Published : 10 May 2024, 10:37 PM
আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে (১৮৯৮) যখন বেশ কয়েকটি উপনিবেশ খোয়াতে হয় স্পেনকে, সেই চরম হতাশার সময় নতুন এক স্পেনের জন্ম দিতে চেয়েছিলেন সে-দেশের তৎকালীন অগ্রণী কবি, নাট্যকার আর সমালোচকগণ। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন মিগুয়েল দ্য উনামুনো, আন্তোনিয়ো মাচাদোর মতো খ্যাতনামা দুই কবিও। প্রথমজন সোক্রাতেসতুল্য শিক্ষক, দ্বিতীয়জন নির্জনতাসন্ধানী। পরে আন্দোলনটি বিখ্যাত হয় ‘জেনারেশন অফ ’৯৮’ (কাছাকাছি স্পেনীয় লব্জে হয়তো-বা-- হেনেরাসিওন দেল ’৯৮!) নামে। সরকারের পুনর্গঠন প্রকল্পে আস্থা না-রেখে তাঁরা চেয়েছিলেন রাজতন্ত্রের অবসান। চেয়েছিলেন মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। সাহিত্যে খুঁজেছিলেন অতীত থেকে প্রেরণা।
কাকতালীয় হয়তো-বা, ওই একই বছরে জন্ম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রথম জীবনে সরাসরি রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার পর সাহিত্যজীবনে প্রবেশ করেও তারাশঙ্করের সৃষ্টিকর্ম দেশ আর দেশের মানুষের দুর্দশামুক্তির লক্ষ্যে সচেতন থেকে যেন তাঁর জন্মসালটিকে জুড়ে দিয়েছে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের একদল লেখক-কবির সাহিত্যিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে। উপন্যাস রচনায় ইয়োরোপীয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে তিনিও গড়তে চেয়েছেন দেশীয় অক্ষরস্থাপত্য, যার গর্ভগৃহে তাম্রপ্রদীপের শিখা সহস্র বছর ধরে অনির্বাণ জ্বলছে। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের, কিংবদন্তির, পুরাণের, প্রবাদের বহুল ব্যবহার রয়েছে তাঁর লেখায়। যে-দেশের যে-সমাজে তিনি বেড়ে উঠেছেন, তার প্রান্তবাসীদের নিশ্বাস-প্রশ্বাস সারা জীবন তাঁর গায়ে লেগে থেকেছে। শুধু গল্প-উপন্যাসেই নয়, একাধিক আত্মজৈবনিক রচনাতেও এসেছে সেসব প্রসঙ্গ। সংবাদপত্রে সাপ্তাহিক স্তম্ভ যখন লিখেছেন, তখনও তাঁর লেখার বিষয় হয়েছে সেই গ্রাম, সেই প্রান্তজন।
১৯৬৩ সালের জুলাই থেকে ১৯৬৮-র মে মাস পর্যন্ত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘যুগান্তর’-এ প্রায় টানা লিখেছিলেন ‘গ্রামের চিঠি’ (করুণা প্রকাশনী, কলকাতা ৯। ৮০০ টাকা)। সেইসব চিঠিতে গ্রামের আপাততুচ্ছ কথাগুলো যে-সময় লিখে যাচ্ছিলেন, লেখক হিসেবে তাঁর অবস্থানটি তখন কেমন?
