যতীন সরকারের ত্রিকালদর্শী গ্রন্থ: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন

যতীন সরকার বলেন, ‘জালাল খাঁর রচনায় ছিল বিদ্রোহী চেতনার স্পষ্ট অভিব্যক্তি।’

লীনা দিলরুবালীনা দিলরুবা
Published : 8 March 2023, 04:50 PM
Updated : 8 March 2023, 04:50 PM

এক.

দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের প্রপঞ্চের চূড়ান্ত পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় পাকিস্তানের, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটে, পৃথিবীর বুকে নাম লেখায় স্বাধীন বাংলাদেশ।

যতীন সরকার ইতিহাসের পরম্পরা ঘেঁটে বাংলাদেশের এই জন্মপ্রক্রিয়া ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ বইতে লেখার প্রয়াস পেয়েছেন। নতুনপথ অনুসন্ধানে সমাজ-রাষ্ট্রে যাঁর যে-ভূমিকা ছিল তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে তাঁকে সে-স্থানে চিহ্নিত করতে ব্রতী হয়েছেন। কোনো উচ্ছ্বাস নয়, কিংবা নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শকে আশ্রয় করেও নয়, চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের ওপর নির্মোহতার আলো ফেলাই ছিল তাঁর বিবেচ্য বিষয়।

গ্রন্থটি আত্মজৈবনিক, এর অন্যতম আকর্ষণ যতীন সরকার নামের মানুষটির কার্যকলাপের মধ্যে নিহিত। তাঁর জীবনটাই ছিল সংগ্রামের। বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর অবিচল থাকার অদম্য আকাঙ্ক্ষার তুলনা নেই। ভীরুতার জাল কখনো তাঁকে বাঁধতে পারে নি, এই মানবিক মানুষটির জীবনের গল্প ইতিহাসের স্পষ্ট-অস্পষ্ট ঘটনাবলীর সঙ্গে মিশে বইটিকে অভিনব উচ্চতা দান করেছে।

এদেশে ধর্মসম্প্রদায়কে জাতি হিসেবে পরিচয় দেবার বিষয়টি ছিল এক মানবিক বিপর্যয়। এই অনিষ্টসাধনে ইন্ধনদাতা রূপে শাসকদল কীভাবে কাজ করেছে যতীন সরকার বইতে সেটি সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক সমাজ হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের আচার এবং বিশ্বাসের অস্ত্রকে পুঁজি করে যুদ্ধংদেহী হয়ে যায়। হিন্দুরা হয়ে পড়ে নিজ বাসভূমে পরবাসী। এর জের ধরে উনিশশো সাতচল্লিশের পর স্বদেশ থেকে তাঁরা দেশান্তরি হতে আরম্ভ করে। ধর্মমত্ততা আর যুক্তিবোধের অভাব মানুষকে অন্ধ করে তোলে, এর ফায়দা লোটে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা।

‘পাকিস্তানের সংস্কৃতি’ বলে যে কিম্ভূত বিষয়টিকে জনসাধারণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় যতীন সরকার মনে-প্রাণে এর বিরোধিতা করে বহুজাতিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বহু-সংস্কৃতির অস্তিত্বকে শিরোধার্য মনে করতেন। তিনি জীবনভর ‘লোকায়ত দর্শনের’ চর্চা করেছেন। এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে এই আত্মজৈবনিক ঐতিহাসিক গ্রন্থে যতীন সরকার দেখিয়েছেন-- হিন্দু সমাজের অযৌক্তিক বাবু কালচারের কারণে বর্ণহিন্দু এবং তফসিলিদের বিভেদ কতোটা গাঢ় ছিল। আচারসর্বস্ব জাতপাতের শূন্যগর্ভতা একই ধর্মের মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছিল তা উন্মোচন করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি।

তাঁর অনুধাবনে মূলত পাকিস্তানের জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে হিন্দুরা দুইভাবে জড়িয়ে ছিল-- প্রথমত, হিন্দুদের অনুদারতা বা রক্ষণশীলতার কারণে দ্বিজাতিতত্ত্ব শক্ত ভিত্তি গাড়ে এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়, অন্যদিকে তাদের রক্ষণশীলতার দেয়াল ভাঙাই পাকিস্তানের মৃত্যুকে তরান্বিত করেছিল।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের দর্শন তথা অপদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একাত্তরেও পাক হানাদার বাহিনী আলাদাভাবে হিন্দুদেরকে পাকিস্তানের দুশমন বলে চিহ্নিত করে এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করে তাঁদের জীবন বিপন্ন করে তোলে। 'মাইনোরিটি কমপ্লেক্সে' ভুগে একসময় হিন্দুদের মানসিক স্বাস্থ্যই নষ্ট হয়ে যায়, এর ফলে বঙ্গভাষী ও বঙ্গসংস্কৃতিতে যে লোকায়ত ঐতিহ্য অন্তঃশীল ছিল সেখানে বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে।

দুই.

