Published : 22 May 2024, 03:23 PM
তিনি তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন তুষিকা স্বর্গ থেকে, সেখান থেকে তিনি মায়াদেবীর গর্ভে এসে উপস্থিত হলেন। অর্থাৎ তাঁর জন্মটি ছিল এক মহাযাত্রার আভাস। পুরো দশ মাস দশ দিন মাতৃগর্ভে থেকে বের হয়ে তিনি প্রথমে মাটিতে পড়েননি, তাঁকে ধারণ করা হয়েছিল স্বর্ণজ্বালে। লুম্বিনি বাগানে অশোক গাছের নীচে, রং আর সুগন্ধশোভিত হাওয়ায় মায়াদেবী যখন তার ডান হাত উপরে তুললেন একটি ডালকে ধরার জন্য, ঠিক তখনই বোধিসত্ত্ব মায়াদেবীর ডানদিক থেকে আবির্ভূত হলেন। গাছের নীচে রত্নখচিত সাত পাপড়ির পদ্মের ওপর নেমে বোধিসত্ত্ব সাত কদম হাঁটলেন সামনের দিকে। জন্মের পরই সাত-পা হাঁটা কি নয় একটি মহাকালিক ইঙ্গিত যে, সারাজীবন তিনি হেঁটে বেড়াবেন এই পৃথিবীর পথে পথে আর মানুষের দুঃখ থেকে মুক্তির পথকে উন্মুক্ত করবেন! দুঃখের ত্রিবিধ অবস্থা: দৈহিক অসুখিত্ব, আনন্দিক অসুখিত্ব, আনুভূতিক অসুখিত্ব। আনন্দের চরম মুহূর্তেও দুঃখ ছায়ার মতো লেপানো আমাদের অস্তিত্বের চারিভিতে।
কপিলাবাস্তুর রাজপ্রাসাদে তাঁর শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের সময় কাটছিল দারুণ আনন্দে। তিনটি প্রমোদ-প্রাসাদ-- নয়, সাত আর তিন তলবিশিষ্ট, যেখানে গীত-বাদ্য-যন্ত্র আর নৃত্যসহকারে তাকে আনন্দ জোগাত চল্লিশ হাজার সুন্দরী। এমন করেই যাচ্ছিল দিন, রাত, আর তার দ্বৈত মনোহারিত্ব। একদিন আনন্দ-উদ্যাপন অনুষ্ঠান সমাপ্তের পর আধো ঘুম থেকে জেগে উঠে তিনি দেখলেন, এতক্ষণ যে-সকল নারী তাঁকে মনোরঞ্জিত করছিল তারা সব নিদ্রামগ্ন, তাদের কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে দাঁত কাটছে, নাক ডাকছে, কথা বলে উঠছে; কারও মুখ খোলা--মুখ থেকে লালা ঝরে শরীর ভিজে যাচ্ছে, কারও কাপড় সরে নগ্নতা উঁকি মারছে, যেন মৃত্যুর উন্মোচিত নগ্নতা চারপাশে বিরাজমান। তাঁর মনে হল, প্রাসাদটি মৃতদেহে ঠাঁসা এক সমাধিক্ষেত্র যেখানে ধ্বনিত হচ্ছে মৃত্যুর শ্বাসাঘাত আর লোকোত্তর স্তব্ধতা। ভাবলেন, ‘‘কী দুঃখময় এ জগৎ, কী তমসাময়!’’ তিনি এ জীবনকে নিবৃত্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একদিন বের হয়ে পুব দিকের দরজায় গিয়ে দেখলেন এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধকে, দক্ষিণ দরজায় গিয়ে দেখলেন এক অসুস্থ ব্যক্তিকে, তারপর পশ্চিম দিকের দরজায় গিয়ে দেখলেন এক মৃত ব্যক্তিকে, উত্তর দিকের দরজায় গিয়ে দেখলেন এক সন্ন্যাসীকে। এই চতুর্মুখী মুখোমুখিতা তাঁকে প্ররোচিত করল এক ভ্রামণিক জীবনকে