তার বহু আগের থেকেই (১৯৩৩) তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতাবাসী। ক্রমে বাংলা সাহিত্যে শুধু নয়, ভারতীয় সাহিত্যে প্রথিতযশা এক ঔপন্যাসিক তথা গদ্যলেখক। সরকারি আমন্ত্রণে চীন ঘুরে এসেছেন, তাসখন্দে আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হয়েছেন এবং পদ্মশ্রী-ভূষিতও। তদুপরি, ‘গ্রামের চিঠি’ লেখার পর্বে জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে সম্মানিত। ভাববার যে, এ হেন এক খ্যাতনামা লেখক এইসব চিঠিতে যে-সব গ্রামীণ সমস্যার খুঁটিনাটি বিবরণ আর ব্যাখ্যা-- গ্রামবাসীরই বয়ানে-- দিয়েছেন, আশা-হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন, সে-সব কথা তাঁর তৎকালীন নাগরিক চতুস্পার্শ্বে, ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ বইয়ের ‘রাজায় রাজায়’ প্রবন্ধে বিষ্ণু দে যাঁদের ‘লেজিসলেটরস অব লিটরেচর’ বলেছেন, তাঁদের প্রকট অবস্থিতি সত্ত্বেও দিনের পর দিন লিখে গেছেন কী করে! এই বিস্ময় থেকে জানা দরকারি হয়ে পড়ে গ্রামের সঙ্গে তারাশঙ্করের সম্পর্কের বাঁধনটিকে।
তাঁর ধাত্রীদেবী
তাঁর সমসাময়িক এক কবি, মাত্র এক বছরের ছোটো, জীবনানন্দ দাশও গত শতকে প্রায় একই সময়ে শুনেছিলেন ‘গ্রামপতনের শব্দ’। অবশ্য, দু-জনের গ্রাম ছিল চরিত্রে যতটা ভিন্ন, দেখার চোখের পার্থক্য ছিল আরও বেশি। জীবনানন্দ দাশের গ্রাম অনিঃশেষ ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। হয়তো-বা সে-গ্রাম ভেঙেই গেছে। ‘রূপসী বাংলা’য় তিনি গ্রামকে তাই যেন-বা শেষ বারের মতো ধরে রাখবার চেষ্টা করেছেন। ‘পৃথিবীলোক’ কবিতার শুরুতেই লিখেছেন— ‘দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙে;’। এবং মাত্র বারো পঙক্তির কবিতাটি পড়া শেষ হলে আমাদের আবছা কাচে ফুটে উঠতে দেখি ‘মরুভূমি ঘিরে/বিচিত্র বৃক্ষের শব্দে স্নিগ্ধ এক দেশ’। অর্থাৎ, তাঁর গ্রাম তত দিনে স্মৃতিকণিকা হয়ে স্ফটিকে আঁকা প্রতীক মাত্র। পরে দেশ ভাগ হলে তাঁর কবিতায় সেই আঁকা-প্রতীকই পেয়ে যায় একধরণের নিষ্ঠুর স্বীকৃতি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রামও আমরা দেখেছি। তাঁর বহু-আলোচিত উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-য় শশীর মস্তিষ্কে ইয়োরোপীয় তত্ত্ব এবং চর্চাতরঙ্গ এমনই ক্রিয়াশীল যে, গ্রামে ফিরে হাজারো গ্রন্থিতে নিজেকে বাঁধবার চেষ্টা সত্ত্বেও ডাক্তার ভদ্রলোকটি শেষ পর্যন্ত সেই মানুষ, যাকে তার স্বগোত্রীয়রাই পরে বলব, এলিয়েনেটেড। অবশ্য কর্তব্যপরায়ণ ডাক্তার রিওর প্রসঙ্গও এসে পড়বে। কিন্তু প্লেগাক্রান্ত এবং ভয়ার্ত ওরান শহরটি যেমন অতিকায় জন্তুর মতো নিশ্বাস ফেলেছে পাঠকের শরীরে-মনে, তুলনায় গাওদিয়া (কোনো কাল্পনিক নাম নয়। বিক্রমপুরের এই ছোট্ট গ্রামেই তাঁর মামাবাড়ি এবং কাছের মালপদিয়ায় পৈত্রিক বাড়ি হলেও গ্রামে থাকার যে-টুকু অভিজ্ঞতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের, এই গাওদিয়ায়, মামাবাড়িতে।) যেন হাতে-আঁকা এক পট মাত্র। সংলাপও কলকাতার আশপাশের গ্রাম্যজনের কথ্য ভাষানির্ভর, যা অংশত লেখক-উদ্ভাবিত। গাওদিয়ার ভাষা নয়। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বা অন্য লেখার প্রসঙ্গ এখানে টানছি না।
আর, বিভূতিভূষণ। বন্দ্যোপাধ্যায়। সবুজে দারিদ্রে নারকোল-মুড়িতে ধানখেতে ঝড়-বৃষ্টিতে মৃত্যুতে স্মৃতিরঙে তাঁর গ্রাম বর্ণিল। সে-গ্রাম একটু একটু করে নীরবে মরে যাচ্ছে। দ্বন্দ্বহীন এক অপূর্ব চলচ্ছবি যেন। চোখে জল এসে আমাদের আচ্ছন্ন করে দেয় এবং গ্রামটিকে আবছা। আর, গ্রামটিও চলে যায় ফেলে-আসা জগতে। যেন-বা অতীত। বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে দোটানায়-পড়া শহরমনস্ক মানুষের কাছে যেটি হয়তো-বা কাঙ্ক্ষিত ছিল।
তারাশঙ্করের গ্রাম তারাশঙ্করেরই মতো বড্ড বেয়াড়া। জেদিও। ভাঙবে, মচকাবে না। অবিরাম বহির্পৃথিবীর সঙ্গে তার সঙ্ঘর্ষ। অবিরাম সে শোষিত হচ্ছে। এই শোষণ বহুবিধ। অন্তত দুটিকে সহজেই সনাক্ত করা যায়— (এক) গ্রামের ক্ষমতাশালী সমাজের এবং (দুই) বাইরের প্রবল প্রতাপান্বিত মূর্ত আর বিমূর্ত শক্তির শোষণ। অথচ, হাজার বছরের অভ্যাসগুণে এইসব শোষণের কলাকৌশল এবং তার জটিল ফাঁকফোকর থেকে সে-গ্রাম অর্জনও করতে জানে বেঁচে থাকার ন্যূনতম রসদটুকু। তারাশঙ্করের গ্রাম তাই টিকে থাকতে পারে। শত আক্রমণের পরও। শত মন্বন্তরের পরও। দ্বিতীয়ত, তারাশঙ্কর শুধুমাত্র গ্রামেরই সন্তান নন। সর্বক্ষণের লেখক হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি গ্রামের টিকে-থাকার এবং তার প্রাণশক্তি বাড়ানোর কাজে ছিলেন সক্রিয় কর্মী। তরুণবয়স পর্যন্ত দেশের কাজ আর সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রথমটিই ছিল তাঁর কাছে বেশি জরুরি। বাংলাভাষায় এমন লেখক বিরল নয় কি!
