Published : 02 Jul 2021, 10:42 PM
শোনেন শোনেন সর্বজনা, সহজিয়া বর্ণনা,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো ইতিহাসের ঘটনা।
শুরু থেকে এক শতাব্দী বয়স আপাতত,
যতদিন এই বঙ্গভূমি, বাড়বে বয়স তার তত।
ঊনিশ-একুশ, প্রথম জুলাই, জন্ম হলো যার
শতবর্ষী বিদ্যাতীর্থ, ঢাকার অহঙ্কার।
আয়োজক এক পৃষ্ঠপোষক সলিমুল্লাহ নবাব,
অনন্য এই বিদ্যাতীর্থের দেখেছিলেন খোয়াব।
আপন মালিকানা থেকে ছয়শ একর দান
করেছিলেন জ্ঞানের তীর্থে, রাখতে জ্ঞানের মান।
ষাটজন শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী আট-শ সাতাত্তর –
দিনে দিনে বাড়ছে বিভাগ, ধ্যানের জ্ঞানের ঘর।
বিশ-একুশে শিক্ষার্থীরা এখন হাজার সাঁইত্রিশ,
দু্ই হাজার প্রায় শিক্ষকেরা, দিচ্ছে জ্ঞান-আশীষ।
প্রাচ্যদেশের অক্সফোর্ড আজ বাংলাদেশের সেরা,
শালপিয়াল আর পাখপাখালির বাকবাকুমে ঘেরা।
স্বপ্ন জাতির সফল হবে, জ্ঞানবিজ্ঞানময়
ঢাকার বুকে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়।
কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর চিত্ত সমাবেশ,
জ্ঞানে-ধ্যানে যুগলপ্রদীপ জ্বলছে নির্বিশেষ।
অগ্নিযুগে বহ্নিদীক্ষা সবাই নিয়েছিলো,
ভাষাযুদ্ধে যুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বলিদান দিলো।
শহীদ হলো গাজী হলো রাখতে মায়ের মান,
জ্বলছে তাদের প্রাণের বহ্নি শিখা-অনির্বাণ।
আপন আলোয় আলোকিত মানুষ অবিরত,
পেশায় নেশায় প্রশিক্ষিত সবাই যে যার মতো।
যুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করলো শুরু তারা,
স্বাধীনতার অগ্নিশপথ নিলো সর্বহারা।
দেশবিভাগের পরেই শুরু মাতৃভাষার দাবি,
অর্থনীতি, গণনীতি সাম্যনীতির চাবি।
সবকিছুরই দীক্ষা দিলো বিশ্ববিদ্যালয়,
বাংলার জয়ে কণ্ঠে দিলো, জয় বাঙালির জয়।
কবিদ্রোহীর কণ্ঠ থেকে মুজিব-কন্ঠে আগমনী ,
জাতির পিতার কণ্ঠ থেকে জাতির কণ্ঠে জয়ধ্বনি;
দ্রোহের ধ্বনি জয়ের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে,
এই ধ্বনিই যুদ্ধে যুদ্ধে জনগণের জয় আনে।
জ্ঞানে যেমন শহীদুল্লাহ, স্বাধীন চিত্তে শেখ মুজিব,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবজাতির সদাশিব।
তাদের চরণ-ছাপ ধরেই যায় বাঙালি এগিয়ে,
শ্রমে-প্রেমে মানবসোনা সোনার বাংলার ডাক দিয়ে।
আমরা যারা পেয়েছিলাম ছয় দফা আর গণদাবী
উনসত্তরের আন্দোলনে তাদের হাতেই ছিল চাবি।
এগার সেই দফার লড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে,
সেখান থেকে জাতি এলো এক দফারই এক জয়ে।
এক দফাই স্বাধীনতা, এক দফাই মুক্তি,
এক দফাই সব বাঙালির সর্বজয়ী চুক্তি;
এক দফাই ব্যক্তি থেকে জাতির হাতের পতাকা,
এক দফাই সব বাঙালির সমৃদ্ধিরও ঘূর্ণি চাকা।
কলাভবন রশিদ বিল্ডিং কার্জন হলের বুক জুড়ে
হলে হলে সব ভবনে মুক্তির দূত আসে উড়ে।
বিচ্ছুসেনার বুলেটবোমা ছুঁড়লো যখন গেরিলা,
দখল সেনা হাম্বা রবে পা তুলে সব ভাগিলা।
পঁচিশে মার্চ গণযুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি
আপন খুনে রণাঙ্গনে মায়ের বুকটা রাঙালি।
মারের পরে মার খেয়ে আর পথ পায় না পালাবার,
মারের চোটে দখলসেনা অস্ত্র ছেড়ে মানলো হার।
ঘটলো সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তরে,
সেই বিজয়ই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে ডিসেম্বরে।
ধানের দেশ গানের দেশ প্রাণের দেশ বাংলাদেশ
বীরবাঙালির রণভূমি ষাটদশকের বাংলাদেশ।
ষাটের দশক ষাটের দশক বিংশ শতাব্দীর,
আবহমান বয়স কত বঙ্গজননীর?