গ্রহণের, তিনি শ্রমণের জীবন গ্রহণ করলেন। এই মুখোমুখিতা পরবর্তী সময়ে গান্ধার শিল্পেও দেখা যায় যেখানে গৌতম ও তাঁর স্ত্রী মানুষের জন্ম-জরা-অসুস্থতা-মৃত্যুকে উদ্যাপন করছেন। এই যে উপলব্ধি তা ছিল তাঁর মানব-অস্তিত্ব সম্পর্কে অন্বেষণের সূত্রপাত। এজন্যই ঊনত্রিশ বছর বয়সে ( কারও মতে উনিশ বছর) তিনি গৃহত্যাগ করে এক দীর্ঘ ভ্রমণের পথে পা বাড়ালেন। পরে তিনি বলেছিলেন: ‘‘ভিক্ষুগণ, একসময় যখন আমি যুবক, ভরাজীবন, যৌবনদীপ্ত, ছিল উজ্জ্বল কৃষ্ণ চুল; পিতামাতার অবাধ্য হয়ে চুল-দাড়ি মুণ্ডন করে একজন শ্রমণের পোশাক পরে গৃহহীন সন্ন্যাসীর মতোই গৃহত্যাগ করেছিলাম।’’
কোনো এক মধ্যযামে প্রিয় ভৃত্য চন্নকে বললেন তাঁর সাদা ঘোড়াটিকে প্রস্তুত করার জন্য যার নাম কন্ঠক। শেষ বারের মতো দেখে নিলেন পুত্র রাহুলের মুখ। তারপর চন্নকে নিয়ে সেই সাদা ঘোড়ায় চড়ে সিংহদুয়ার পেরিয়ে অনুপিয়া কুঞ্জ ছাড়িয়ে একসময় তিরিশ ক্রোশ এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন অনোমা নদীর পারে। চন্নকে জিজ্ঞেস করলেন, নামটি কী নদীটির? নদীর নাম অনোমা শুনে বলে উঠলেন, ‘‘আমার এই গৃহ-পরিত্যাগও হবে অনোমা ( উৎকৃষ্ট )।’’ ঘোড়ার এক লাফে পেরিয়ে গেলেন নদীটি। চন্নকে বললেন, ‘‘ গহনাপত্র আর কণ্ঠককে নিয়ে ফিরে যাও চন্ন।’’ তারপর ডান হাতে তরবারি নিয়ে বাম হাতে মাথার মুকুটটি আর রত্নশোভিত কুন্তলগুচ্ছ মুঠি ভরে ধরে কেটে ফেললেন, আর তা শূন্যে নিক্ষেপ করে বললেন, ‘‘ আমি বুদ্ধ হলে তা শূন্যে ভেসে থাকবে, না হলে তা মাটিকে পড়বে।’’ কর্তিত চুল এক যোজন দূরে ভেসে গিয়ে থেমে থাকল।’’ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কণ্ঠক সব শুনল, প্রভু-বিচ্ছেদে বেঁচে থাকা অসম্ভব হবে বলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করল; পৃথিবীর ইতিহাসে প্রভু-বিচ্ছেদে এ-ই হল কোনো প্রাণীর স্বেচ্ছামৃত্যু।
এই অনোমা নদীটিই যেন ছিল তাঁর উড়ালবিন্দু, এখানেই তিনি একা হলেন একা একা উড়বেন বলে। বিদায় সুখদ জীবন, বিদায় পূর্ণতা, বিদায় মোহমুদগর; এসো শূন্যতা। এসো নতুন পথ, শুরু হোক শুভত্বের অন্বেষণ। অক্রিয় দর্শন বিদায় হও, পরমতা বিদায়। জগৎ সাপেক্ষসৎ, নিরপেক্ষ সত্তা বলতে কিছু নেই। এ-ই প্রতীত্যসমুৎপাদ। বীজ হলে অঙ্কুর হবে কিন্তু বীজমাত্রই অঙ্কুর নয়। বীজ হতে উৎপন্ন অন্যকিছুও অঙ্কুর নয়। বীজ তাই অশাশ্বত, অনিত্য। বীজ আর অঙ্কুর তাই এক অপরের সাপেক্ষ।
