Published : 04 Jun 2022, 12:09 AM
বাংলা কথাসাহিত্যের ব্যতিক্রমী রূপকার শহীদুল জহিরের একাধিক উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ দুই অনুবাদক কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে এই প্রথম আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রবেশ করেছে। শহীদুল জহিরের জন্য যেমন, তেমনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের জন্যও এটি অত্যন্ত গৌরবজনক এক ঘটনা। ভারতের ভি রামস্বামী আর বাংলাদেশের শাহরোজা নাহরিনের যৌথ অনুবাদে এ বছরের শুরুতেই ভিন্ন দুই সংস্করণে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হলো শহীদুল জহিরের দুটি উপন্যাস। এর আগে বাংলাদেশের প্রধান দুই লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও শওকত ওসমানের উপন্যাস ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রবেশ করলেও, বাংলাদেশের কথাসাহিত্য বহুদিন 'বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে' কাটিয়েছে। বহু দশকের ব্যবধানে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই অনুবাদকের মাধ্যমে উপেক্ষা ও অন্ধকারের নেকাব সরিয়ে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য আন্তর্জাতিক আবেদন নিয়ে মুখ দেখাতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বিডিআর্টস-এর সঙ্গে শহীদুল জহিরের কথাসাহিত্যের অনুবাদ বিষয়ে উভয় অনুবাদকের সাথে যে-আলাপ হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো এখানে। বি.স.
বিডি আর্টস: শহীদুল জহির আপনারা প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এবং যতদূর জানি, তার আরও কিছু কাজ আপনারা অনুবাদ করছেন। প্রথমেই জানতে চাইবো আপনাদের দু'জনের কাছেই, বাংলাদেশের এত কথাসাহিত্যিক থাকতে কেন শহীদুল জহিরকে বেছে নিলেন? রামাদাকে, আপনাকে, এই সূত্রে আরও একটি সম্পূরক প্রশ্ন: অনুবাদকের ভূমিকায় বলেছিলেন যে ইকবাল হাসনুর মাধ্যমে শহীদুল জহিরের কথা জেনেছেন। জহির ছাড়া কি আর কোনো বাংলাদেশি লেখকের কথা জানতেন যার লেখা অনুবাদের আগ্রহ তৈরি হতে পারতো?
রামস্বামী: ইকবাল হাসনুর নাম এই প্রসঙ্গে আনা একেবারে যথাযথ। ওনার মাধ্যমেই আমি শহীদুল জহিরের নাম প্রথম শুনি। মার্চ ২০১৯ এ, ইকবাল ভাই আমাকে ইমেইলে লেখেন: "I would like you to read Bangladesh's late writer Shahidul Zahir whose short stories demand an eye like yours for translation and whom you may find quite extraordinary." এবং উনি ওনার ঢাকার এক বন্ধুকে বললেন জহিরের গল্প সমগ্র আমাকে পাঠাতে। তারপরেই, একই নাম আবার শুনি, করাচির আজমল কামাল-এর কাছ থেকে, উনি CITY পত্রিকার সহ-সম্পাদক। পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যার বিশেষ থিম ছিল, "Contemporary Writing From Bangladesh"। আজমল বললেন, অনুবাদ পাঠাও, আমি উত্তর দিলাম, আমি তো বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের বিষয়ে কিছুই জানি না, যদি কিছু পাঠাও আমি অনুবাদ করবো। তাই হলো, উনি মনে হয় একে, ওকে জিজ্ঞেস করে, কয়েকজন লেখকের নাম, এবং তাদের কিছু গল্পের সফ্ট কপি আমাকে পাঠান। ওগুলোর মধ্যে, শহীদুল জহির উপস্থিত, নাম দেখে মনে হলো, ইকবাল হাসনু একই লেখকের নাম বললেন না! হ্যাঁ, একই নাম। তো ওই সূত্রে, জহিরের একটি গল্প অনুবাদ করলাম CITY পত্রিকার জন্য।
এভাবে ঘটলো শহিদুল জহিরের সঙ্গে আমার 'encounter'! পড়তে শুরু করলাম। প্রথম গল্প, "কোথায় পাবো তারে", প্রথম বাক্যেই আমি জহিরের গদ্যের মায়াজালের মধ্যে ফেঁসে গেলাম। তারপর পড়লাম "আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস", মনে হলো, পৃথিবীতে এরকম গল্প কেউ কখনো লিখেছে কি? এবং তারপর প্রায় দু'সপ্তাহ আমি শহীদুল জহিরের গদ্যের মধ্যে বাস করলাম বলা যায়! আমি জহিরের নভেলা, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা করেছি। ১০-টি গল্পের একটি সংকলন, এবং মুখের দিকে দেখি উপন্যাস অনুবাদ করবো। ইকবাল হাসনুই আবার গল্পগুলো বাছাই করলেন এবং লেখকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন, তারপর আমি ওনাদের কাছ থেকে অনুবাদ করার অনুমতি পাই।
এবং আমার মনে হয় যে, আমি যখন প্রান্তিক বাংলাসাহিত্য অনুবাদ করছি, আমার বাংলাদেশের সঙ্গে, মানে বাংলাদেশের সাহিত্যের মানুষের সঙ্গে এবার সম্পর্ক তৈরী করা উচিত। সে উদ্দেশ্যে, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে, বাংলাদেশে গেলাম। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম। এ ভাবে আরম্ভ হয় আমার জীবনের আর এক নতুন যাত্রা। ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ এ আবার গেলাম বাংলাদেশ। প্রত্যেক বার মনে হলো যে, সম্পর্ক ও বন্ধুত্বগুলো আরো উষ্ণ, আরো গভীর হয়ে ওঠে।
২০২০ সালের শুরুর দিকে, শহীদুল জহিরের ভাইয়ের কাছ থেকে একটি জিজ্ঞাসা, আপনার কাজ কতদূর এগোলো?