তাঁর মৃত্যুর পর ছেচল্লিশ বছর কেটে গেছে। তারাশঙ্করের সেই জন্মভূমি লাভপুর আছে আজও। কিন্তু এখনকার লাভপুরকে আর গ্রাম বলা যাবে না। ‘গণদেবতা’ (১৯৪০/৪১ সালে লেখা) উপন্যাসে একদিন এমনই এক গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়ার অপরাধে বিচারসভা বসেছিল অনিরুদ্ধ কর্মকারকে শাস্তি দিতে। আজ সেই গ্রাম নিজেই এক শহরের আদল পেতে চলেছে। তারাশঙ্কর পড়বার পর আচমকা সেখানে পৌঁছে গেলে মনে হতে পারে, পরাজিত এক জনপদ যেন-বা। দ্বন্দ্বের অন্তিম পর্বে শহরের বিরুদ্ধে সে হেরে গেছে। আদপে তেমনটা যে নয়, একটু ঘুরলেই বোঝা যায়। তখন দেখা যাবে, দুই শক্তির দ্বন্দ্ব আজও ক্রিয়াশীল। এক, যে-গ্রামটি শহরে রূপান্তরিত হয়েছে বা হতে চলেছে, তার শত শত বছরের আত্মশক্তির ক্রিয়া। দুই, চারপাশ জুড়ে নানা গ্রাম-সন্নিবেশের চাপ। ফলে শহরের ভেতর টিকে-থাকা আদ্যিকালের গ্রামটিকে আজও সনাক্ত করা যায় সহজেই।
সাহিত্যজীবন বেছে নেওয়ার পর কলকাতায় এসে তারাশঙ্করের বেলায় কী ঘটেছিল? এ-প্রসঙ্গে সেই পুরোনো কথাটিই ফিরিয়ে আনা যায়: যার যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে, তার ভালোবাসা একটিমাত্র ভূমিতে। যে আরও কিছু দূর এগিয়েছে, তার ভালোবাসা সব ভূমিতে। আর যে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে, সে ধ্বংস করতে পেরেছে সব পিছুটান।
কিন্তু তারাশঙ্করের লেখকসত্তা গন্তব্যে পৌছলেও, মানুষ তারাশঙ্কর আজীবন ছিলেন প্রথম স্তরেই। কলকাতায় বসবাস করলেও, জন্মভূমি ছেড়ে এসে নির্বাসিতের জীবনভাবনায় মুহূর্তের জন্যেও আক্রান্ত হননি। জয়েস যেমন নিজেকে নির্বাসিত ভেবে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন এবং সে-সম্পর্ক টিকিয়েও রেখেছিলেন নিজের লেখকসত্তাকে জিইয়ে রাখতে, বিপরীতে তারাশঙ্কর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন লাভপুরেরই সন্তান। এবং নিজের সৃষ্টিশীলতাকে জিইয়ে রাখতেই।
এবার আমরা চিঠিগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখব।
সবিনয় নিবেদনমেতৎ
প্রায় পাঁচ বছর লেখার পর যুগান্তরে শেষ চিঠি ছাপা হয় ১৯৬৮-র মে মাসে। মোট চিঠির সংখ্যা ২৩২। এবং চিঠিগুলোর কোনোটিই স্বল্পায়তনের নয়। হিসেব কষলে ঠিক পঞ্চাশ বছর পর ‘গ্রামের চিঠি’-র পূর্ণাঙ্গ রূপটি এই প্রথম প্রকাশ পেল। দীর্ঘ এগারো পৃষ্ঠাব্যাপী অতি-দরকারি ভুমিকার একাংশে সংকলক অভ্র ঘোষ লিখছেন, ‘এই চিঠিগুলিতে স্বাধীনতা-প্রাপ্তির পনেরো-ষোলো বছর পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের বিশ্লেষণ, চাষবাস-জলবায়ু সেচব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বিবরণ, গ্রামের লোক-উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান, ব্রতপার্বণপূজা, গ্রামীণ মেলার বিশদ বিশ্লেষণ যেমন আছে, তেমনি আছে গ্রামীণ জ্ঞাতিগোষ্ঠী, নতুন করে গড়ে ওঠা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, গ্রামীণ স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের খুঁটিনাটি কথা। আর আছে কুটিল-ক্লেদাক্ত রাজনীতির কথা।‘