বইটি আত্মজৈবনিক হলেও ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু- দর্শন’ গ্রন্থের লেখক এতে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। বইয়ের চরিত্রগুলো বহুমাত্রিক, এরা বেশিরভাগই ময়মনসিংহ এবং পূর্ব-ময়মনসিংহ অঞ্চলের অধিবাসী।

কৃষক-প্রজা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদ করে লেখালেখি করতেন মুজিবুর রহমান ফুলপুরী, তিনি এবং তাঁর মত মানুষেরা বইয়ের নায়কের রূপ পরিগ্রহ করেছেন।

বলা যায় নেত্রকোনার ‘দলপা’ ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সোনাফর মাস্টারের কথাও, মুসলিম লীগ করেও যাঁর মন ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোয় আলোকিত, তাঁকে ঘিরে এলাকায় ঘটতো ব্যতিক্রমধর্মী সব ঘটনা। গ্রামের হিন্দুরা নির্বিচারে ন্যায়বিচারের জন্য সোনাফর মাস্টারের কাছে ভরসা পেত।

বইতে আছে বরিশালের বানারিপাড়ার অক্ষয় কুমার কাহালির কথাও। গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে লেখাপড়া শেখাতে জামালপুরের কাপাসাটিয়ায় এসে তিনি স্কুল খুলেন। অক্ষয় কুমার কাহালির ছাত্র নাসির সরকার, কংগ্রেস-রাজনীতিতে জড়িত সাহসী ব্যক্তিটি ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটান। লেখকের মতে, মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' না বলে 'জয় হিন্দ' শ্লোগান তোলা সহজ বিষয় ছিল না। প্রথম জীবনে ধর্মপরায়ণ এবং একমুখী চিন্তা-চেতনার ধারক নাসির সরকার পরবর্তীতে হয়ে পড়েন অসাম্প্রদায়িক ভাবনার প্রতিভূ।

যতীন সরকার লিখেছেন ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজের বাংলার শিক্ষক গোলাম সামদানী কোরায়শীর কথা, একজন মাওলানা হয়েও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে একসময় যিনি নাস্তিক্যবাদে ঝুঁকে পড়েন। জড়িত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবিরের সঙ্গে।

তবে এই বইয়ের মূল নায়ক সম্ভবত কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম এবং তাঁর পিতা বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ।

অজাতশত্রু খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম বা যতীন সরকারের 'হেকিম ভাই’ যেন তাঁর সহোদরপ্রতিম সুহৃদ। দু’জনার মধ্যে পরিচয় ঘটে পঞ্চাশ সালের দিকে যে সময়টায় যতীন সরকার ছিলেন নিতান্তই বালক। প্রথম জীবনে তমুদ্দিন মজলিসের চেতনাসমৃদ্ধ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও একসময় পাকিস্তানি জঙ্গী শাসকদের জংলী আইনের ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম প্রগতিশীল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পঞ্চাশের দশকেই তিনি কবি হিসেবে পুরোপুরি সক্রিয়। কবি পরিচয়ের পাশাপাশি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম সমাজসেবক হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন। এই অনন্য মানুষটি ছিলেন ১৯৫৪ সাল থেকে নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার আশুজিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্মলগ্ন থেকে পার্টির কেন্দুয়া শাখার সভাপতি।