শাহরোজার সঙ্গে তখন ফেসবুকে আলাপ হয়, এবং আমি ওকে এই অনুবাদ আমার সঙ্গে করার প্রস্তাব দিই। শাহরোজা রাজি হয়, এবং আমি ঢাকায় আসি, আমরা দু'জন অনুবাদটা নিয়ে বসলাম। প্রাথমিক অনুবাদ শেষ হলো, এবং তারপর এলো pandemic এবং লকডাউন। যাই হোক, ৬ মাসের বিঘ্নের পর, শাহরোজার সঙ্গে অনলাইন মিটিং-এর মাধ্যমে কাজ করতে শুরু করলাম। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা শেষ হলো, ইতিমধ্যে আমার Literary Agent, শ্রুতি দেবী, হার্পেরকলিন্স-এর সঙ্গে জহিরের তিনটি বইয়ের চুক্তি করালেন। প্রথম বইতে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু থাকবে ঠিক হলো। এবং কয়েক মাস পর আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু ধরলাম, শেষ করলাম, শাহরোজার সহায়তায়।
CITY পত্রিকার জন্যে শাহাদুজ্জামান এবং অদিতি ফাল্গুনীরও গল্প অনুবাদ করেছিলাম, ওনাদেরও গল্প সংকলন অনুবাদ করতে চাই। চট্টগ্রামে আলম খোরশেদের সঙ্গে আলাপ হলো, উনি আমাকে উপহার হিসেবে মশিউল আলমের গল্প সংকলন, পাকিস্তান দিলেন, ২০২০-এ পাকিস্তান গল্পটা অনুবাদ করলাম, এবং মশিউল ভাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরী হলো। ওনার একটি গল্প সংকলন অনুবাদ করতে চাই।
২০২০-এ, সৃষ্টি দত্ত চৌধুরী আমাকে আমার অনুবাদ কাজে সহায়তা করছিলো, ওর মুখে শুনি শওকত আলীর নাম, এবং ওনার নাঢ়াই এবং প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের সম্মন্ধে। মনে হলো এগুলো অনুবাদ করা উচিত, লেখকের ছেলে আসিফের সঙ্গে যোগাযোগ হলো, অনুবাদের অনুমতি পেলাম।
এই ভাবেই ঘটেছে সব কিছু। আসলে বাংলা সাহিত্যের আমি একজন সাম্প্রতিক অনুবাদক মাত্র। পাঠক নই। বাংলায় কোনো গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ কোনোদিন পড়িনি। ২০০৫-এ এক বন্ধুর পাল্লায় পরে সুবিমল মিশ্রর 'আন্টি-গল্প' অনুবাদ করতে শুরু করেছিলাম। এবং তারপর ঠিক করলাম যে আমি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বাংলার "voices from the margins' বিশ্ব সাহিত্যের জগতে আনার চেষ্টা করবো। কী অনুবাদ করা উচিত, কোন লেখক অনুবাদ করবো – কয়েকজন বন্ধুদের পরামর্শের ওপর নির্ভর করি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘটনাচক্রে, বা কাকতালীয়ভাবে, ঘটেছে ব্যাপারটা।
শহীদুল জহির হচ্ছেন প্রথম বাংলা লেখক যার লেখা আমি বাংলায় পড়ি, কেবল পড়ার আনন্দের জন্য। আমি কোনোই অসুবিধা অনুভব করলাম না, বরং ১৮ বছর বয়সে, কলেজ জীবনে, যে পড়ার নেশায় নিমজ্জিত ছিলাম, সেই একই নেশায় জহিরের লেখা পড়লাম।
শাহরোজা: আমি শহীদুল জহিরের কাজের সাথে পরিচিত হই ২০১৯ সালে। সেবার শিল্পকলা একাডেমিতে সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মঞ্চস্থ হয়। আমি তখন একটা ইংরেজি দৈনিকে কাজ করতাম। মঞ্চনাটকের রিভিউ করতে সম্পাদক আমাকে পাঠালেন। আমার মনে আছে, থিয়েটারে যাবার পথে ও শিল্পকলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গোটা উপন্যাসটি পড়ে ফেলার পর আমার সম্মোহিতের মত মনে হয়েছিল, এই উপন্যাসটি আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে চাই! মাস খানেক পর রামা'দার সাথে ফেইসবুকে যোগাযোগ এবং সেখান থেকে আমাদের যৌথ কাজের সূচনা।
আমাদের সময়ে সাহিত্য বিষয়ক পত্রপত্রিকা বলতে হাতেগোণা কয়েকটা আছে। যে কারণে ষাটের দশকে লিটল ম্যাগাজিনে লিখতেন এমন লেখক, যেমন রশিদ করীম, শওকত আলী, মাহমুদুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ বা পরবর্তীতে কায়েস আহমেদের কাজের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে অনেক দেরিতে। বলা যায়, স্নাতকের পর ঢাকা ট্রিবিউনে কাজ করতে গিয়ে। যদিও পারিবারিকভাবে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে মূলধারার ও ধ্রুপদী সাহিত্যের সাথে যোগাযোগ ছিল কম-বেশি।
সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় আমার সাহিত্য-সমালোচনায় ঝোঁক আছে। কেউ বই পড়ে পাঠকের দৃষ্টি দিয়ে, আমি পড়ি সমালোচকের দৃষ্টি দিয়ে । তাই গদ্যশৈলী, ফর্ম ও লেখকের প্রকাশভঙ্গী দেখে অভিভূত হই। শহীদুল জহির আমায় টেনেছেন তাঁর গল্প বলার ধরণের কারণে। জন বার্জারের একটা বহুল পঠিত উক্তি আছে, "Never again will a single story be told as though it's the only one (আর কখনো এমন কোনো গল্প বলা হবে না যেটাকে মনে হবে কিনা সেটাই একমাত্র গল্প)" । একই গল্প নানাভাবে বলা যায়। তাই গল্প কি, এর চেয়ে গল্প বলার ঢঙ আমায় আকৃষ্ট করে বেশি ।
রামা'দা ইতোমধ্যে মুখের দিকে দেখি অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন। তিনি আগামীতে শহীদুল জহিরের দশটি ছোটগল্প নিয়ে ছোটগল্প সংকলন বের করবেন। রামা'দার সাথে যৌথভাবে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল অনুবাদের পাশাপাশি এককভাবে শহীদুল জহিরের কিছু ছোটগল্প আমিও অনুবাদ করব। শওকত আলীর শুন হে লখিন্দর অনুবাদের মৌখিক সম্মতি পেয়েছি। ওতেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার আছে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-এর মত সেটিও বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কাজ বলেই আমার মনে হয়।
রামা'দার সাথে কাজের সুযোগ আমার অনুবাদ পদ্ধতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এর আগে যা কিছু অনুবাদ করেছি তাতে ভাবানুবাদে জোর দিয়েছি বেশি। এই যৌথ কর্ম-অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে গল্পের অর্থগত ও বাক্যরীতিগত দিক ঠিক রেখে আক্ষরিক ও ভাবানুবাদের মধ্যে একটা সমঝোতা করা যায়।
Herper Perennial থেকে প্রকাশিত সংস্করণ
বিডি আর্টস: লক্ষ্য করেছি, হারপারকলিন্স থেকে শহীদুল জহিরের যে-বইটি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু-এই দুটি নভেলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে শুধু প্রথম নভেলাটিই আছে। এই পার্থক্যের কারণ কী?
রামস্বামী: আমি চেয়েছিলাম যে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-এর ইংরেজি অনুবাদের একটি বাংলাদেশি সংস্করণ হওয়া দরকার, বিশেষ করে বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে। বন্ধু নাঈম মোহাইমেন সংহতি পাবলিকেশন্স-এর জোনায়েদ সাকির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। এবং চেয়েছিলাম এটিকে একটি "collector's item" এর আকার দিতে। সেই উদ্দেশ্যে, জামিল আহমেদের মঞ্চ প্রযোজনার ব্যাপারে জানার পর মনে হলো ওনার একটি প্রবন্ধ থাকতে পারে। আর ভাবলাম যে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন থাকা উচিত। আবার ইকবাল হাসনুই বললেন এই ব্যাপারে হাসান আল জায়েদের সঙ্গে কথা বলতে। জামিল সাহেব এবং জায়েদ ভাই দুজনই রাজি হলেন। পরবর্তীকালে, হার্পেরকলিন্স জানালো যে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এর সঙ্গে আরো কিছু থাকা দরকার, নইলে বই হবে না। জায়েদের প্রবন্ধে, উনি আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু নভেলার বিষয়ে অল্প কিছু লিখেছিলেন। ওটা পড়েই নিশ্চিত হলাম, আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু থাকবে। এইভাবে দুটি আলাদা বই তৈরী হয়। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-এর সঙ্গে দু'টি প্রবন্ধ, তা নিয়ে বাংলাদেশী সংস্করণ, collector's item; এবং দু'টি নভেলা নিয়ে ভারতীয় সংস্করণ।
বিডি আর্টস: শাহরোজা, বাংলাদেশ সংস্করণে জহিরের যে-বইটি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে অনুবাদকের ভূমিকায় আপনি এই অনুবাদ করতে গিয়ে যে বাধাগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন, সেখানে ঢাকাইয়া ডায়ালেক্ট-এর কথা উল্লেখ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় এই ডায়ালেক্টকে আপনারা—রামাদা এবং শাহরোজা, আপনাদের দুজনের কাছেই আমার এই প্রশ্ন– সামলাতে গিয়ে চমৎকার একটা পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন: ঢাকাই সংলাপটি রোমান হরফে রেখে, এর পরপরই তার ইংরেজি অনুবাদটিও দিয়েছেন। এমনটা কি আপনারা – ডায়ালেক্ট-এর প্রশ্নে—ইংরেজি ভাষার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে করেছেন?
