানুষের গল্প।

অভিনয়শিল্পীরা বিভিন্ন দলের হলেও রেপটারি গ্রুপ 'নাটবাঙলা'র নাট্যকর্মীতে পরিণত হয়েছেন বলেই, সবাই 'রিজওয়ানে'র বডি হতে পেরেছেন। রিজওয়ান ও ফাতিমা নাটকের প্রধান চরিত্র। এই নাটকে তাদের চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তিতাস জিয়া ও মহসিনা আক্তার তারা অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তবে দশদিন ধরে দুটি করে শো তাদের শারিরীক ও মানসিক সক্ষমতার যে পরিচয় দিয়েছেন তা অনন্য।

যুদ্ধ ও শান্তির প্রচলিত ধারণাকে এক প্রচন্ড ঝাঁকি দিয়ে চিৎকার করে বলা হল –যুদ্ধের পর ধ্বংসাবশেষের নির্জনতাকে শান্তি নাম দেয়া হয়। খুন,সন্ত্রাস,ধর্ষণ, যুদ্ধ, দখলদারিত্ব, আগ্রাসনে পর্যুদস্ত মানবিকতার আর্তনাদ আর হাহাকার দেশ কাল আর স্থানের সীমানা ছাড়িয়ে কাশ্মীরের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের পাহাড়ে চাকমা ভাষায় উচ্চারিত সংলাপে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বময় প্রতিধ্বনিত এই আওয়াজ। এই কন্ঠস্বর বিশ্বমানবের।

রিজওয়ান তার দর্শককে দিয়ে গেছে এক ঘোর লাগা জগতের অনুভূতি। যতবার এর মঞ্চায়ন দেখবে কেউ, এই ঘোর আরো ঘনীভূত হবে আমার বিশ্বাস। বার বার বলা হয়েছে – কী হয়? কী হয়? যদি চিরকাল যা আছে তা কোনদিন না থাকে? এ যেন শূন্য থেকে জগতের সৃষ্টি আর শূন্যতেই জগতের মিলিয়ে যাওয়ার ইংগিত।


আলোকচিত্র:গাফফার তপন
সংলাপের প্রেক্ষিত আর উচ্চারণ ভঙ্গি নিশ্চিতভাবে দর্শকের শ্রবনেন্দ্রিয় পার হয়ে গেঁথে যাবে মনের গভীরে, বিশ্বাসের অধিত্যকায়। দর্শক-মন আন্দোলিত আর উজ্জীবিত হবেই সেই পার্থিববোধে।

মৃত্যু আসলে মৃত্যুই। এর আর কোন অর্থ নেই। মানুষ শতাব্দির পর শতাব্দি সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ মিছেই এর নানারকম কাল্পনিক অর্থ তৈরি করেছে। নাটকে বলা হয়- শরীরের যখন মরণ ঘটে তখন মৃত্য হয়, আর যদি বেঁচে থাকি তখন অন্য কিছু হওয়া যায়। এ এমন এক সত্য উচ্চারণ যেখানে 'বেঁচে থাকা' জৈবসত্তার নামই মানুষ। যে 'মানুষ'-এর রয়েছে অপার সম্ভাবনা, অসীম সৃজনশীলতা। আর একারণেই 'প্রাকৃতিক মৃত্যু' এত গুরুত্বপূর্ণ। জগতের সকল মানুষের এই প্রাকৃতিক মৃত্যুর অধিকারের আহবান বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে নাটকে।

চলতি বিশ্বের সংঘাতময় রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন শৈল্পিকভাবে তিনি তুলে ধরেছেন এখানে, না দেখলে এবং উপলব্ধি না করলে সেটি বলে বোঝানো কঠিন।