প্রথম চিঠি প্রকাশের পর দ্বিতীয় চিঠিতে গুরুতর একটি অভিযোগ রয়েছে। চিঠির শুরুতেই ‘তারাশঙ্করবাবু, এটা কি হইল মহাশয়?’ অভিযোক্তা লেখকের কল্পিত বাল্যবন্ধু ছকু চাটুজ্জে। চিঠিতে ছকু চাটুজ্জে জানাচ্ছেন, দুজনের জন্মসালও এক— ১৮৯৮। একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন একই গ্রামে, একই পাড়ায়। যেন-বা একই বাড়িতে। তাঁর অভিযোগ-- লিখলেন তিনি, ছাপা হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে! এরপর সব চিঠিই যেন লিখেছেন ছকু চাটুজ্জে।
পড়তে পড়তে মনে হয়, স্তম্ভটি রচনার জন্যে লেখক তৈরি করতে চেয়েছেন তাঁর একটি যমজ সত্তা। ছকু চাটুজ্জের বয়ানে তারাশঙ্কর লিখছেন-- তারাশঙ্করের পাতাচাপা কপাল, একটু বাতাসেই উড়ে যায় আর তার নিজের কপাল পাথরচাপা। না হলে একই সঙ্গে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেও সে কেন পড়ে আছে অজ পাড়াগাঁয়ে আর তারাশঙ্কর আজ দেশবরেণ্য?
লেখকের এই যে দ্বৈত সত্তা-- প্রায় যমজের মতো-- তৈরির দরকার হল কেন? ততদিনে তিনি বহু বছরের কলকাতাবাসী। তবু শহরে থাকলেও, নিজের গ্রামের— প্রায় বর্মের মতো— রুক্ষ প্রান্তরবেষ্টিত হয়েই ছিলেন, যে-গ্রাম তাঁকে হাজারো সমস্যায় মায়ায় দ্বন্দ্বে বিচলিত করত। তবে কি কোনো দুর্বলতম মুহূর্তে সেই বর্মের প্রতি তিলমাত্র সংশয় জন্মেছিল তাঁর?
একজন ভারতবিখ্যাত লেখক, অন্যজন বীরভূমের এক পাড়াগাঁয়ের সন্তান। এই প্রথম নিজেকে এভাবে দ্বিখণ্ড করলেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকার একটি বিখ্যাত মিথের প্রসঙ্গ এসে যায়, যেটি বহু হাত ঘুরে ষোড়শ শতকে খ্রিস্টান সন্ন্যাসী আঁদ্রে থেবের কাছে পৌছেছিল। আমি শুধু মিথটি এখানে লিপিবদ্ধ করব।
এক তরুণী যাচ্ছিল তার হবু স্বামীর কাছে, যিনি দেবতা। রাস্তায় জনৈক কুচক্রী তাকে বোঝায়, যার উদ্দেশে মেয়েটি যাচ্ছে, সে-ই তার পতিদেবতা। মেয়েটি বিশ্বাস করে। তারা মিলিত হয়। পরে তরুণীটি প্রকৃত দেবতার দেখা পায়। সন্তানসম্ভবাও হয়। এবং জন্ম দেয় যমজ পুত্রের। একটি কুচক্রীর, অন্যটি দেবতার ঔরসজাত। এক পুত্র স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের পক্ষে, অন্যজন ইয়োরোপীয়দের।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর গ্রাম এবং শহর— এই তিনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে সমস্ত তর্ক বহু দিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। তবু মিথটির উল্লেখ করলাম কেন?