রামস্বামী: হ্যাঁ, ঠিক তাই। যখন থেকে অনুবাদ ধরলাম, প্রায় তখন থেকেই আমি অনুভব করেছি ডায়ালেক্ট অনুবাদ করার চ্যালেঞ্জ, এবং এই ব্যাপারে আমি কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারিনি। কারণ ডায়ালেক্ট একটি আসল, জীবিত জিনিস, লাখ লাখ মানুষ তা রোজ ব্যবহার করে, কিন্তু ইংরেজিতে ওটাকে একটি সিনথেটিক বা কৃত্রিম রূপ দেয় যার কোনো মানে হয় না। হ্যাঁ, ইংরেজি ভাষার কোনো ডায়ালেক্টে, যেমন পূর্ব-লন্ডনের ককনিতে, বা ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে, টাইনসাইডের জর্ডিতে, বা লিভারপুলের স্কাউসে অনুবাদ করা যায়। ডায়ালেক্ট হচ্ছে ভাষার শিকড়, এটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের বুলি, যেটাকে ভাষার তুলনায় ছোট বা তুচ্ছ হিসেবে দেখা বিরাট ভুল। এই সব কারণে, ২০১৬ সালে, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর চণ্ডাল জীবন উপন্যাস অনুবাদ করার সময়, একটি 'eureka moment'-এ, আমি এক রকমের সমাধান পেলাম: কথাটাকে আগে রোমান হরফে লিখে, তারপর তার মানেটা লেখা। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা-তে প্রায় পুরো নভেলা পরোক্ষ উক্তিতে লেখা, এবং মাত্র অল্প কিছু প্রত্যক্ষ উক্তি আছে, সবই পুরান ঢাকার ভাষায়। তো প্রত্যক্ষ উক্তি সমস্তটাই আগে রোমান হরফে পুনরাবৃত্তি করে তারপর মানে দেওয়া, এরকম করা হলো। মহল্লার মানুষের স্বর এভাবে ঢুকেছে অনুবাদেও!
শাহরোজা: আঞ্চলিক ভাষা বা ডায়লেক্ট অনুবাদের সময় ট্রান্সলেটেবিলিটি বা অনুবাদযোগ্যতার প্রশ্ন আসে। আসলে, কোনো ভাষাকেই আরেক ভাষায় হুবহু অনুবাদ করা যায় না। অনুবাদে আমরা কিছু না কিছু হারাই; আবার কিছু না কিছু অর্জনও করি। রাজনৈতিক বাস্তবতা -এর ক্ষেত্রে ঢাকাই সংলাপগুলো এভাবে রোমান হরফে রেখে সাথে ইংরেজি তর্জমা জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, কারণ এতে সংলাপ ছিল নিতান্ত কম। অনেক দক্ষিণ এশীয় লেখকের মাঝে এমন চল আছে, যেমন অরুন্ধতি রায়, বাপসি সিদ্ধা, সালমান রুশদি প্রমুখ লেখকরা তাঁদের ইংরেজি গল্পে দেশি শব্দ জুড়ে দেন। একে অনেকে "কোড সুইচিং" ও "কোড মিক্সিং"-ও বলে থাকেন।
গ্যাব্রিয়েল ওকারা একবার প্রশ্ন করেছিলেন, "There are American, West Indian, Australian, Canadian and New Zealand versions of English…Why shouldn't there be a Nigerian or West African English which we can use to express our own ideas (আমেরিকান, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান এবং নিউজিল্যান্ডীয় ইংরেজি আছে… নাইজেরিয়ান বা পশ্চিম আফ্রিকীয় ইংরেজি কেন থাকবে না, যা দিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব ভাবের প্রকাশ করতে পারব?)"। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা -এ ইংরেজির সাথে বাংলা আঞ্চলিক শব্দপুঞ্জের মিশেলকে আমরা এভাবেও দেখতে পারি।
ফাল্গুন ১৩৯৪ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
আমি বর্তমানে ঝর্না রহমানের ছোটগল্প "দয়ালের বাড়িতে একটা ভিড় জমে ওঠে" অনুবাদ করছি। ওতে মানিকগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে । আর তা শুধু সংলাপেই নয়, ন্যারেটিভেও উঠে এসেছে। ন্যারেটিভের এক পর্যায়ে লেখক প্রমিত বাংলা থেকে আচমকা আঞ্চলিক ভাষায় বর্ণনা দিয়ে পুনরায় প্রমিত বাংলায় ফিরে এসেছেন। এভাবে তিনি ফোকালাইজেশন বা পয়েন্ট অব ভিউ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। যেন গল্প বলার সময় ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন ফোঁড়ন কেটে উঠল! সংলাপে নাহয় কিছু দেশি শব্দ রেখে বোঝানো যায় এতে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ হয়েছে, ন্যারেটিভেও তা ঘটলে উদ্দিষ্ট ভাষার পাঠককে তা কি করে বোঝাব?
ঝর্না রহমান অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি যথাসম্ভব মূলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। মূলের সংলাপে যতিচিহ্নের ব্যবহার করা হয় নি, তাই আমিও অনুবাদে করি নি। তাছাড়া, মূল যদি এক্সপেরিমেন্টাল হয়, অনুবাদ কেন নয়? কোনো কোনো সময় তাই ন্যারেটিভেই আমি অতীত কালের পরিবর্তে বর্তমান কালে বর্ণনা দিয়েছি (যদিও তা যৎসামান্য) । যাতে 'ন্যারেটিভ শিফট' বোঝানো সম্ভব হয়। যাতে বোঝানো যায়, এখানে গল্পের বর্ণনাকারী বা ন্যারেটর বদলে গেছে । এটুকু কৌশল না খাটালে যে "লস্ট ইন ট্রান্সলেশন" হবে!
তবে যেকোনো অনুবাদের ক্ষেত্রে সবকিছুর মূলে উদ্দেশ্য হল অনুবাদ যেন সুখপাঠ্য হয়। সেদিকটাও বিবেচনায় রাখা জরুরি ।
বিডি আর্টস: এই লেখকের বিদেশি পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার ব্যাপারে আপনারা কতটা আশাবাদী এবং কেন?
রামস্বামী: আমি জানি যে সারা বিশ্বে সাহিত্যপ্রেমী আছেন, সাহিত্যবোধ কোনো ভৌগলিক বা ভাষাগত সীমানা মানে না। আমার কাছে যে ভাবে যাসের কেমাল, বা গুন্টার গ্রাস, বা হোসে সারামাগো, বা ওয়ে কেনজাবুরো নামগুলো প্রিয়, শহীদুল জহির একইভাবে প্রিয়, এবং আমি নিশ্চিত যে একইভাবে লোকেরা শহীদুল জহিরকে পড়বেন, গ্রহণ করবেন। আর জহির তো সাধারণ লেখক নন, তাই ওনার পাঠকও সাধারণ পাঠক নন। এরকম অ-সাধারণ পাঠক সারা বিশ্বে আছেন।
সাহিত্য পাঠে এরম হতেই পারে যে পাঠক যখন অন্য দেশের, অন্য ভাষার কথাশিল্পীদের লেখা পড়েন, তখন উনি সেই দেশের সম্বন্ধে ভীষণ কম বা কিছুই জানেন না, এরকম হওয়া স্বাভাবিক, পড়েই পাঠক জানতে পারবে, তো বাংলাদেশের সম্বন্ধে জানার উদঘাটন যদি শহীদুল জহিরের মতন এক জনের হাতে হয়, এটা তো দারুন ব্যাপার!
আমি কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে Literature পড়িনি, শুধু পড়ার আনন্দ অনুভব করেছি এতো বছর। আমার মনে হয় যে শহীদুল জহির একজন অরিজিনাল লেখক, নানান রকমের প্রভাব হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে, কিন্তু মূলে, ওনার সৃষ্টির কোনো উৎস যদি থাকে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটি-মানুষ-ভাষা, যেটা উনি ওনার লেখায়, ওনার unique sensibility দিয়ে distill করার চেষ্টা করেন। আমি যদি ওনার গদ্যে মগ্ন হয়ে থাকি, তাহলে আমার মতন হাজারো পাঠক একই রকম মগ্ন হবেই!
শাহরোজা: শহীদুল জহিরের লেখা একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখাকে কেন্দ্র করে হলেও, এর বিষয়বস্তু বৈশ্বিক। বৃহত্তর রাজনীতির সামনে রাজনৈতিক বাস্তবতা -এর প্রধান চরিত্রের নিজেকে ক্ষুদ্র বোধ করা ও অসহায়ত্ব, কিংবা একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন— এ সবই বিশ্বপাঠকের চেনা। আবার "আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস" ছোটগল্পের একদিকে গরুর গাড়িতে করে মন্দিরের সামনে বালি এনে ফেলা হচ্ছে, অন্য দিকে গড়ে উঠছে লেদ ও লেবেঞ্চুশ কারখানা। এরপর মহল্লার গৃহবধূরা গ্রাইন্ডার/ব্লেন্ডার ইত্যাদি আধুনিক গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে শুরু করছে, আর উঠতি বয়সী যুবকরা বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে ইংরেজি ছবি অ্যান্ড হোয়েন শি ওয়াজ গুড দেখছে। এভাবে কিন্তু গল্পের পটভূমি একটা ছোট মহল্লা থেকে বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে।
রামা'দার একক অনুবাদে শহীদুল জহিরের ছোটগল্পের সংকলনে আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস গল্পটি পাওয়া যাবে।
বিশ্বসাহিত্যে শহীদুল জহির উল্লেখযোগ্য মাত্রা যোগ করবেন বলে আমার ধারণা। রাজনৈতিক বাস্তবতা -এর বাংলাদেশি সংস্করণে সরকার হাসান আল জায়েদ জহিরের সাথে জেইমস জয়েসের তুলনা দিয়েছেন। আমি তারই সূত্র ধরে বলছি, বিশ্বের পাঠক যেমন ডাবলিনের বাসিন্দা না হয়েও জেইমস জয়েসের ডাবলিন নিয়ে গল্প পড়ে আনন্দ পায়, তারা তেমনিভাবে শহীদুল জহিরের পুরান ঢাকার গল্প উপভোগ করবে। রাজনৈতিক বাস্তবতা -এর দীর্ঘ বাক্যগুলো আর ঘুরেফিরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি একদিকে পাঠককে স্যামুয়েল বেকেটের উপন্যাস মার্ফি-এর কথা মনে করিয়ে দেয়, অন্যদিকে "কাঠুরে ও দাঁড়কাক"-এর মত গল্পগুলো মনে করিয়ে দেয় মার্কেজের কথা। আবার জহিরের "চতুর্থ মাত্রায়" ওয়েটিং ফর গোডো-এর মত 'এবসার্ডিটির' ধারণার উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
তাছাড়া, সবশেষে, বিদেশি পাঠপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে বিপণন ব্যবস্থারও তো একটা হাত আছে। কোন গল্প কতটা প্রচার বা মার্কেটেড হচ্ছে, এর উপরে তো অনেক কিছু নির্ভর করে!