এই শৈল্পিক মানুষটির নাটক মঞ্চায়নে ছিল অসীম আগ্রহ। তাঁদের গ্রামের বাড়ির সামনে ‘গোল ঘরে’ স্টেজ বেঁধে নাটক পরিবেশন করা হত। খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম বেশিরভাগ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করতেন। নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছিলেন ‘আবেহায়াৎ সাহিত্য মঞ্জিল’, যেটি গ্রামের যুবকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা জাগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘নীল কপোত’ সমালোচকদের দৃৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনা তাঁকে স্পর্শ করে। তাঁরই প্রত্যক্ষ প্রেরণায় যতীন সরকার-সহ ছাত্ররা সেদিন প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং মিছিল বের করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও তিনি নানাভাবে ভূমিকা পালন করেন। কেন্দুয়ার বসুরবাজারে--‘গাঁয়ে যেন কোনো পাকিস্তানি দালালের উদ্ভব না হয়, আইনশৃঙ্খলা যেন অবনতি না হয়, ব্যবসায়ীরা যাতে জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে, কোনো সাম্প্রদায়িকতার যেন সৃষ্টি না হয়’--এসব বিষয়কে সামনে রেখে তাঁর নেতৃত্বে 'সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়েছিল, লেখক যতীন সরকারও এই কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

যতীন সরকারের মতে, মূলত ষাটের দশকে যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে ভাবাদর্শের রাজনীতি করেছেন মূলত তাঁরাই ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামের অংশীদার হয়েছেন। কবি খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের মন ও মনন রেনেসাঁস এর-আলোয় আলোকিত ছিল। সত্য ও সুন্দরের সাধনায় মগ্ন থেকে অনড় মানুষদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

‘প্রভু তুমি আছ কোথায়, আমি কি তার খবর জানি

থাকতে নাহি পেলেম সন্ধান, দিলে কতই পেরেশানি।’ (জালাল উদ্দিন খাঁ)

আবহমান বাংলা কবিতার সনাতন ধারাটিকে প্রবহমান রেখে যাঁরা কাহিনীধর্মি, গীতিধর্মি, নাট্যধর্মি, তত্ত্বধর্মি গান-কবিতা রচনা করেছেন সেই লোকায়ত সংস্কৃতির এক ধারক এবং বাহক ছিলেন বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ।

খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের পিতা জালাল খাঁ ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকগুলোর দিকে মনোযোগী ছিলেন না। যতীন সরকার বলেন, ‘জালাল খাঁর রচনায় ছিল বিদ্রোহী চেতনার স্পষ্ট অভিব্যক্তি।’

জালাল খাঁ যে-লোকায়ত ঐতিহ্যকে সামনে রেখে যে-ভাবাদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন সেখানে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা ছিল অসংখ্য। যতীন সরকারও জালাল খাঁর গান এবং চেতনার প্রতি গভীরভাবে অনুরাগী ছিলেন। আর সবকিছু মিলিয়ে যতীন সরকারের অনুধাবনে জালাল খাঁ সাধারণ কেউ নন, যেন এক কিংবদন্তি। বস্তুতপক্ষে ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ গ্রন্থে এই দুই পিতা-পুত্রের ভাস্কর ভূমিকা এতখানি ছিল যে গ্রন্থটির প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে তাঁদের বাধা হয়নি।

তিন.

ধর্মীয় বিভাজন এবং দারিদ্রের কারণে যতীন সরকারের জীবন যেন কাটছিল সুতোর ওপর। কম্যুনিস্ট আন্দোলনসহ প্রগতিশীল নানা কর্মকাণ্ডে কর্মব্যস্ত জীবন কাটালেও এই মানুষটির সাহিত্যে অনুরক্তি ছিল অসাধারণ। একসময় পাণ্ডিত্যে পরিপূর্ণ করার মানসে ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করে এর কেবল তাত্ত্বিক নয় বরং প্রায়োগিক দর্শন তাঁর অভিষ্ট লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।

ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ ভিত্তিক পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে সামাজিক এবং রাজনৈতিক আবহ সম্পর্কে ধারণা দিতে যতীন সরকার তুলে ধরেন ১৯৬৫ সালের পরের বাস্তবতার কথা। ভুলশুদ্ধ বিবেচনা না-করে ধর্মের আফিম খেয়ে এতদিন এ-অঞ্চলের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানকে নিজেদের মিত্র ভেবে ভারতকে শত্রু মনে করেছিল, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর আস্তে আস্তে মানুষের বৃত্তাবদ্ধ মনোভাবের পরিবর্তন হয়। এই পটভূমিতেই ছেষট্টির ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত হয় শেখ মুজিবের ছয় দফা।

