‘রেড লাইট’ এলাকায় আমাদের নতুন ঘরে তিনজন রাত কাটালাম। কিন্তু খাবারের জন্য তো আবার আস্তানায় যেতে হবে। গতকাল যে পথে আমরা দু’জন হাঁটছিলাম, এবার রশিদ থাকাতে সেই ফেরত পথে হলাম তিনজন।
Published : 13 Feb 2017, 10:04 AM
বাসা থেকে বেড়িয়ে দেখি সব কিছু শান্ত, রাতের জ্বলা নাইট ক্লাব আর ‘ইরটিক সেন্টার’-এর রঙ্গিন আলোগুলো আর নেই। যে মহিলাদের গত রাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, তারাও নেই। এই সকালবেলায় অবশ্য তাদের না থাকারই কথা। কারণ যারা রাত জেগে কাজ করেন, তাদের তো বিশ্রামেরও প্রয়োজন আছে।
দিনের বেলায় হাঁটার সময় চোখে পড়লো ছোট-বড় অনেক দোকান। এর মধ্যে খাবার দোকান ‘বার্গার কিং’-ও চোখে পড়ল। তবে অধিকাংশ দোকানের ক্ষেত্রেই বুঝতে পারলাম না যে এগুলো কিসের দোকান?
ব্যাংক চোখে পড়ল এবং ব্যাংক বুঝতে অসুবিধা হলো না। কারণ ইংরেজির মত জার্মান ব্যাংক বানানও একই, তবে উচ্চারণের পার্থক্য আছে। যেহেতু জার্মান ভাষায় ‘এ’-কে ‘আ’ উচ্চারণ করে, তাই তারা ব্যাংককে ‘বাঙ্ক’ বলে। যেমন- গতদিন ‘পলিসাই’ মানে ‘পুলিশ’ আর ‘বাহনহফ’ মানে ‘স্টেশন’ শিখেছি। তেমনই আজ শিখলাম ‘বাংক’ মানে ‘ব্যাংক’। এমনই তিল তিল করে আমাদের ভাণ্ডারে জার্মান শব্দ জমা হচ্ছিল।
ওহ্, আসার পথে আরেকটি শব্দ শিখলাম। সিগারেট, বিয়ার, পত্র-পত্রিকা, লজেন্স- এসব টুকিটাকি জিনিস যেসব ছোট ছোট দোকানে বিক্রি হয়, সেগুলোকে এরা বলে ‘কিয়োস্ক’ (Kiosk)।
যাদের ভাষা তাদের দেশে থেকে শেখার সুবিধা হলো, কারও আগ্রহ থাকলে সে চলার পথে অনেক শব্দই শিখতে পারে। আবার ফিরে আসলাম আস্তানায়। ওখানকার বন্ধুদের রান্নাই খেলাম, কারণ এছাড়া আমাদের বিকল্পও ছিল না। আমাদের মধ্যে কেউ রান্না শিখে আসেনি। ওরাও শিখে আসেনি, তবে যেহেতু কয়েক মাস আগে এসেছে, তাই বাঁচার তাগিদে চালিয়ে নিতে পারতো।
খাবার খাওয়ার পর শুরু হলো পরিকল্পনা, কীভাবে জার্মানিতে থাকার জন্য এগোনো যায়? এসেছিলাম একসাথে চারজন, তার মধ্যে নিলু তো নুরুর সাথে থেকে গেল। আর বাকি আমরা তিনজনের জার্মানিতে থাকার বিষয়ে চেষ্টা করার পথ। যদিও সে পথ ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল পরে।
অন্যদিকে আমার প্রথম কাজ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বাংলাদেশের সর্বশেষ ডিগ্রির সার্টিফিকেট দেখিয়ে ওখান থেকে লিখিয়ে আনা যে আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা আছে। আর একটি ভাষা স্কুলে ভর্তি হওয়া এবং ব্যক্তিগত খরচে একটি স্বাস্থ্যবীমা করা। আর পুলিশ অফিসে গিয়ে কিছু কাগজ জমা দেওয়া।
বিকেলে যখন রশিদ আর সেলিম নিচের তলায় মঞ্জু ও মতির ঘরে গেছে, তখনই কাজ থেকে ফিরে আসলো ফরহাদ। এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ঘর কেমন লাগলো?