শুধু এটুকু বলতে পারি— এখানে এক সত্তা গ্রামের (ইন্ডিয়ানদের) দুঃখ বঞ্চনা ক্লেদ ব্যক্ত করছেন, অন্য সত্তা খ্যাতনামা হওয়ার সুবাদে সেইসব নিপীড়নের কথা কলকাতার শিক্ষিত মানুষজনের (ইয়োরোপীয়দের) কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন, যাতে অন্তত কোনো কোনো বিষয়ের প্রতিকার হয়।
ওই মিথই জানাচ্ছে, সেখানকার ইন্ডিয়ানদের বিশ্বাস-- প্রাকৃতিক বা অন্য দুর্যোগ যমজরা থামিয়ে দিতে পারে।
আখ্যান নয়। তাই কি তিনি স্বসৃষ্ট ছকু চাটুজ্জে-নামের যমজ সত্তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন এইসব চিঠি? তবে, প্রথমে ছকু চাটুজ্জের প্রসঙ্গ টানলেও তাঁর মতো তেজস্বী পুরুষের পক্ষে এই ছদ্মাবরণী ফাঁসিয়ে দিতে কতক্ষণ! মাঝে মাঝেই ছকু চাটুজ্জেকে সরিয়ে নিজে হাজির হয়ে গেছেন। যেমন ১৯৭ সংখ্যক চিঠিতে নকশালবাড়ির কৃষকদের ন্যায্য দাবির সমর্থন করে তিনি লিখছেন— ‘এই বঞ্চনা, এই অন্যায় যে কত বড় মর্মান্তিক তার ছবি আমার কালিন্দী উপন্যাসে ১৯৪১/৪২ সালে চিত্রিত করেছিলাম।‘
গ্রামের চিঠি’ লেখার সময় দুটি সত্তা নির্মাণ করে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার গ্রামের কষ্ট লাঘব করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা, জানি না। তবে তিনি সারা জীবনের রচনাকর্মে বীরভূমকে, বীরভূমের গ্রামকে, যে-উচ্চতায় তুলে ধরেছেন, সেটি ময়দানবেরই কাজ। আর সেটা করতে গিয়ে বেপরোয়া ব্যবহার করেছেন আঞ্চলিক শব্দ। প্রবাদ-প্রবচন।
লঙ সাহেবের সুইটজারল্যান্ড
রেভারেন্ড জেমস লঙের একটি পুস্তিকার নাম— ‘দি গ্রান্ড ট্র্যাংক রোড, ইটস লোকালিটিস’। উনিশ শতকের মাঝামাঝি লঙ সাহেব ‘বাংলার সুইটজারল্যান্ড’ বীরভূম সম্বন্ধে লিখেছিলেন— ‘পাহাড় ও উপত্যকা, জঙ্গল ও নদী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশটি ভূতত্ত্ববিদ ও সৌন্দর্যবিলাসী উভয়ের কাছেই আকর্ষণীয়।‘
বীরভূম। অজয়ের সেতু পেরিয়ে যে-রেলপথটি সিধে উত্তর-বরাবর গিয়ে রাজগ্রামের পর ঢুকেছিল তৎকালীন সাঁওতাল পরগনার ওই ভূখণ্ডের ল্যান্ডমার্ক পাকুড়ে, যে-রেলপথটিকে বলা হত সাহেবগঞ্জ লুপ লাইন, সেটি যেন বীরভূমের শিরদাঁড়া। ডবল লাইন হওয়ার পর আজও। মনুষ্যকৃত সীমা ধরিত্রীকে পৃথক করতে পারে না যদিও, তবু বলা যায়-- রেললাইনের পশ্চিমদিকের ভূতল ছোটোনাগপুর মালভূমির শেষ পুর্বপ্রান্ত আর পুবদিকের মাটি ক্রমশ নামতে শুরু করেছে ভাগীরথীর দিকে। এবং নদী পেরিয়ে ঢাল হয়ে চলে গেছে আরও পুবে। উঠেছে দূর সিলেট-ত্রিপুরা অঞ্চলে। এই ঢাল-অঞ্চলটি বাটির মতো, যা ভূতত্ত্ববিদদের পরিভাষায়— বেঙ্গল বেসিন।
পশ্চিমের মাটি লাল, পাথুরে, উচ্চাবচ। দক্ষিণ আর মধ্য ভারতের ভূ-গুণান্বিত। পুবের মাটি মূলত নাবাল, দোআঁশ, ঊর্বরা। মাটি যেমন আলাদা, দু-দিকের গ্রামগুলোর চরিত্রেও রয়েছে চোখে পড়ার মতো পার্থক্য।
কেমন সে-পার্থক্য?