এক পূর্ণিমার রাতে, উরুবেলায় নৈরঞ্জনা নদীর ধারে এক বোধিবৃক্ষের নীচে আলোকপ্রাপ্ত হন তিনি, জন্ম-মৃত্যু-জরা থেকে মুক্তির পথ পেলেন তিনি আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে, অন্তর্বীক্ষণের মাধ্যমে। হয়ে উঠলেন বোধিসত্ত্ব থেকে অভিসম্বুদ্ধ। সাত দিন যোগাসনে বসে থাকলেন তিনি, আরও সাতদিন অন্য এক বৃক্ষের নীচে। আলোকিত হয়ে উঠল বৃক্ষ, তিনি বলে উঠলেন: ‘‘আমি অভিসম্বুদ্ধ।’’ পরবর্তী উনপঞ্চাশ দিন তিনি তাঁর অর্জিত বোধকে উদ্যাপন করলেন। তারপর গেলেন সারনাথের ডিয়ার পার্কে, নিজ আত্মজ্ঞানকে প্রকাশ করার জন্য। সেখানেই তাঁকে ছেড়ে আসা পাঁচ সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন তিনি, তাঁদের বললেন, ‘‘প্রিয় মিত্রগণ, গভীরভাবে আমি দেখেছি যে, কিছুই নিজ থেকে একা নয়, স্বাধীন নয়, সবকিছুই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি দেখেছি, সব সত্তাই জেগে-ওঠার প্রকৃতিতে গুণসমৃদ্ধ। শিক্ষক কাউকে সত্যসন্ধ করে তুলতে পারেন না, সত্য রয়েছে তোমার মধ্যেই; কেবল প্রয়োজন নিজেকে, শরীর-মন-হৃদয়কে উন্মোচন করার, যেন তাঁর শিক্ষা তোমার নিজ বোধ এবং আলোকপ্রাপ্তির বীজকে বিদ্ধ করতে পারে। যদি তুমি তাঁর কথাকে নিজের ভিতরে প্রবেশ করতে দাও, তবেই মাটি আর বীজ অবশিষ্ট কাজটুকুন সেরে ফেলবে।’’ তারপর তিনি আরও বললেন, ‘‘বন্ধুগণ, মানুষ, দেবতা, ব্রাহ্মণ, সন্ন্যাসী আর মারগণকে সাক্ষী রেখে বলছি, নিজকে কখনোই দুঃখ থেকে মুক্ত একজন বুদ্ধ বলে দাবি করতাম না যদি-না আমি যা-সব তোমাদের বলেছি তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে পেতাম। কারণ আমি নিজেই যন্ত্রণাকে চিহ্নিত করেছি, তাকে বোধগম্য করেছি, যন্ত্রণার কারণকে চিহ্নিত করেছি এবং ভোগান্তির কারণকে দূর করেছি, কল্যাণকে অর্জন করেছি, কল্যাণের পথকে চিহ্নিত করেছি, সেই পথে শেষ অব্দি গিয়েছি এবং সামগ্রিক মুক্তিকে বোধিত করেছি, আমি এখন তোমাদের কাছে দাবি করছি যে, আমি এক মুক্ত মানব।’’ বলার সঙ্গে-সঙ্গেই ধর্মচক্র ঘুরতে শুরু করল অবিরাম।
মৃত্যুর আগে তিনি আরও বললেন:
সকল শর্তাধীন বস্তুই ক্ষণস্থায়ী,
তারা হল প্রপঞ্চ, জন্ম ও মৃত্যুর দ্বারা চালিত।
যখন এই জন্ম-মৃত্যু আর থাকবে না,
পূর্ণ নীরবতাই তখন আনন্দ।
মৃত্যুর আগে উচ্চারিত তাঁর এই শ্লোকে তিনি যা বলেছেন তার প্রথম পংক্তিতে প্রতিধ্বনিত আপেক্ষিক সত্য আর শেষ দুই পংক্তিতে পরম সত্য। সকল শর্তাধীন বস্তু মানে প্রাকৃতিক, শারীরিক, এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রতিভাস; পূর্ণ নীরবতা মানে নির্বাণ; পূর্ণ নীরবতা মানে আনন্দরূপ-- মানে সকল চিন্তা, ধারণা এবং বলার সমাপ্তি।
তিনি বলছেন, তিনটি ধর্মমুদ্রার কথা: অনিত্য, অনাত্ম, নির্বাণ।
অনন্ত জীবনপ্রবাহে চিরবাস্তবের কোনো কেন্দ্র নেই। রয়েছে অব্যক্ত: পরম হল প্রতিভাসের বাস্তবতা, ভিন্ন কিছু নয়। আর দুঃখ হল মুক্তির অভাব, মুক্তির জন্য দুঃখ দূর করা ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ নাই। যন্ত্রণা, মৃত্যু, জরা থেকে নিবৃত্তি সম্ভব, তা সম্ভব সদ্ধর্ম পালনের মাধ্যমে।
সেই এক গোধূলিঘন সময়ে বুদ্ধ শালবনে এলেন, আনন্দকে বললেন, দুটি শালবৃক্ষের মাঝে একটি জায়গা প্রস্তুত করে দিতে যেখানে তিনি শুয়ে পড়বেন। বুদ্ধ শুয়ে পড়লেন, উত্তর দিকে শিয়র তাঁর, চারপাশে সমস্ত ভিক্ষুরা। তাঁরা জানতেন, আজকের রাতেই নির্বাণে চলে যাবেন বুদ্ধ। বুদ্ধ তাকালেন ওপরের দিকে, বললেন, ‘‘আনন্দ, দেখো! যদিও এখনও বসন্ত অনাগমিত তবুও শালগাছগুলো কীরকম ফুলে ফুলে লালেলাল হয়ে আছে! তুমি কি দেখছ, পাপড়ি ঝরে পড়ছে তথাগতের গায়ে আর চীবরে, সকল ভিক্ষুর চীবরে? অরণ্য আসলেই সুন্দর। দেখছ কি, পশ্চিম আকাশ অস্তগামী সূর্যের আভায় কী জ্বলজ্বল করছে? শালগাছের ডালে ডালে মৃদুমন্দ হাওয়ার কাঁপন কি শুনতে পাও তুমি? এসবকিছুই তথাগতের কাছে সুন্দর আর স্পর্শকর। তুমি যদি তথাগতকে তোমার শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাও তবে একমাত্র পথ হল, তথাগতের শিক্ষাতে বেঁচে থাকা।’’ তারপর একে একে অনেকেই এলো তাঁর কাছে। অবশেষে আবারও আনন্দকে তিনি বললেন, ‘‘আনন্দ, তুমি বলো বিশ্বাস থেকে কিন্তু তথাগতের রয়েছে প্রত্যক্ষ জ্ঞান। তথাগত জানে যে এখানকার সব ভিক্ষুরই আছে ত্রিরত্নের ওপর গভীর বিশ্বাস। এমনকি সবচেয়ে কম অর্জনও হবে ‘সোতাপন্ন’ ( stream-enterer )।’’ সবশেষে বুদ্ধ সমবেত ভিক্ষুগণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ভিক্ষুগণ, তথাগত যা বলে তা শোনো। ধর্ম অনিত্য। যদি জন্ম থাকে তবে মরণও থাকবে, মুক্তির জন্য তোমার প্রচেষ্টাকে ক্রিয়াশীল রাখো।’’ শেষ কথা বলে চোখ মুদলেন বুদ্ধ, শালবৃক্ষের ফুল ঝরে পড়ল, পৃথিবী কম্পিত হল, কেঁপে উঠল সকলের শরীর ও মন। বুদ্ধ নির্বাণে গেলেন।
নির্বাণ এক পরিবর্তনহীন, যন্ত্রণাহীন, না-জন্ম, না-বৃদ্ধি, না-অস্তিত্বশীল, না-অনস্তিত্বশীল, না-ভাব, না-অভাব, অব্যাখ্যাত এবং অব্যক্ত এবং অতিন্দ্রিয় অবস্থা; জীবনের ভ্রমণের শেষ গন্তব্য, শেষ অবস্থা হল নির্বাণ। ব্যক্তি বুদ্ধের ভ্রমণ এই নির্বাণেই হয়তো সমাপ্ত কিন্তু তাঁর চিন্তার ভ্রমণ চলমান রয়েছে--শাশ্বতভাবে, শাশ্বতকালে। এবং তাঁর এই ভ্রমণসূত্রকে অবলম্বন করে অসংখ্য ভ্রমণ করে চলেছেন অসংখ্য অসংখ্য জন।