আমি গত রাতে আমার দেখা সব অভিজ্ঞতা ওর কাছে বর্ণনা করলাম। ও বলল- আমি জানি ওখানকার পরিস্থিতি, তাই তো আমি চুপ করে ছিলাম।
জার্মানিতে এসে এই প্রথম ওর সাথে আমার একা কথা হচ্ছিল। ও বলেই ফেলল, তোমরা সবাই আমার বন্ধু, তারপরও তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল অন্যরকম। তাই আমি চাই, রাতে শোয়ার সময় সেলিম আর রশিদ ওখানে গেলেও তুমি আমাদের এখানে থেকে যেও।
সত্যি আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ, সেই পিচ্চিকালে আমরা একসাথে সুতোয় রঙ করা, মানে মাঞ্জা দিয়ে ওদের বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়িয়েছি। ক্রিকেট, ফুটবল তো খেলেছিই, একসাথে ঢাকা স্টেডিয়ামে গিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল খেলাও দেখেছি। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় একসাথে মিটিং-মিছিল করেছি, আরও কত কী!
কলেজ জীবনে আমাদের বন্ধুত্ব আগের মত থাকলেও যোগাযোগ আগের থেকে অনেক কমে গেল। কারণ ও তখন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লো আর স্কুলে আমাদের ক্লাসের বেশ কয়েকজন ডানপিটে ছেলে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়লাম। মনে পড়ে- আমাদের কয়েকজন বন্ধুদের মধ্যে তখন পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল।
আমাদের তখন বয়সন্ধিকাল, যে বয়সে হিসেব করে চলার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণ থাকে রোমাঞ্চকর কাজের প্রতি। আমরা তখন গোপনে গোপনে পোস্টার লাগাতাম, চিকা মারতাম, লিফলেট বিতরণ করতাম, সেই সাথে ক্লাস ছুটির পর কলেজের শ্রেণিকক্ষে রঙ্গিন চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড ও ওয়ালে নকশাল রাজনীতির বিভিন্ন শ্লোগান আর উক্তি লিখে আসতাম।
মনে পড়ে, একদিন ফরহাদ আমাকে সেইসব শ্লোগান ও উক্তি কয়েকটি শ্রেণিকক্ষে লিখে দিয়েছিল। কারণ ওর হাতের লেখা ছিল সুন্দর। ছোটবেলার অনেক বন্ধুত্ব-ই পরবর্তীতে দর্শনের ভিন্নতার জন্য সময়ের সাথে সাথে অনেক দূরে চলে যায়। তাই ভেবেছিলাম ফরহাদের কী সেই পুরনো বন্ধুত্বের কথা মনে আছে, নাকি বদলে গেছে? ও যখন আমাদের পুরনো দিনের কথা স্মরণ করলো, তখন তার ওখানে থাকার প্রস্তাবে সরাসরি ‘হ্যা’ বা ‘না’ বলে বললাম, আমি ওদের দু’জনের সাথে আলাপ করে আগামীকাল জানাবো।
রাতে খাওয়ার পর আবার আমরা তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম আমাদের সেই ঘরের দিকে। পথে দেখলাম, গত রাতের রাস্তায় দেখা দৃশ্যের মতই চিত্র। তবে এবার আমাদের আর পুলিশ ডাকেনি। ঘরে গিয়ে সেলিম ও রশিদের সাথে আমার ফরহাদের ঘরে থাকার বিষয়ে আলাপ করে মতামত জানতে চাইলাম। ওরা সাথে সাথে বলে দিল, ‘তুই ওখানে থাকতে পারিস, আমাদের কোন অসুবিধা নেই।’
ঘটনা হলো, মানুষ তখন আমরা পাঁচ জন। দুই ঘরেই ডবল বেড সুতরাং পাঁচ জন মানুষ ভাগাভাগি হলে তো একদিকে তিন জন আরেকদিকে দু’জন হবেই। সিদ্ধান্ত হলো, আমি পরের দিন থেকে স্লোসেন স্ট্রিট ৪-এ থাকবো।
চলবে ...
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |