দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদেরকে 'অপরায়ন'-এর যে চেষ্টা চলছে, চিত্রকর শুভাপ্রসন্নর 'প্রয়াস' নিছক তারই অঙ্গ
Published : 21 Feb 2024, 10:44 AM
কথা শুরু হচ্ছে এভাবে--'কি জানো তো', 'কি হয়', 'হয় না'? 'অসভ্যতামি' তো আছেই! 'দারিদ্রতা' আগেই হয়েছে, কবে হয়তো দেখব ও শুনব, 'দারিদ্রতামি'র ব্যবহার চালু হয়ে গেছে--নইলে 'দারিদ্র' ঠিকমতো করুণরসে সিক্ত হয় না যে! 'সখা' থেকে হয় 'সখ্য'! কিন্তু, অনেকেই লেখেন--'সখ্যতা'! কিছুদিন পর হয়তো হবে--'সখ্যতামি'! 'অসহ্য'ই যথেষ্ট, কিন্তু তাতে 'অসহনীয়তা' বোধহয় ঠিকঠাক ফুটে ওঠে না; তাই বলতে শুনছি--'অসহ্যকর'! আরও আছে--'ঘৃণ্যত্ব'! 'ঘৃণা' থেকে 'ঘৃণ্য'---এত অল্পে তো আর চলে না! এমন অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। হাল আমলের বাঙালির বাংলা ভাষা ব্যবহারের মাত্র কয়েকটি মহান নমুনা! আরও আছে। ওনার, উনার, ওনারা, উনারা, যিনারা, তিনারা। মারাত্মক আনন্দ, ভীষণ সুখ, বীভৎস ভাল ইত্যাদি!
ধরা যাক, পিতা কিংবা পিতামহ বিপুল শ্রমে বহু সঞ্চয় করেছেন। পরবর্তী প্রজন্ম সেসব উড়িয়ে ছড়িয়ে নষ্ট করছে। তারা সবকিছু পেয়েছে না-চাইতেই। শ্রমের মূল্য তারা বুঝবে কীভাবে? ভাষা আন্দোলন কোন ভাষিক আগ্রাসনের পটভূমিতে সংগঠিত হয়েছিল সেই ইতিহাস জানা জরুরি। পিতা কিংবা পিতামহ'র সঞ্চয়টা পেয়ে যদি কেবল আনন্দধারায় ভেসে যাওয়া হয়, তারা কীভাবে তিল তিল করে সঞ্চয়টা গড়ে তুলল, একই সঙ্গে সেই ব্যাপারটাও যদি চর্চিত না হয়, তাহলে সঞ্চয়ের প্রতি অযত্ন, অবহেলা এবং তার অপচয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এটাই হচ্ছে। গড় বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি যে অপরিমেয় অযত্ন ও অবহেলা দৃশ্যমান, তা একুশে ফেব্রুয়ারির এত জমজমাট স্মরণ ও উদযাপন সত্ত্বেও কেন দূরীভূত হয় না? কারণ, ওই চরম ভাষিক আগ্রাসনের ইতিহাস নিরবচ্ছিন্নভাবে চর্চিত হয় না। অথচ, খুব একটি জরুরি কাজ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে আমাদের মনে আছে। কারণ, তা কালক্রমে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দেয়। তার নাম বাংলাদেশ। কিন্তু, ১৯৬১ সালের ১৯ মে দিনটিকে আমরা তেমন মনে রাখি না। অথচ, এই দিনটিতেও মাতৃভাষা বাংলায় নিজের অস্তিত্বরক্ষার দাবি প্রতিষ্ঠায় ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। স্থান : ভারতের আসামের শিলচর। মনে রাখা উচিত, 'ভাষা' কেবল ভাবপ্রকাশের বাহন নয়। ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের মুক্ত জীবনের আনন্দধারা। এখনকার বাংলাদেশ, যা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, তার 'শাসক'রা কেবল ওই ভূখণ্ডে উর্দু ভাষার আধিপত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল বললে খণ্ডিত সত্য উচ্চারণ করা হয়। কারণ, নিছক ভাষার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় শাসকের কোনও লাভ নেই। শাসকের ভাষা মূলত ক্ষমতার অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম, যে ক্ষমতা পরাধীনতার গ্লানি 'উপহার' দিতে ব্যগ্র থাকে! আসলে মানুষের 'মুক্ত জীবন'-এর 'আনন্দ' হরণ করাই ভাষিক আগ্রাসনের মর্মকথা। এই মূল বিষয়টা ওই ভূখণ্ডের মানুষ বুঝেছিল বলেই তাদের সংগ্রাম কেবল পরম প্রিয় মাতৃভাষার অধিকার, সম্মান বা গৌরব প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। আসামেও সংখ্যাগুরু বাঙালির উপর ভাষিক অবদমনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু অসমিয়া আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা হয়েছিল।
রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে গৌরবান্বিত করে তোলার পর আজ এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে 'বাংলা' ভাষাটিকে বাঙালিরা কি যথার্থই তাদের জীবনের সঙ্গে 'গ্রথিত' করতে পেরেছে? অর্থাৎ, বাংলা ভাষার প্রতি তাদের 'ভালবাসা'র খাঁটিত্ব প্রমাণ করতে তারা কতটা সচেষ্ট? কেবল বাংলাদেশ নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠবে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ও উনিশে মে নিছক 'উদযাপনের' দুটি দিন নয়, মূলত বাঙালির 'আত্মদর্শনের' দিন। কিন্তু, নিরন্তর হয় উল্টো। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে মনে রাখতে হবে, মাতৃভাষাকে দূরে সরিয়ে রাখলে, মাতৃভাষা একদিন যে 'প্রতিশোধ' নেবে সেই সত্য সহনীয় হবে তো? 'কীভাবে' সেটা বোঝার জন্য মস্তিষ্ক সঞ্চালন করা দরকার। 'প্রতিশোধ' নেওয়া কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। বিশেষত এপার বাংলায় আজ বাংলা ভাষাচর্চাবিমুখতার গোদের উপর বিষফোড়ার মতো হিন্দি ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ দুয়ারে কড়া নাড়ছে! কিন্তু, বাঙালি 'ঘুমন্ত'! হায়! কপোতাক্ষ নদের ও বাংলা ভাষার প্রেমে একদিন ফিরে আসা মধুকবির ভাষিক মানুষেরা প্রিয় বাংলা ভাষা থেকে 'দূরে সরে' যাওয়ার আবহে ভাষার এই 'মধুর প্রতিশোধ'-এর আখ্যান নির্মিত হচ্ছে কি না তা ভাবার সময় কি আসেনি?
বাঙালির ভাষাচর্যায় মিশ্রণ-প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে যেসব বাঙালি দেশীয় গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতিমান হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই বাংলা ও ইংরেজি দুটোই পড়ার পাশাপশি শোনারও সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওয়েবিনার, সেমিনার জাতীয় বিদগ্ধ আলোচনা হোক, আর সাক্ষাৎকার, টুকরো কথা ইত্যাদি, সবখানেই শুনেছি বা দৃশ্যমাধ্যমে দেখেছি ও শুনেছি, তাঁরা বাংলা ও ইংরেজি কখনও মিশিয়ে ফেলছেন না। অর্থাৎ, যখন বাংলায় বলছেন তখন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন না। ইংরেজিতে বললে তখন তো বাংলা শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজনই নেই। এটাই হচ্ছে কথা। ইংরেজি বললে যদি বাংলার প্রয়োজন না হয় তাহলে বিপরীত ক্ষেত্রেই-বা কেন সেই প্রয়োজন পড়ে? আজকাল তো দেখছি, মৌখিকতা লেখার অক্ষরেও বাসা বাঁধছে ধীরে ধীরে। লিখছেন বা বলা ভাল বক্তব্য প্রকাশ করছেন বাংলায়, কিন্তু অকারণে ইংরেজি শব্দ চলে আসছে--যেন ওই শব্দগুলির বাংলা নেই, কিংবা সেইসব শব্দ শ্রুতিমধুর নয়! এরাই আবার 'বাংলা ভাষা আক্রান্ত' এই মর্মে কোনও স্বাক্ষর সম্বলিত দাবিপত্র উপস্থাপিত হলে সবার আগে স্বাক্ষর করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন! আজব দ্বিচারিতা! যদি বলা হয় যে, অবচেতনেই হচ্ছে ওই ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষার অবলম্বন তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, অবচেতন থেকে চেতনে পৌঁছতে কতদিন সময় লাগে? এসব ছেঁদো যুক্তি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতা যদি বাঙালিই এভাবে নষ্ট করে চলে তাহলে আর অন্য কারও উদ্দেশে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসার অর্থ হয় না। আরেকটা বিষয়ও খুব রমরমিয়ে চলছে। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা। অদ্ভুত! এটারও আর অবসান হ'ল না!
