আজ ১৪ই এপ্রিল একটা গুলির শব্দ, তারপর দুর্দান্ত বিপ্লবী লেনিনের সহযাত্রীর নীরবতা। ফিউচারিস্ট কবি মায়াকোভস্কির কথা বলছি।
Published : 14 Apr 2024, 12:09 PM
"শেয়ালগুলো বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। ওরা বড় বড় দলে ভাগ হয়ে দৌড়াচ্ছে আর প্রচন্ড চিৎকার করছে। ওদের চিৎকারগুলো অত্যন্ত অপ্রীতিকর এবং সাংঘাতিক ভয়ঙ্কর ..."।
আজ ১৪ই এপ্রিল একটা গুলির শব্দ, তারপর দুর্দান্ত বিপ্লবী লেনিনের সহযাত্রীর নীরবতা। ফিউচারিস্ট কবি মায়াকোভস্কির কথা বলছি। যার সৃষ্টি হয়েছিল সকল নিয়মের বিরুদ্ধে; এমনকি গোর্কির তত্ত্ব "সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা- এসবের বিরুদ্ধে"। অর্থাৎ স্তালিনের বিরুদ্ধাচরণ করা। যার পরিণতি সকল সৃজনশীল বলশেভিকদের মতোই। যেমনটি এইখানে ঘটেছে, ঐখানে ঘটছে, সেইখানে ঘটছে অহরহ। ছকে কাটা নিয়মের বাইরে গেলেই ঠুস, ঠাস, ফুট, ফাট, গুম, হাওয়া। এইভাবেই মায়াকোভস্কির মা রাশিয়া এবং জর্জিয়াকে বর্ণনা করেছেন বলেই জানতে পেরেছি "সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার"-এর নাটক 'স্তালিন' প্রযোজনার সময়ে। যেহেতু মায়াকোভস্কির মায়ের কথাগুলোর ভাবনাটা সঙ্গে নিয়েই আমি আর অনুবাদক রায়হান আখতার নাট্যকাঠামোটি দাঁড় করাতে শুরু করেছিলাম, এটা ছিল এক দীর্ঘ যাত্রা। পুরো কাজটি শেষ করে আনতে প্রায় বছর তিনেক লেগে গেল।
নাটকটি মঞ্চে নামতেই মানুষের ঢল, চিৎকার, চেঁচামেচি, হট্টগোল, আমার বিরুদ্ধে স্লোগান, দর্শকেরা নাটকের পক্ষে ও বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তর্কাতর্কি, প্রতিদিন মিছিল, মিটিং, নাটক বন্ধ করবার হুমকি-ধামকি। নাটকের নেতৃত্বে থাকা কোনো কোনো মানুষ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের মুখের উপর আঙ্গুল ছুঁড়ে দিয়ে নাটকে পুনরায় "সেন্সরশিপ"-এর প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটি তুলে ধরলেন। নাটকটি বন্ধ করবার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। দেশের প্রগতিশীল বলে দাবীদার নাটকের নেতা ও হবু নেতারা সঙ্গে বাম রাজনৈতিক আদর্শের নেতা কর্মীরা একত্রে সরকারের কাছে সম্মিলিতভাবে স্মারকলিপি পেশ করলো সিএটি'র নাটকটি বন্ধ করবার জন্যে। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় সকল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ক্যামেরায় বন্দি হয়ে পড়তে লাগলো প্রতিটি মুহূর্তের ঘটনা। প্রচারের প্রতিযোগিতা। কে কার আগে প্রচারে যেতে পারে। সকাল-বিকাল হয়ে উঠলো "সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার" ও "স্তালিন" সকল টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজ আইটেম। সকল পত্রিকা দিনের পর দিন 'আমি, সিএটি এবং স্ট্যালিন' বিষয়ে নতুন নতুন সব খবর নিয়ে হাজির। কলাম লেখা হচ্ছে, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে। দেশের সব খবরের কাগজের মহান মহান পন্ডিতেরা কলম ধরে ফেললেন। কেউ আবার সুদূর আমেরিকাতে বসেই নাটকটি না দেখেই দেশের খবরের কাগজে নাটকটি নিয়ে বিশালাকার কলাম লিখে ফেললেন। বুদ্ধিজীবীরাই বা বাদ যাবেন কেন? প্রতিযোগিতা, 'কে কাহার চাইতে কতো বড় মার্কসবাদী এবং মার্কসীয় তাত্ত্বিক '- সেটা যে প্রমাণ করতে হয়, নাহলে এটা যে হয়ে পড়বে 'ইজ্জতের সাওয়াল'। 'আরে থুক্কু', আমি সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বা স্তালিন সম্পর্কে কিছুই জানি না বলে প্রমাণ করার চেষ্টা চলতে লাগলো। অতএব লেনিনের ভাষায়, "পড়ো, পড়ো, পড়ো" এবং কলম ধরো। লেখার পর লেখা। ছাপার পর ছাপা। লন্ডন এবং নিউইয়র্ক'র বাংলা পত্রিকাগুলো বসে থাকবে কেন? চট্টগ্রামের ভাষায়, "মার বদিউজ্জামান"। অর্থাৎ, উৎসাহী বাঙালির কোনোকিছু দেখবার প্রয়োজন হয় না, শুনেই ধারদেনা করে একটা কিছু লিখে বা বলে ফেলতে পারে। বিশেষ করে হাজার লক্ষ বা কোটি মানুষ যখন সামাজিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে হুমড়ি দিয়ে পড়ে কোনো একটা কিছু নিয়ে, ঠিক তখনই এটা হয়ে ওঠে বাজার অর্থনীতির মাল। আর তাই আমি এবং আমার সৃষ্টি হয়ে উঠলো এইসবের কেন্দ্রবিন্দু।
এই বয়ানে বোঝা যায় মায়াকোভস্কি যে পৃথিবীতে জন্মেছিল সেটা আমাদের পৃথিবীর মতোই আরেকটি পৃথিবী; দুর্দান্ত ভালোকিছু নয়। এটা না হলে এই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটি আত্মহত্যা করেছিল কেন? যেমনটি আমাদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বন্ধু সাদী মোহাম্মদ। আমার বিবেচনায়, এটাকে বলা চলে জাতীয় উপলব্ধির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবাদ। যা মূর্ত হয়ে আছে মায়াকোভস্কির নাটক ও কবিতার মধ্যে, এবং তাঁর বিপ্লবী রাজনীতি এবং তাঁর জীবন ও মৃত্যুর ভেতরেও।
মায়াকোভস্কির কবিতাকে আমার কেবলই মনে হয় জন মিল্টনের কবিতার মতো তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সাগরের এপার থেকে কেউ একজন হাতের চোঙা দিয়ে অন্য পারের জাহাজের কোনো এক যাত্রীর দিকে চিৎকার করে বলছে:
"ছন্দের মৌলিক নিষ্প্রাণ গর্জনটি কোত্থেকে আসে এটা একটি রহস্য। আমার কাছে এটা হলো আমার মনের ভেতরে পুনরাবৃত্তি হয়ে চলা কিছু শব্দ, কিংবা একটা মৃদু গতি, কিংবা ধরুন এমন কোনোকিছু যেটার সাথে আমি আমার শব্দগুলোকে নানাভাবে যুক্ত করতে পারি। আর সমুদ্রের হাওয়ায় হাওয়ায়, ঢেউয়ে ঢেউয়ে শোঁ-শোঁ শব্দটি অবিরাম পুনরাবৃত্তি হয়, বিধায় ওটা আমাকে ছন্দ দিতে পারে। এ আমার চেতনার পান্না হয়ে আমার অন্তরে প্রবেশ করে, আমাকে পথ দেখায়, এবং আমাকে প্রবহমান বাতাসের শিস-ধ্বনি (একটি সামাজিক আদেশ)-এর সাথে অবধারিতভাবে যুক্ত করে ফেলে"। এই সবের গভীরে প্রবেশ করে যেটা পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে কবিতা, অন্যের ব্যবহারের জন্য কবির নিজের জীবনের কাব্যিক চেতনার নির্মাণ। কোনো কোনো পাঠক হয়তো বলবেন এটা আসলে সমস্ত কবিতা এবং কবিদের ক্ষেত্রে কমবেশি সত্য। কিন্তু মায়াকোভস্কির ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি, কারণ তাঁর জীবনের শুরুটা হয়েছিল ভাষার অস্তিত্বের প্রয়োজনে, আর শেষটি হয়েছিল ভাষাকে রাজনৈতিক আদর্শ ও পরিস্থিতির ভেতর থেকে ব্যবহারের প্রতি কর্তাব্যক্তিদের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়া; অথবা ধরা যাক কবিকে একটা ভয়ঙ্কর সঙ্কটের দিগন্তহীন শুন্যভূমির ভেতরে নিজেকে টিকিয়ে রাখা।
কোথাও যেয়ে মনে হয় 'এটাই যে তার শরীর বা কর্পাস'। কিন্তু তাঁর শরীর [কর্পাস]-টার টিকে থাকার অধিকার আছে কিনা এই ব্যাপারেও তিনি অন্যদের সিদ্ধান্তের ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন। যেমনটি আমরাও আরকি। এইরকম একটা প্যারাডক্সিক্যাল বা আপাত-বিপরীত অবস্থার মাঝে দাঁড়িয়ে বলতেই হয় মায়াকোভস্কির জন্য কবিতা ছিল অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রূপান্তরকরণের একটি প্রশ্ন। যেটার খোঁজ মেলে "ট্যাক্স কালেক্টরের সাথে কথপোকথন"-এ। যেখানে তিনি বলবার চেষ্টা করেছেন কবির অভিজ্ঞতাটি হলো একটি কবিতার প্রস্তুতিমূলক উপাদান, আর উৎপাদিত পণ্যটিই হলো কবিতা, যেটা সামাজিক আদেশের জবাব দেয়। 'একজন কবিকে প্রতিটি সভা, প্রতিটি পথনির্দেশক স্তম্ভ, মাইলফলক এবং প্রতিটি ঘটনাকেই কবিতার উপাদন হিসাবে ব্যবহার করতে হয়'। এটা নিয়ে লেখার সমাপ্তিকথনে বলার চেষ্টা করবো- যদি দম বন্ধ হয়ে যায় তবে কবির কবিতা উদ্ধৃতি আকারে পাঠকের মগজের গরম চুলোয় ছেড়ে রেখে অন্য কোনোদিকে বাঁক নেবো।
মায়াকোভস্কি বারেবারে বলার চেষ্টা করেছেন কবির প্রাথমিক কাজ হচ্ছে- অন্ত্যমিল, প্রতিচ্ছবির সাথে কবিতার চরণগুলোকে আবিষ্কার করা এবং সংরক্ষণ করা, যাতে করে পরবর্তীতে এগুলোকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। উৎপাদন কাঠামোতে দাঁড়িয়ে তিনি কবিতার কয়েকটি পর্যায়ের কথা বলেছেন, যার আলো আর ছায়ার খোঁজ পাওয়া যায়, "হাউ আর ভার্স মেইড" [১৯২৬] -এ।
মায়াকোভস্কির "পাতলুন পরা একটি মেঘ (A Cloud in Trousers)" কবিতাটি আমার ভীষণ প্রিয় এর পেছনের গল্পটির জন্যে। এই কবিতাটি আমি যেমন নানা রকমে এবং নানা প্রকারে ব্যবহার করেছি আমার নানা লেখালেখির কানাগলিতে, তেমনি আমার নাট্যনির্দেশনা ও প্রয়োগের খোলা চত্বরে, যেমনটি আমার নির্দেশিত ও সিএটি'র প্রযোজনা "স্তালিন" (২০১৯)। এই নাটকের গল্পটির বুননের ফাঁকফোকরে একটা ভীষণরকমের ভয় ও ক্ষমতার রাজনীতি আমি দেখতে পাই। যার বসবাস সর্বকালের, সর্বদেশের এবং সর্বযুগের সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রক্রিয়ায়।
যাক ফিরে আসি "A Cloud in Trousers" কবিতাটির পেছনের গল্পে। মায়াকোভস্কি বলেছেন: "১৯১৩ সালের দিকে, যখন আমি সারাতোভ থেকে মস্কোতে ফিরছিলাম, তখন আমি আমার কোনো এক নারী সঙ্গীর প্রতি আমার গভীর অনুরাগ প্রকাশ করার জন্যে বলেছিলাম- 'আমি কোনো মানুষ নই, আমি হচ্ছি পাতলুন পরা মেঘ'। এটা বলার পরক্ষণেই মনে হলো এটাতো এক দারুণ কবিতার লাইন... বছর দু'য়েক পরে লিখে ফেললাম এক দীর্ঘ কবিতা। নাম দিয়েছিলাম, পাতলুন পরা একটি মেঘ"। কবিতাটি শেষ হতেই একটা বিষ্ফোরণ ও একটা লন্ডভন্ড অবস্থার সৃষ্টি হলো । "কবিতাটির উৎপাদন ও কারখানার উৎপাদন"-এর মধ্যে একধরনের তুলনামূলক আলোচনা শুরু হয়ে গেল। আবার কোনো কোনো পন্ডিতগণ কবিতাটির রূপকটিকে আধুনিক প্রযুক্তির একটি ফিউচারিস্ট ব্যাখ্যার উপর দাঁড় করালেন:
"তুমি যদি রূপকটা বুঝে থাকো,
তাহলে বলতেই হয়
একটা ছন্দ হলো পিপা,
আর বাক্যটা হলো ফিউজ।
ফিউজটা যখন পুড়ে যায়
পিপাটা বিস্ফোরিত হয়,
আর শহরটা যখন ভেঙেচুরে
দুমড়ে-মুচড়ে যায়,
তখনই জন্ম নেয় আখ্যান ও উপাখ্যান"।
...
"কবিতা হলো
একটা অজানা গন্তব্যে যাত্রা।
কবিতা হলো
রেডিয়ামের জন্য মাটি খনন করার মতো ব্যাপার।
সারাবছর পরিশ্রম করে
পাওয়া যায় মাত্র এক আউন্স।
শুধুমাত্র একটা শব্দের জন্য
ছাঁকতে হয়
হাজার হাজার টন শব্দের আকরিক।
দহন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া শব্দটাকে
তুলনা করতে হয় তার স্বাভাবিক অবস্থার সাথে।
ওই শব্দটাই কিনা বেঁচে থাকবে
হাজার হাজার বছর,
লক্ষ লক্ষ হৃদয়ে।