পশ্চিমের গ্রামগুলো তুলনায় ছোটো-ছোটো। হতে পারে, ঢেউখেলানো উষর জমির যেখানেই একটু নীচু এবং সেচের সুবিধেযুক্ত আবাদযোগ্য জমি পেয়েছে, ছোটো-ছোটো সেইসব জোল জমির পাশেই অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে বসতি গেড়েছে মানুষ। অল্প জমি বহু মানুষের অন্নসংস্থান করতে পারে না। তাই হয়তো-বা গ্রামগুলো ছোটো। স্ব্য়ংসম্পূর্ণ নয়। কৃষিভিত্তিক সমাজের সমস্ত চাহিদা সেখানে মেটে না। মোটা রকমে বলতে গেলে-- পেশানির্দিষ্ট গ্রামসমাজে দরকার ব্রাহ্মণ যেমন, তেমনই চাষা কামার ছুতোর মুচি ধোপা বারুই কুমোর ডোম শুঁড়ি বেনে কৈবর্ত কুলু নাপিত চাই হাতের নাগালে। রেললাইনের পশ্চিমের মানুষদের এসবের জন্যে আজও যেতে হয় গ্রামান্তরে। এমনই গ্রামসমাজে,—এখানে একটু বলতেই হয়— শুধু বীরভূমেই নয়, সারা বাংলায়, আটশো বছর ধরে একটু-একটু করে প্রাচীন সমাজের কাঠামো বদলে জায়গা করে নিয়েছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা, মুসলমান নামে যারা পরিচিত। আপাতভাবে মনে হতে পারে, এদের কোনো সমাজনির্দিষ্ট পেশা নেই। একটু তলিয়ে খোঁজখবর করলেই জানা যায়, তিন ভাবে সেটা নড়বড়ে হয়ে আজও টিকে থাকলেও ক্রমশ আবছা হচ্ছে। এক. ছ-শো বছরের— অর্থাৎ অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত— রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অংশ ছিল যারা, তাদের আজও চেনা যায়। মির, মুন্সি, সিকদার, বক্সি, হাওলাদার এবং আর দু-চারটে পদবির লোকজন এরা। দুই. ভূস্বামী বা জমিদাররা চৌধুরী, খানচৌধুরী, মজুমদার, তালুকদার, সরকার, খোন্দকার ইত্যাদি। তিন. রইল বাকি নীচের শ্রেণী, যারা কোনো-না-কোনো ভাবে কায়িক শ্রমে নিযুক্ত। যেমন হালদার, লস্কর— এরা। এদের সবার মাথার ওপর রয়েছে দু-চার ঘর প্রকৃত এবং অসংখ্য নকল সৈয়দকুল।
পুবের গ্রামগুলি চরিত্রে আলাদা। সেখানে অধিকাংশ গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ। বছর পঞ্চাশ আগেও কোনো আদর্শ গ্রাম বোঝাতে লোকে বলত, ওটা আঠারো পাড়ার গ্রাম। কেউ হয়তো গুনেও দেখেনি, তবু পূর্ণাঙ্গ একটা গ্রামের ছবি ফুটিয়ে তুলতে ওই আঠারো পাড়ার কথা আসত। কেন আঠারো, জানা যায় না। এবং পাড়াগুলোর নামও হত— এখনও তেমনই রয়ে গেছে কোথাও— জাত-নির্ভর বা পেশানির্ভর। বামুনপাড়া, পাঠানপাড়া, চাষাপাড়া, কুলুপাড়া, শুঁড়িপাড়া, কুমোরপাড়া, বায়েনপাড়া, ডোমপাড়া, কামারপাড়া ইত্যাদি। স্বভাবতই গ্রামগুলো বেশ বড়ো। উদাহরণ হাতের কাছেই আছে। এ-বাংলার সবচেয়ে বড়ো গ্রাম সম্ভবত বীরভূমের উত্তর প্রান্তের মাড়গ্রাম। সত্তরের দশকে এক পরিসংখ্যানে দেখেছিলাম, তখনই গ্রামটিতে চোদ্দোটি প্রাইমারি স্কুল ছিল। অতোটা না-হলেও আহম্মদপুর-কাটোয়া মিটারগেজ লাইনে ঘোরার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা জানেন গ্রামগুলোর আয়তন।
এমনই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের বর্ণনা তারাশঙ্করের উপন্যাসে, গল্পে রয়েছে। এইসব গল্প-উপন্যাসই তাঁর স্বক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রটি কেমন?
১৯৩০ সালের ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পাবার আগের রাতে রাজনৈতিক বন্দিদের এক বিদায়সভায় যখন সভাপতি শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন— ‘পুনরাগমনায় চ’, উত্তরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনের পথ থেকে আমি আজ বিদায় নিচ্ছি। এ পথে নয়— আমি সাহিত্যের পথে এই যুদ্ধ আর মাতৃভূমির সেবা করে যাব।‘ তা-ই করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রধান গল্প-উপন্যাসগুলি লেখা হয়ে গেছে ১৯৪৭-এর মধ্যেই। সেসব আখ্যানে আবহমান ভারতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ভারতের, ক্ষয়িষ্ণু সামন্তযুগের সঙ্গে নব্য বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্বে-সংঘাতে স্বাধীনতা-পূর্বকালের কৌমসমাজটির দগদগে ক্ষতগুলো যেমন উজ্জ্বলতা পেয়েছে, সমাজটি সম্বন্ধে শিকড়প্রসারী জ্ঞান, অন্তরের যোগ এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য না-থাকলে তেমনটি হওয়া সম্ভব ছিল না।
সেসব ছিল আখ্যান। ‘গ্রামের চিঠি’কে আখ্যান বলা যাবে না। এ একেবারে সরাসরি গাঁয়ের কথা। যেন গ্রাম এখানে নিজেই নিজের কষ্ট-বঞ্চনার কথা বলছে। বলছে তার আশাভঙ্গের কথা। আর তার নিজস্ব সংস্কৃতির গৌরবকথা, যা নষ্ট হতে বসেছে। কখন বলছে? কোন সময়ের? স্বাধীনতা-উত্তরকালের।
বড়ো স্বপ্ন আর আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার লড়াই, যার সৈনিক ছিলেন তারাশঙ্করও। কিন্তু সেই আন্দোলনেই নেতা-কর্মীদের খেয়োখেয়ি দেখে বিরক্ত হয়ে ‘আমার সাহিত্য জীবন’এ লিখছেন— ‘আত্মাই যদি কলুষিত হয় তবে স্বাধীনতার মধ্যে কী পাব আমি? বন্ধনমুক্ত জীবনে কোন্ আত্মার বিকাশ হবে— প্রকাশ হবে? সবথেকে পীড়িত হলাম আত্মকলহের কুটিল কদর্যতা দেখে।‘ ওই প্রসঙ্গের শেষে লিখছেন, ‘অ্যাসেমব্লির চেয়ার তখনও অনেক দূরে, শুধু প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভ্যপদ মাত্র সম্মুখে।‘
‘গ্রামের চিঠি’ লিখতে শুরু করেন স্বাধীনতার চোদ্দো বছর পর। মোহভঙ্গ হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সময়। এরই মধ্যে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। ফলে আরও কাছ থেকে দেখেছেন আরও বড়ো বড়ো খেয়োখেয়ি। দেখেছেন দেশীয় শাসকদের ক্ষমতার আস্ফালন, যাঁদের কণামাত্র দেশচেতনা নেই। নিজের দেশকে— যে-দেশ মূলত গ্রামনির্ভর-- তাঁরা চিনতে চেষ্টা করেননি। সেই ক্ষোভের কথা, তাঁদের ভুল পরিকল্পনার কথা লিখেছেন এইসব চিঠিতে। দেশভাগজনিত বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে তিনিও নিজের মতো করে তীরের সন্ধান করেছেন। কখনও ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পর যে-পথটি ঠিক মনে হয়েছে, নির্দ্বিধায় বাতলেছেন। আর দেখিয়েছেন তখনও পর্যন্ত টিকে থাকা আবহমান গ্রামের স্বরূপটিকে, যাকে তিনি দেখেছিলেন ভারতবর্ষের আত্মা রূপে।
যে-ভাবেই তিনি দেখুন না কেন, আমরা পেয়ে যাচ্ছি অভ্র ঘোষ-বর্ণিত ‘গ্রামের লোক-উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সামাজিক অনুষ্ঠান, ব্রতপার্বণপূজা, গ্রামীণ মেলার বিশদ বিশ্লেষণ।’ এ-সব লোকায়ত আচার-অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই আজ তুচ্ছজ্ঞানে নিশ্চিহ্ন অথবা নিষ্প্রাণ হয়ে গেলেও, অনর্ঘ হয়ে থেকে গেল এই চিঠিগুলোতে।