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে এবং চলেও যায়, যথারীতি। অনেক কিছু বলা হয়। কিন্তু তারপর? যথা পূর্বং তথা পরং। সে যাই হোক, সময়ের নিক্তিতে একুশে ফেব্রুয়ারির মেয়াদ আর পাঁচটা দিনের মতোই ক্ষণস্থায়ী হলেও, তার চেতনা অস্তমিত হওয়ার নয়, আর নয় বলেই তার চর্চাও অব্যাহত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
উগ্র জাতীয়তাবাদ ভাষার মধ্যেও কীভাবে অনুপ্রবেশ করে, তা বাংলা ভাষা নিয়ে যারা নিরন্তর চর্চা করেন তারা তার খোঁজ রাখেন। বিষয় হ'ল, যারা অষ্টপ্রহর কেবল 'অনুপ্রবেশ অনুপ্রবেশ'--এই চিল-চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ করেন, তারা যে ভাষার ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন কোনওটাই না-জেনে ও না-বুঝে 'অনুপ্রবেশ'-এর গন্ধ পাবেন, তা তো ধরেই নেওয়া যায়। বাংলা ভাষা বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে নিজেকে সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছে এবং এই গ্রহণের ধারা আজও অব্যাহত। এর প্রয়োজনীয়তা যে এখনও ফুরিয়ে যায়নি সেকথা যুক্তিসহ সৈয়দ মুজতবা আলী স্পষ্ট করে তাঁর 'নব নব সৃষ্টি' প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। কিন্তু, 'অনুপ্রবেশ' তত্ত্বের প্রবক্তারা কি আর অত 'পড়াশুনার কষ্ট' করবেন? তাই তারা উঠেপড়ে লেগেছেন বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার থেকে আরবি ও ফার্সি শব্দগুলোকে ছেঁটে ফেলার জন্য। আর কোনও ভাষার শব্দ দোষ করল না, যত দোষ করল আরবি ও ফার্সি! উগ্র জাতীয়তাবাদ কি দু'চোখ বর্জিত? কিন্তু, অন্ধ ব্যক্তি তো অন্ধত্বের সঙ্গে সঙ্গে বিবেচনাশক্তিও হারিয়ে ফেলেন না! তো, এদের বোধহয় দুটোই নেই। যদি থাকত তাহলে প্রথমত, কোনও জীবন্ত ভাষায় শব্দ ঢোকার ব্যাপারটা যে 'অনুপ্রবেশ' নয়, নিতান্ত স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত তা এরা বুঝতেন। আর দ্বিতীয়ত, অসংখ্য আরবি ও ফার্সি শব্দকে ছেঁটে ফেললে বাংলা ভাষার যে কী করুণ ও দীন দশা হবে--অনেকটা 'পঞ্চত্বপ্রাপ্তি'ও বলা যায়, সেটাও এরা বুঝতেন!
শব্দের কোনও ধর্ম নেই, ধর্ম হয় না একথা সত্য। মুসলিম মাত্রেই 'পানি' শব্দটি উচ্চারণ করে, অতএব, সেটি 'মুসলমানি শব্দ' এই তত্ত্ব ও ধারণা ডাহা ভুল। 'পানি'র মতো কিছু শব্দ দিয়ে আসলে মুসলিমদের 'বাঙালিত্ব'-কে প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে, যা পরিকল্পিত। ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সংখ্যার 'দেশ' পত্রিকায় 'শেষকথা' কলামে চিত্রকর শুভাপ্রসন্ন একটি 'লেখা' লিখেছিলেন। 'পানি' শব্দটি নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের ঢেউ তোলার পর অনেকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি একটি 'চতুর রাস্তা' ধরেছিলেন তাঁর সেই লেখায়। কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিত ব্যক্তির নাম তিনি উল্লেখ করেন, যাঁদের লেখায় 'পানি, গোসল, দাওয়াত' এসব শব্দ নাকি ব্যবহৃত হয়নি, যা তাঁর 'মহান সিদ্ধান্ত'-কে বলিষ্ঠ করেছে! তাঁর লেখায় উল্লিখিত পণ্ডিত বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা 'ভাষাবিদ' তাঁদের লিখিত বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কিত বইগুলি তিনি পড়ে দেখেননি। শেষে তিনি আরেক কাণ্ড করেছেন। প্রয়াত প্রাবন্ধিক আনিসুজ্জামান নাকি চিত্রকরের বক্তব্যে 'সমর্থন' জানিয়েছিলেন। 'সত্য' কি না তা জানার উপায় নেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হ'ল, আনিসুজ্জামান বিরাট মাপের প্রাবন্ধিক হলেও 'ভাষাবিদ' ছিলেন না। শুভাপ্রসন্ন নিজে 'বিভ্রান্ত', আর সবাইকে 'বিভ্রান্ত' করার চেষ্টা করেছেন! সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হ'ল, 'দেশ'-এর মতো একটি পত্রিকা এমন একটি 'অর্বাচীন লেখা' কীভাবে প্রকাশ করল, যার বাক্যে বাক্যে ত্রুটি, বিভ্রান্তি, প্রলাপ ইত্যাদি বর্তমান!
শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসেও ছিল 'বাঙালি ও মুসলিমের মধ্যে' ফুটবল খেলার বর্ণনা! অতএব, নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে মুসলিমদেরকে 'অপরায়ন'-এর যে চেষ্টা চলছে, চিত্রকর শুভাপ্রসন্নর 'প্রয়াস' নিছক তারই অঙ্গ ; নইলে তাঁর সমূহ শব্দ-বাক্য বাংলা ভাষার কোনও 'উপকারেই' যে লাগবে না তা সুনিশ্চিত!