বিডি আর্টস: অনুবাদের ক্ষেত্রে যৌথভাবে আপনাদের কাজের ধরনটি কেমন ছিল একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
রামস্বামী: কাজের ধরণ – অনুবাদের প্রথম ধাপের কাজের জন্য সপ্তাহখানেক বসলাম ঢাকায়। শাহরোজা পড়ে, আমি অনুবাদ করি, একই বাক্য, বা তার অংশ কয়েক বার পড়া, এবং আমি ইংরেজি ভাষায় সেই বাক্যের হুবহু নকল করার চেষ্টা করি। একটা কথা বলা জরুরি – সুবিমল মিশ্র নিয়ে আমার অনুবাদক হিসেবে 'হাতে খড়ি'। সুবিমল সাধারণ লেখক নন, কোনো লেখকের মতনই নন। উনি গদ্য নির্মাণের একজন বিবর্তিত কারিগর। তাই ওনার প্রত্যেকটি শব্দ, প্রত্যেকটি কমা, দাড়ি, প্রত্যেকটি বাক্য গুরুত্বপূর্ণ। ওনার ক্ষেত্রে, টেক্সট হচ্ছে সর্বোচ্চ, অলঙ্ঘ্য। আমার কাছে শহীদুল জহিরের গদ্য ছিল একই রকম।
কয়েক জায়গায় কিছুটা আলোচনা, বা পরে আরো গভীরে ভাবার জন্যে নোট করা।
শাহরোজা ব্যক্তিগত কারণে পুরোটা সময় দিতে পারলো না, ওর অনুপস্থিতিতে আমার তরুণ বন্ধু, ইজতেহাদ, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, পড়লো। আর কিছুটা নিজেই, একা। এভাবে প্রথম খসড়া তৈরী হয়। এবার এটার ওপর কাজ আরম্ভ হলো। শাহরোজা মূলের সঙ্গে বার বার মেলায়, আমি ইংরেজিটা বার বার পড়ি, এর ভিত্তিতে আমাদের মধ্যে আলোচনা – সবই অনলাইন।
আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু-এর ক্ষেত্রে, আমি নিজে পুরোটা অনুবাদ করলাম, আর সেই খসড়াটা শাহরোজাকে পাঠালাম, এবং তারপর আগের মতো, মূলের সঙ্গে বার বার মেলানো, আলোচনা, ইত্যাদি।
শাহরোজা: আমাদের যৌথ কাজটিকে আমি মেন্টরশিপ হিসেবে দেখি। শুরুতে কর্মপদ্ধতি কেমন হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলাম। দু'জনে মিলে কিভাবে অনুবাদ করা যায়? অর্ধেক রামা'দা করবেন, আর বাকিটা আমি? কিংবা এক পাতা তিনি, আরেক পাতা আমি? প্রথম দিন রামা'দার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে মনে এ নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু তাঁর সাথে সরাসরি আলাপ হওয়ার পর তাঁর প্রক্রিয়ার উপর সম্পূর্ণ আস্থা তৈরি হল।
রামা'দার ঢাকায় অবস্থানকালীন দিনগুলোতে আমি প্রথমে মূল পাঠ করেছি। ল্যাপটপের সামনে বসা রামা'দা তাঁর ইংরেজি খসড়া করেছেন। এরপর দু'জনে মিলে পর্যালোচনা করেছি। এভাবে একটানা কিছুদিন কাজ করার পর, মাঝখানে ব্যক্তিগত কারণে একদিন সময় দিতে পারি নি। এরপর প্রথম খসড়া নিয়ে রামা'দা পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমালেন। অতিমারী এল। আমাদের কাজ আমরা অনলাইনে নিয়ে এলাম। এও দু'জনের জন্য আরেক নতুন অভিজ্ঞতা! আমরা ঘন ঘন অনলাইন মিটিং করেছি এবং প্রতি বার পুনরায় মূলের সাথে অনুবাদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। নতুন কিছু জুড়েছি, বাহুল্য ছেটেছি, পুরান ঢাকার লোকদের সাথে বার বার কথা বলে উচ্চারণ ও অর্থ ঠিক করে নিয়েছি।
রামা'দা অভিজ্ঞ অনুবাদক। কিন্তু অমায়িক বিনয়ী ব্যক্তি। নতুন বলে আমার পরামর্শ তিনি কখনোই নাকচ করে দেন নি। যেকারণে আমাদের মধ্যে একটা দারুণ শৈল্পিক যোগাযোগ হয়েছে যা কিনা সবসময়ই যে মৌখিক ছিল, তা নয়। অনেকটা আত্মিকও।
এবারও ঝর্না রহমানের গল্প অনুবাদের পর আমি রামা'দার মতামত জানতে চেয়েছি। তিনি যত্নসহকারে প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে তাঁর মত দিয়েছেন। তাঁর সাহচর্য পাওয়া আমার জন্য আনন্দের।
সংহতি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ সংস্করণ
বিডি আর্টস: রামাদা, আপনার অনুবাদকের ভূমিকায় বলেছেন : All I was doing was hearing the Bangla and rendering that into English as accurately as possible, while adhering to acceptable English usage and stretching the limits of syntax as far as possible. বাক্যরীতির সীমবদ্ধতাকে আপনি কিভাবে সামলেছেন, সেটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