তিনি তুলে ধরেছেন দাঙ্গা পরিস্থিতির কথাও। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সংকট মোচনের জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অস্ত্রকে বারবার ব্যবহার করেছেন। পাকিস্তান আমলে তিনবারের দাঙ্গার স্মৃতি যতীন সরকার প্রত্যক্ষ করেন। পঞ্চাশ, বাষট্টি এবং চৌষট্টি। চৌষট্টি সালের পর সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা বিরোধী অবস্থান দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বদলে ভাষিক জাতীয়তারবোধ জাগ্রত হয়, এ-কারণে শেষোক্ত সময়ের পর পাকিস্তানের শাসকরা আর কোনো দাঙ্গা ঘটাতে সাহস পায়নি।

বস্তুতপক্ষে চৌষট্টির দাঙ্গা-বিরোধী অবস্থানই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে শক্তিশালী করে, এবং এ- চেতনাই পূর্ব-পাকিস্তানের মৃত্যু পরোয়ানা তৈরিতে ভূমিকা পালন করে।

ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায়, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি কৃত্রিমভাবে সোনার-বাংলার ওপর চেপে বসেছিল, তাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকারের ডাক ছিল সময়ের দাবী। লেখকের কুশলী কলমে উঠে এল স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তৈরির শেষ মুহূর্তগুলোর কথা। যতীন সরকার নিজে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে 'বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির' গঠন করে রাস্তায় রাস্তায় বাঙালির অধিকারের কথা বলে মানুষকে সচেতন করেছিলেন।

তিনি বলতে চান, হাজার বছরের বাংলার ভাষা সাহিত্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে চেতনায় ধারণ করে আটচল্লিশের পর ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই এখানে নতুন করে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়। এর হাত ধরেই আসে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হলে আপামর জনসাধারণ এতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তিনি সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়গুলো যেমন তুলে এনেছেন আবার একইসঙ্গে কে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, কে তা করেনি, কারা কেন মুক্তিযোদ্ধা নাম পরিচয় পেল, কারা কেন রাজাকারের রূপ পরিগ্রহ করল তার কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাজির করেছেন।

লেখকের মতে, নানা মতের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এক মতে ভিড়েছেন বটে, এদের কেউ কেউ ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন আবার কেউ ঘটনাচক্রে রাজাকার হয়েছেন। তাই তাঁর মতে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মোটাদাগে কথা বললে এর তাৎপর্য বোঝা যাবে না, এটি ছিল একটি জটিল প্রক্রিয়া। এসময় অনেকেই নানা স্বার্থবুদ্ধিতে জড়িয়ে ছিল, তাই এর শত্রুমিত্র সম্পর্কে সরল ব্যাখ্যা দিতে গেলে আত্মপ্রতারণার শিকার হতে হবে। একদিন যে কৃষক প্রত্যয় নিয়ে 'লড়কে লেঙ্গে' বলে পাকিস্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করেছে তারাই 'জয়বাংলা' বলে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটাতে জীবন পণ করে বসেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় সভা-সমিতি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সংগঠকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে যতীন সরকার শত্রুদের কাছে চিহ্নিত হয়ে পড়েন। একসময় প্রাণরক্ষার তাগিদে বাবা-মা এবং কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে নিয়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ‘বাঘমারা শরণার্থী শিবির’-এ আশ্রয় হয় তাঁদের। যদিও একমাত্র পুত্র এবং স্ত্রীকে শত্রুবেষ্টিত দেশে রেখে যেতে বাধ্য হন তিনি।

১৯৭১ সালে বিপন্ন পরিবেশে এদেশের জনসাধারণ বিপুল ক্ষতির শিকার হন, তবে হিন্দুদের ভোগান্তির মাত্রা সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। শরণার্থী শিবিরে যতীন সরকার একদিন শোনেন, জীবন রক্ষার তাগিদে তাঁর স্ত্রী-সহ শ্বশুরকূলের আত্মীয়স্বজন মুসলমান হয়ে গেছেন। বিষয়টিকে তিনি এবং তাঁর পরিবার সহজভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেন। বোধগম্য যে, তাঁদের পারিবারিক শিক্ষা এবং সুরুচির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।

বইটিতে পাকিস্তানের জন্ম এবং মৃত্যুর সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস এবং অভিঘাত বর্ণনা করে লেখক তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং দ্বিজাতিতত্ত্ব নামের এক অপতত্ত্বের মাধ্যমে জন্ম নেয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের বামপন্থী ব্যাখ্যা নিয়ে যারা স্বোচ্চার ছিলেন তাঁদের স্বরূপও বোঝার চেষ্টা করেছেন।