গ্রামের কৌমসমাজের প্রতি আর গ্রামেরই নিজস্ব পদ্ধতিতে সেই সমাজের নবরূপায়ণে আস্থা ছিল তারাশঙ্করের। এতেই তিনি দেশের মঙ্গলের পথ দেখতে পেতেন। এ-কাজে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, এমনকী কিয়দংশে মার্কসের চিন্তা ছিল তাঁর অবলম্বন। দেখা যাচ্ছে, প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে ঘোষিত ভাবে দূরে সরে এলেও তাঁর চিন্তা একদিনের জন্যেও রাজনীতিমুক্ত হতে পারেনি।
তবু বলতেই হয়, সুবৃহৎ পত্র-সংকলনটির নাম ‘গ্রামের চিঠি’ (কেননা, এই নামেই স্তম্ভটি প্রকাশিত হত যুগান্তরে।) হলেও, চিঠিগুলো নিছক গ্রামেই আবদ্ধ থাকেনি। সেই সময়ের অতি গুরুত্বপুর্ণ দলিল হতে চেয়েছে। এবং হয়েওছে।
কুড়ি শতকের ষাটের দশক নানা কারণে স্মরণীয়। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সবাই যখন আশা করেছিল, গ্রহটি এবার হয়তো-বা একটু থিতু হবে, পুঁইমাচাশোভিত উঠোনে শিশুটি হামা দিয়ে এগিয়ে যাবে কলকলে হাঁসগুলোর দিকে, তখনই জেগে উঠল আশাভঙ্গের ক্ষোভ। দেশে দেশে ছাত্র-আন্দোলন, খাদ্য-আন্দোলন, কৃষক আর শ্রমিকদের আন্দোলনে উত্তাল সারা পৃথিবী। বাংলার কবির মুখেও উচ্চারিত হল— রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।
আবাল্য যিনি ভেবেছেন চারপাশের মানুষজনের কথা, দেশ গড়ায় সরাসরি পথে নেমেছেন, সেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে শুধু নিজের এবং আশপাশের গ্রামের কথা লিখে যাওয়া কি সম্ভব! তাই রাজ্যের, দেশের বুভুক্ষু মানুষের ক্ষোভের ধ্বনিও ভেসে এসে যোগ দিয়েছে তাঁর গ্রামবাসীদের কণ্ঠে। ঐকতানে মুখর হয়েছে গ্রামের চিঠিগুলো। কখনো এসেছে জাতীয় রাজনীতির, এমনকী ভিনদেশেরও প্রসঙ্গ।
৭৯২ পৃষ্ঠার বই। তার মধ্যে শেষের ১০৬ পৃষ্ঠা মূল্যবান টীকায় আচ্ছাদিত। যেন দুধের অন্তর্লীন ননী, জ্বাল দেওয়ার পর ঠান্ডা হয়ে সরের আকার নিয়েছে। তবে সে-সর কোথাও কোথাও কেটেও গেছে। যেমন ১৭১ সংখ্যক চিঠির ‘কুলিপথ’ শব্দটি। টীকায় পাচ্ছি, ‘অপ্রশস্ত পথ বা সরু নালা’। তারাশঙ্করের চিঠিতেও তেমনই রয়েছে। আসলে কুলি শব্দটা এসেছে সাঁওতালি কুলহি শব্দ থেকে। অর্থ— পথ। বাঙালি লব্জে কুলি বহুদিনই জলচল। আমরা যারা দিকু, তাদের আবার শুধু কুলি বললে ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগে। যেমন পোর্তুগিজ পাউ। রুটির মতো নিজেদের ভাষার পথ শব্দটা জুড়লে তবেই শান্তি। আমাদের কাছে কুলিপথ যেন বিশেষ একটা রাস্তা।
ওই একই চিঠিতে রয়েছে দাওন-প্রসঙ্গ। টীকায় দাওন সম্বন্ধে যা লেখা হয়েছে, তেমন প্রথা বাংলার অন্য অঞ্চলে থাকতে পারে। রাঢ়ে নেই। তারাশঙ্কর দাওন-প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শেষ গাড়িটি (ধানের) বোঝাই করে গৃহস্থ পরিবারেরই একজন, শেষ আঁটিটি কেটে মাথায় তুলে নিয়ে বাড়ি এসে লক্ষ্মীর ঘরে ঢুকিয়ে দেন। তাকেই দাওন বলে। দাওন ওঠার পর আর মাঠে ধান থাকে না।‘ এটুকুই যথেষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আর একটি মাত্র তথ্য। ধানের ওই আঁটিটি স্বচ্ছল গৃহস্থরা মাথায় তোলার আগে নতুন গামছায় মুড়ে নেন। মুসলমান গৃহস্থবাড়িতে মা লক্ষ্মীর থাকার কথা নয়! তাই ওই আঁটিটি খামার-সংলগ্ন গাছের ডালে তুলে দেওয়া হয়, পাখপাখালির আহারের জন্যে।
গ্রাম সরল নয়। বড়ো বঙ্কিম তার চিত্রমালা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের জীবনটাই ঢেলে দিয়েছেন ওই আঁকাবাঁকা সরু ‘কুলি’তে। তারই লেখ্য রূপের সযত্ন প্রকাশ এই ‘গ্রামের চিঠি’।