রামস্বামী: আসলে আমি ইংরেজি ব্যাকরণ জানিই না বললে ভুল হবে না। আর যতটুকু জানি, তা আমার জ্ঞান ছাড়িয়ে মজ্জার মধ্যে মিশে গেছে। কোনটা সুরে এবং কোনটা বেসুরো যেমন কান চেনে, তেমনি সেই কান কোনটা ব্যাকরণগত এবং কোনটা অব্যকরণগত, বোঝে! ইংরেজি ভাষাটা আমার জন্যে একটা 'শোনার' ব্যাপার, ঠিক শোনাচ্ছে কি না। তিন বছর বয়স থেকে ইংরেজি শোনা, বলা, পড়া; কলকাতার একটি বিখ্যাত ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়াশোনা করা, যেখানে আমার বাবা, পিসীরাও পড়েছেন; ওদের আগে আমার ঠাকুরদা মিশনারি স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে মেট্রিক পাশ করেছিলেন, ওনার চাকরি জীবন ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে কাজ করে কাটিয়েছেন; বাবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা আমেরিকায়, বাড়ি ভর্তি ইংরেজি বই, মা, বাবা দুজনই ইংরেজি বই পড়ে … আমি নিজে ২২ বছর বয়সে দু'বছর লন্ডন-এ কাটাই, চাকরি এবং প্রচুর পড়াশোনা, সেই দেশের নানান শ্রেণীর এবং নানান প্রান্তের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা। তারপর দেশে ফিরি। আরো আরো বই পড়ি। ১৯ বছর বয়স থেকে ইংরেজিতে লেখার অভ্যাস। আমার পুরো প্রাপ্তবয়স্ক জীবন – লিখে লিখে কাটিয়েছি। এভাবে গঠিত হয় আমার ইংরেজি ভাষার ওপর দখল।
বাংলা ভাষাটাও আমার কাছে একটা 'শোনা' ব্যাপার, কী শুনছি, তার মানে কী। তাই অনুবাদ যখন করি, বাংলাটা শুনি, আর একই সঙ্গে যা শুনছি তার হুবহু অনুরূপ নির্মাণ করা, যেটা আবার শুনতে সঠিক। কোনটা সঠিক, কোনটা তা নয় – একটা শ্রবণেন্দ্রিয়-সংক্রান্ত ব্যাপার।
বিডি আর্টস: শাহরোজা, বাংলাদেশি সংস্করণের ভূমিকায় আপনি অনুবাদে বিশ্বস্ততার প্রশ্নে এবং লোকাল কালার অক্ষুন্ন রাখার ব্যাপারে ওয়াল্টার বেনজামিন, রুডল প্যানভিৎজ এবং চিনুয়া আচেবের পরামর্শের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু 'রাজনৈতিক বাস্তবতা'র মতো একটি জটিল উপন্যাসকে অন্য ভাষায় বিশ্বস্ততার সাথে সফল করে তোলার ক্ষেত্রে আপনার লড়াইটা কতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছে? একটু বিস্তারিত বলবেন কি?
শাহরোজা: আমাদের যৌথ অনুবাদে আমরা মূলের উপাদান ও কাঠামোগত দিকের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। তবে তা করতে গিয়ে গ্যেটের ভাষায় "foreign splendors" বা আরেক ভাষার ঐশ্বর্য যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সেদিকটাও নিশ্চিত করতে চেয়েছি।
রুডলফ প্যানভিট্জের কথা উল্লেখ করার কারণ এই যে, অনুবাদ করতে গিয়ে আমরা যেন মূল ভাষার রূপ-রস-গন্ধ হারিয়ে না ফেলি, সেদিকে দৃষ্টিপাত করা। জর্মান পণ্ডিত প্যানভিট্জ আক্ষেপ করে বলেছেন যে তাঁর দেশের অনুবাদকেরা এমন কাজটি করে থাকেন, "They want to turn Hindi, Greek, English into German instead of turning German into Hindi, Greek, English. Our translators have a far greater reverence for the usage of their own language than for the spirit of the foreign works (তারা জর্মানকে হিন্দি, গ্রিক, ইংরেজিতে রূপান্তর করার পরিবর্তে হিন্দি, গ্রিক, ইংরেজিকে জর্মানে রূপান্তর করতে চায়। আমাদের অনুবাদকরা বিদেশি লেখার ভাবধারার প্রতি শ্রদ্ধার চেয়ে নিজস্ব ভাষা প্রয়োগের প্রতি ঢের বেশি শ্রদ্ধাশীল)" ।
রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুবাদ করতে গিয়ে প্রথমত আমরা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি তা হল পাঠককে বোঝানো যে এখানে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ হয়েছে। আমরা চাইলেই অন্য যেকোনো ইংরেজি ডায়লেক্ট ব্যবহার করতে পারি না, কারণ সেটা অমূলক ও অযৌক্তিক। প্রত্যেক আঞ্চলিক ভাষার পেছনে একটা ইতিহাস থাকে। আমরা সেটা উপেক্ষা করি কি করে?