তিনি বর্ণনা করেন, সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের বদলে শক্তিশালী হওয়া ‘কৃষক প্রজা পার্টি’র উত্থানের নেপথ্য কাহিনি। কৃষক-প্রজাদের স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় এই দলটি কংগ্রেসের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলতে চেয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেস দলটি মূলত জমিদার-মহাজনদের স্বার্থ রক্ষায়ই মনোযোগী ছিল যার কারণে কৃষক-প্রজাদের জন্য স্বোচ্চার কৃষক-প্রজার পার্টির প্রতি তাদের কোনো সমর্থন ছিল না। যার ফলে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক-প্রজারা এই দলটির প্রতি বিমুখ হয়ে যায় এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

মানুষ স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতেই নির্যাতিত হলে নিজের ভেতরে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে, এই প্রতিরোধীবর্ম মানুষকে চরম মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তুলতে পারে। এই প্রবণতাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাই মানুষের সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টির পেছনে নানা প্রপঞ্চকে সামনে রেখে আলোচনা করলে সমস্যার স্বরূপ বুঝতে সুবিধে হয়। বইটিতে যতীন সরকার এই অঞ্চলে মানুষের সাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টির সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের একটি জরুরি কাজ সম্পাদন করেছেন।

কংগ্রেসের মতো তমুদ্দুন মজলিস নামের দলটির স্বরূপ বোঝারও তিনি চেষ্টা করেছেন। যদিও দলটি ‘যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত সর্বাঙ্গ সুন্দর ধর্মভিত্তিক সাম্যবাদের দিকে’ মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে উদ্দেশ্য বলে ঘোষণা করেছিল, কিন্তু ধর্ম বলতে একক ধর্মের স্বার্থ রক্ষাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য, ইসলাম ধর্মের কোনো র‌্যাডিকেল ব্যাখ্যাও তাঁরা হাজির করতে পারেননি। যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে পাকিস্তানের সৃষ্টি সেটিকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেননি বরং দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার দিকেই ছিল তাঁদের মনোযোগ।

অথচ বাংলা ভাষার পক্ষে এই দলটির অবস্থান ছিল প্রগতিশীল। জটিল রাজনৈতিক অভিঘাতে তমুদ্দুন মজলিশ নামের সাম্প্রদায়িক দলটি, যারা দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে পাকিস্তানপন্থী নামে পরিচিত ছিল, তারাই আবার ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরোধিতা করে। তমুদ্দিন মজলিশের সদস্যরা ভাষা আন্দোলনে স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিলেন। একারণে তাঁর মতে, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে একলাইনে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যাবে না।

এই প্রেক্ষিতে যার যা দায়, যার যা অর্জন সবই বাস্তবতার নিরিখে, সত্যের নিরিখে তুলে ধরার লেখকের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে হবে।

চার.

যতীন সরকারের আধুনিকতাপন্থী মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীয় পাকিস্তানের জন্ম আর মৃত্যু সম্পর্কিত সুবৃহৎ গ্রন্থটি ভবিষ্যদ্বাদেও সক্রিয়।

বাংলাদেশের নিয়তি নির্দেশক ভবিষ্যতের গহ্বরে লুকিয়ে ছিল যে বেদনার ইতিহাস বইয়ের শেষে তার দিকে লেখক তাৎপর্যময় ইঙ্গিত আরোপ করে বলেছেন, ‘একাত্তরে আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। এই বয়সেই ত্রিকালদর্শী হয়ে গেলাম। ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর পাকিস্তানের জন্ম দর্শন করলাম। আবার দর্শন করলাম পকিস্তানের মৃত্যু আর বাংলাদেশের জন্মও। বাংলাদেশের জন্মের ক্ষণটিতে কিন্তু মোটেই ভাবতে পারিনি যে অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশেই আমাকে পাকিস্তানের ভূত দেখতে হবে।’

তাঁর এই দেখাশোনার বিষয় আমরা প্রত্যক্ষ করব সিরিজের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘পাকিস্তানের ভূতদর্শন’ বইতে। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর নতুন করে পাকিস্তানের ভূত চেপে বসার কাহিনি। যদিও সেটি ভিন্ন এবং পরের আলোচনা।

আমরা বরং এ-লেখাটি এখানেই শেষ করি এবং ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ পুনঃ পুনঃ পাঠ করে পাকিস্তানের জন্ম আর মৃত্যুর রূপরেখা বা ইতিহাস বোঝবার চেষ্টা করি।