পঁয়ষট্টিতে বুক রেখেছি, মাগো, তোমার বুকে,
সন্তানেরে করছো লালন দুগ্ধে সুখে-দুঃখে;
সাতষট্টিতে বয়স আমার ঠিক আঠারো ছিল
কলাভবন চোখে-মুখে স্বপ্ন এঁকে দিলো,
আত্মজয়ের দীক্ষা দিলে প্রথম দেখায় তুমি;
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে বিশ্ব শিক্ষাভূমি!
ঢাকা কলেজ থেকে এলাম ইংরেজি বিভাগে,
মুরশিদস্যারের কিং-লিয়ারের ক্লাশে গেলাম আগে;
তারপরেই বাংলা ভাষা, অর্থনীতির পাঠ;
মুনীরস্যারের ক্লাশ তো তখন জমজমাট এক হাট।
'জ্ঞান আসে আর প্রজ্ঞা থাকে, টেনিসনের বাণী'
শিরিন ম্যাডাম পড়ালেন যা, এখনো তা মানি।
সিরাজস্যারের প্রথম সবক সৃষ্টিতত্ত্ব-কলা,
যুক্তিসিদ্ধ উক্তিসিদ্ধ অনর্গল তাঁর বলা।
রফিকস্যারের ক্লাশের শুরু শাহ্জাহানী চালে,
ডি.এল. রায়ের নাটকের পাঠ, আলাপ তালে তালে;
রাজিয়া খান পছন্দ যাঁর ব্লেক আর জন ডান,
রাশভারি চাল গুহঠাকুর, হাসি তার অম্লান।
হোসনে আরা, নিয়াজ, আহসান, আর রাশীদুল হাসান
বিভাগ-প্রধান হোসেনস্যারের চলন ভিক্টোরিয়ান;
পাশা স্যার আর নবীন-প্রবীণ ছাত্র-শিক্ষক কতো,
মাতৃসমা এ. জি. স্টক, আর কেউ নয় তার মতো।
ক্লাশের শেষে ভরদুপুরে রোদবৃষ্টিতে জলে-ঝড়ে,
উৎসুক দুচোখ খোলা মেলা পাঠাগারের চত্বরে;
রোকেয়া হলের বাহির দেখেছো, দেখেছো তার প্রাণ?
অন্তরে তার হাজার ললনা, বাহিরেতে দারোয়ান।
আবুল হাসান অপেক্ষমাণ, আসে যদি বনলতা!
গুণ-হুমায়ুন প্রলাপেই খুন, বুকে বোনে বুনো কথা;
বন্দনা আজ উধাও দুপুর, সুলতানা রেবু গিয়েছে কই?
মালিহাও সঙ্গিনীহীন, কোথায় যে তার নাছোড় সই?
শতবর্ষী চিত্ততীর্থ কালের পাতায় লিখছে সব,
মনে মনে মনন মিলন, ঘ্রাণে প্রাণে ঘ্রাণোৎসব;
ঋতু রঙে, মন-গহনে সেতুবন্ধে সব হাসে;
প্রবীণকে সে শ্রদ্ধা জানায়, নবীনকে সে ভলোবাসে।
মুক্তচিত্তের মু্ক্তবয়ান স্বাধীন সত্তার মননকথা,
ধ্যানে জ্ঞানে সদাচারে মানবসত্তার প্রমুক্ততা।
জ্ঞান আসে আর প্রজ্ঞা থাকে, বাড়ে মানব অমরতা;
বাঙালির এই মর্মতীর্থে জ্ঞান-মনীষার মর্মরতা৷
[১-২ জুলাই ২০২১]