আমি নিজে যেহেতু পুরান ঢাকার লোক নই, যেকোনো অপরিচিত শব্দ চোখে পড়া মাত্র আমরা তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকদের সাথে কথা বলে নিয়েছি। সংলাপগুলো রোমান হরফে রাখার সময়ও আমরা উচ্চারণের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। উচ্চারণ ও ভাষান্তর যেন সঠিক ও যথার্থ হয়, তা নিশ্চিত করতে পুরান ঢাকার বন্ধুদের পরামর্শ নিয়েছি।
বিকল্প বা Substitute ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আমরা বুঝতে চেয়েছি উদ্দিষ্ট ভাষায় তা মূলের সমরূপ দ্যোতনা সৃষ্টি করছে কিনা। বিশেষ করে, গালি অনুবাদের সময়। এক্ষেত্রে আমি ভলতেয়ারের কথা স্মরণ করব। তিনি তাঁর "Translator's Preface to Julius Caesar, Tragedy of Shakespeare" শীর্ষক প্রবন্ধে পরামর্শ দিয়েছেন, "if he [the poet] makes use of a word that is low in his language, we must render it by a word that is low in our own"। রাজু আলাউদ্দিনের অনুবাদে যা দাঁড়ায়, "[কবি] যদি তাঁর ভাষায় ইতরবাচক শব্দ ব্যবহার করেন তবে অনুবাদের ভাষায় একইরকম ইতরবাচক শব্দে তার প্রকাশ ঘটতে হবে"। রাজু ভাইয়ের ভলতেয়ার সংক্রান্ত দু'টো প্রবন্ধ অনুবাদ করতে গিয়ে আমার এ ব্যাপারে বিস্তারিত পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। আগ্রহী পাঠক সেই রচনাগুলো পড়ে দেখতে পারেন।
সব লেখাতেই যে রোমান হরফের পর ইংরেজি তর্জমা দিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা যাবে, এমনটা ভাবা ভুল। রাজনৈতিক বাস্তবতা-এর ক্ষেত্রে সবকিছু আমাদের অনুকূলে ছিল বিধায় আমরা এমন কৌশল খাটিয়েছি। শওকত আলীর শুন হে লখিন্দর গল্পটি আবার সংলাপ সর্বস্ব। সেখানে সাঁওতালী ভাষার ব্যবহার হয়েছে। সেখানেও আমি রাজনৈতিক বাস্তবতা-এর মতই স্থানীয় লোকদের শলাপরামর্শের উপর নির্ভর করব। কিন্তু অনুবাদের ক্ষেত্রে ফের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সেক্ষেত্রে যে এই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করব, তা নাও হতে পারে। তবে রামা'দার সাথে এই কর্মঅভিজ্ঞতা আমাকে ভবিষ্যতের অন্যান্য জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট অনুবাদের জন্য প্রস্তুত করছে।
বিডি আর্টস: রামাদার একটি উপমা দিয়ে অনুবাদ প্রসঙ্গে আপনাদের দুজনকেই শেষ প্রশ্নটি করতে চাই। রামাদা বলেছেন: I am translating Shahidul Zahir's novel "Mukher Dike Dekhi" now. With him, it's as if i am his doppelgänger. আর শাহরোজা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন: Whether we gain (whose gain?) or lose something in translation, it surely democratizes literature. আপনারা দুজনেই doppelgänger এবং democratizes literature—এই দুটো ধারণাকে একটু ব্যাখ্যা বলবেন কি?
রামস্বামী: এটা আমার প্রবৃত্তির ব্যাপার বলতে পারেন! তাছাড়া, কল্পনা এবং আবেগের দিক থেকে আমাকে কিছুটা 'extreme' ধরণের মানুষ বলতে পারেন। আর শহীদুলের লেখা আমি যখন অনুবাদ করি, আমি লেখক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, ওনার চিন্তা, ওনার মানসিকতায় – ওনার আত্মায় – পৌঁছনোর চেষ্টা করি, প্রত্যেকটি শব্দ এবং বাক্য মাইক্রোস্কোপিক্যালি পর্যবেক্ষণ করি। ওনার ছায়া হয়ে যাই, ইংরেজি ভাষায় ছায়া।
শাহরোজার কথার সঙ্গে আমি ১০০% একমত। বৈচিত্র্যের, বহুত্বের – এবং বৈষম্যেরও – পৃথিবীতে, যোগাযোগ এবং সমঝোতা আনার কাজ করে অনুবাদ, একটি নতুন মানসিকতার, নতুন মানবের উদ্দেশ্যে।
শাহরোজা: কথাটা আমি ডেভিড ডেমরশের (David Damrosch) বহুল আলোচিত প্রবন্ধ "হোয়াট ইজ ওয়ার্ল্ড লিটারেচার?"-কে ইঙ্গিত করে বলেছি। সেখানে ডেমরশ বার বার দাবি করেছেন যে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য কিছু খুইয়ে ফেলে না বরং অর্জন করে। কিন্তু সেই অর্জনটা কার, মূল না লক্ষ্য ভাষার, এ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক আছে। এই অর্জনের ধারণার পেছনে একটা রাজনীতিও আছে। আমি সেই তত্ত্ব ও বিতর্কের মারপ্যাঁচে না গিয়ে বলতে চেয়েছি যে, আমার মতে, অনুবাদ সাহিত্যকে সর্বজনীন করে তোলে। সবার আয়ত্তের মধ্যে এনে দেয়।
ভি রামস্বামী ১৯৬০ সালের ২৮ আগস্ট ভারতের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশুনা করেছেন কোলকাতা এবং দেরাদুনে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পোস্টগ্রাজুয়েট করেছেন।
রামস্বামী ইতিমধ্যে সুবিমল মিশ্র'র গল্প ও উপন্যাস অনুবাদ করেছেন: The Golden Gandhi Statue from America and Wild Animals Prohibited, and This Could Have Become Ramayan Chamar's Tale: Two Anti-Novels. এছাড়া মনোরঞ্জন বেপারীর The Runaway Boy উপন্যাস, অধীর বিশ্বাসের Memories of Arrival: A Voice from the Margins নামক উপন্যাস এবং মশিউল আলমের Pakistan উপন্যাসসহ শহীদুল জহিরের দুটি উপন্যাস ও বেশ কিছু গল্প অনুবাদ করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি অনুবাদের জন্য Literature Across Frontiers পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ বছরই অর্জন করেছেন Translation Fellowship of the New India Foundation নামের ফেলোশিপ।
শাহরোজা নাহরিন ১৯৯৫ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের উপর স্নাতক করেছেন। বর্তমানে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন। গবেষণার বিষয় শহীদুল জহির ও পুরান ঢাকা। শাহরোজা নাহরিন শহীদুল জহিরের পাশাপাশি আনোয়ারা সৈয়দ হক ও ঝর্না রহমানের গল্প অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে শওকত আলীর ছোটগল্প অনুবাদ করছেন, অচিরেই তা বিদেশি একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হবে।