‘দিল্লি কি আখেরি দিদার’-এর বিষয়বস্তু হচ্ছে মোগল শাসনের শেষ পর্বে দিল্লির মুসলিম ও হিন্দু বাসিন্দাদের প্রীতিময় সহাবস্থান এবং নানা উৎসব আয়োজনের বর্ণনা।
Published : 11 Apr 2024, 02:02 PM
উনিশ শতকের মধ্যভাগ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ। প্রায় তিন শতাব্দী স্থায়ী মোগল শাসনের যবনিকা নামছে, ভারতের বুকে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসতে যাচ্ছে বৃটিশ প্রভু। পরিবর্তনের দমকা হাওয়া বইছে চারদিকে। দীর্ঘ এক গোধূলির ছায়া ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে রাজধানী দিল্লির আনাচে কানাচে। দিল্লিওয়ালাদের স্বপ্নে কল্পনায় স্মৃতিতে আঁচড় কাটছে ফেলে আসা দিন। ‘আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে?’-হয়তো রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতার মতোই ভাবছিলেন তারাও। হারানো দিনগুলোর প্রতি তাঁদের এই তৃষিত দৃষ্টিপাতেরই কয়েকটি টুকরো ছবি কুড়িয়ে নিয়েছেন ইতিহাসবিদ রানা সাফভি। তাঁর বহুলপ্রশংসিত বই ‘দ্য সিটি অব মাই হার্ট’-এ স্থান পেয়েছে ঊনিশ শতকের শেষার্ধে লেখা চারটি মূল্যবান গ্রন্থের অংশবিশেষের অনুবাদ। বই চারটি হলো সাইয়েদ ওয়াজির হাসান দেহলভি-র ‘দিল্লি কি আখেরি দিদার’, মুন্সি ফাইজুদ্দিনের ‘বাজমে আখির’, র্আশ তাইমুরির ‘কিল্লা ই মুয়াল্লা কি ঝলকিয়া’ ও খাজা হাসান নিজামি-র ‘বেগামাত কি আঁসু’।
চারটি বইয়ের প্রথমটি, ‘দিল্লি কি আখেরি দিদার’-এর বিষয়বস্তু হচ্ছে মোগল শাসনের শেষ পর্বে দিল্লির মুসলিম ও হিন্দু বাসিন্দাদের প্রীতিময় সহাবস্থান এবং নানা উৎসব আয়োজনের বর্ণনা। ওয়াজির হাসান ছিলেন দিল্লির প্রখ্যাত মৌলভি আহমেদ হাসান মোহাদ্দিসের পুত্র ও আল্লামা আহমেদ দেহলভির পৌত্র। মোগল শাসনামল সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়নি তাঁর, তবে মোগলদের গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছেন। বইটির প্রকাশকাল ১৯৩৪। সম্পাদনা করেছিলেন ‘সাকি-ও-শাহজাহান’ পত্রিকার সম্পাদক শহীদ আহমেদ দেহলভি। বইটির মুখবন্ধে শহীদ আহমেদ লিখেছিলেন, ‘দিল্লির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, বর্ণিল উৎসব আর বাদশাহী কিল্লার অধিবাসী ও দিল্লির সাধারণ মানুষের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন সাইয়েদ ওয়াজির হাসান। ... রক্তের অশ্রু না ঝরিয়ে এ বইটি পড়া কোনো পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয় (No one who reads it can stop himself or herself from weeping tears of blood)।’
সাইয়েদ ওয়াজির হাসান দেহলভি-র ‘দিল্লি কি আখেরি দীদার’-এ দিল্লিবাসী মুসলিমদের পবিত্র রমজান এবং ঈদুল ফিতর পালনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে। ‘দ্য সিটি অব মাই হার্ট’ থেকে প্রাসঙ্গিক অংশের অনুবাদ নিয়েই এ নিবন্ধ।
রমজান মাস ক্রমশ এগিয়ে এলে আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে যায়। পুরো রমজানই চলতে থাকে এটি। এ মাসের জন্য আগে থেকেই পয়সা জমিয়ে রাখে মানুষ। হিন্দুরাও এ মাসের পবিত্রতাকে সম্মান করে। বন্দুকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে সেহরি ও ইফতারের সময় ঘোষণা করা হয়। সেহরি শেষে অনেকেই কোরান পাঠ ও প্রার্থনায় সময় অতিবাহিত করেন। কেউ কেউ ঘুমান। কেউবা ফজরের নামাজ পড়েই নৌকাভ্রমণে অথবা নদীতীরে হাঁটাহাঁটি করে শরীর ঠান্ডা করার কোশেশ করেন। কেউ আবার চলে যান জঙ্গলে, খাঁচায় বন্দি তিতির বা কোয়েল পাখি নিয়ে। কেউ যান দরগায়। সূর্য ওঠার পর পুরো শহর রোদে ঝলমলাতে থাকে। রোদের তেজ একটু বাড়তেই বাজারগুলো মানুষের ভিড়ে গমগম করে ওঠে। থালাবাসনের টুংটাং শব্দে ভরে ওঠে চারদিক। সদ্য রান্না করা খাবারের মৌতাত ছড়িয়ে পড়ে বাজারময়।
ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলে দস্তরখান পাতা হতে থাকে। তোকমার শরবত, ফালুদা, লেবুর শরবতসহ নানা ধরনের শরবত, দই বড়া, কাবাব, ছোলাসহ নানা সুস্বাদু খাবার ট্রেতে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর বাদশাহর কাছ থেকে সংকেত আসে। বাদশাহর প্রতিনিধি পতাকা দোলালে কামান থেকে গোলা ছোড়া হয়। এই সংকেত রোজা ভাঙার। আজানের সুমিষ্ট ধ্বনি ভেসে আসে। রোজাদাররা জমজমের পানি দিয়ে রোজা ভাঙেন, সঙ্গে থাকে মক্কা থেকে আসা খেজুর। মাগরিবের নামাজের আগে শরবত আর দু-এক লোকমা খাবার মুখে দেয় মানুষ। রাতে প্রবল নিষ্ঠায় তারাবি পড়ে মসজিদে মসজিদে। কোরান তেলাওয়াতের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে শহরময়।
তারাবির নামাজের পর রাত প্রায় দেড়টা অবধি ঘুমায় সবাই। তারপরই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চৌকিদারের হাঁক শোনা যায়, ‘রোজাদারেরা খোদার বড় প্রিয়। হে ধর্মভীরু মুসলিম, জেগে ওঠো। জাগো তোমার নিজের গরজেই। ঘুম থেকে যারা জাগবে তারা খোদাকে পাবে।’
এসব কর্মকাণ্ডে রমজান পার হয়ে যায়। মাসের শেষ শুক্রবার ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালিত হয় আলবিদা। মাসর ঊনত্রিশতম দিন সবাই উৎসুক চোখে আকাশের দিকে তাকাতে থাকে, অপেক্ষা করে কখন চাঁদ দেখা যাবে। বাদশাহী ঘোড়সওয়ারেরা দিকে দিকে ছুটে চন্দ্র সন্দর্শনের আশায়। চাঁদ দেখা গেলে খবর পাঠায় তারা: আগামীকাল ঈদ। নইলে আরো একদিনের অপেক্ষা। তখন ঈদকে বলা হয় পুরনো ঈদ।
ঈদের দিন সকালে দুধের সেমাই খেয়ে নতুন কাপড় পরে সবাই। সবচেয়ে সুগন্ধি আতর মাখে গায়ে। তারপর ঘোড়াগাড়ি বা পালকি চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে রওনা দেয় ঈদগাঁর দিকে। কাফেলা নিয়ে ঈদগাঁয় আসেন বাদশাহ। নামাজ পড়েন। খুতবার আগে ‘কোরখানা’ (রাজকীয় অস্ত্রাগার)-র দারোগা ইমামের গলায় সোনালি সুতলি দিয়ে নিজের তরবারিটি বেঁধে দেন। খুতবা শেষে মুসল্লিরা একে অন্যের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। বন্দুকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ঈদের আনন্দ উদযাপন শুরু হয়। বাদশাহি হাতিতে চড়ে প্রাসাদে ফিরে যান বাদশাহ। চলে যান মর্মর পাথরে তৈরি নিজের বৈঠকখানায়। সোনার কালিতে সাঈদুল্লাহ খানের কবিতার পংক্তি লেখা অপূর্ব কারুকাজ করা এই সৌধটি ছিল বাদশাহী কিল্লার প্রধানতম আকর্ষণ। রাজসিংহাসনের (শাহ নোশিন) সামনে মোজাইক আর রঙিন পাথরের নকশা করা পাঁচ খিলানবিশিষ্ট বিশাল এক হলঘর। এর পশ্চিমপাশের একটি দরজা দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় দিওয়ান-ই-খাসে। হলঘরের ঠিক মধ্যিখানে নানারকম ফুলের নকশা করা দামি মণিরত্নে সাজানো মর্মর পাথরের এক আয়তাকার বেসিন। ফুলের প্রতিটি পাপড়িতে আছে একটি করে ক্ষুদ্র ছিদ্র যা দিয়ে পানি বাইরে চলে যায়। হলঘরের সামনে আছে সুপ্রশস্ত আঙিনা, যার মধ্য দিয়ে কিল্লার বিভিন্ন মহলে পানি প্রবাহিত হয়। এক পর্যায়ে দিওয়ান-ই-খাসে চলে যান বাদশাহ, সেখানে তখতে তাউসে (ময়ুর সিংহাসন) বসে রাজসভা পরিচালনা করেন। অতিথিদের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করেন তিনি, শাহজাদা ও অভিজাত শ্রেণির মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেন ফুলের মালা আর নকশি পাগড়ি।