বিকেল থেকেই আকাশটা কেমন যেন গুড়গুড় করছে। কেউ কেউ ভাবছে রিমিঝিম বৃষ্টি হবে। কেউ আবার ভাবছে মেঘ কেটে যাবে। তবে মিহির আলি ভাবছে এ দুটোর কোনোটাই হবে না। হয়ত ছিটে ফোঁটা পড়লেও পড়তে পারে।
Published : 09 Jul 2014, 06:40 PM
মিহির আলি ছিলেন গ্রামের নম্র-ভদ্র সাদাসিধে গোবেচারা মানুষ। নদী তীরবর্তী গ্রামের সচ্চল কৃষক মিহির আলি কারও সাতেও ছিল না পাঁচেও ছিল না। চাষাবাদ করে সুখেশান্তিতে দিন কাটত বউ ও ছেলে নিয়ে।
কিন্তু ভয়াল নদী ভাঙনের শিকার হয়ে মিহির আলি আজ সর্বশূন্য। নেই জমি, নেই হালের বলদ। জায়গা জমি হারানোর ব্যথা হয়ত সামলে নিতে পারত কিন্তু প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে ১০ বছরের শিশুটিকে হারিয়ে, আর সেই শোকে লাল টুকটুকে লায়লাও যখন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেল দূর দেশে তখন আর সইতে পারল না।
সব হারিয়ে মিহির আলি আজ পথের ভিখারি, পাগল। সারাদিন টাউন হল মোড়ের আশপাশে বসে বসে কী জানি কী ভাবে! আর মাঝেমধ্যে আকাশ পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে!
টাউন হল মোড় দিয়ে যাদের নিয়মিত যাওয়া-আসা তাদের প্রায় সবাই মিহির পাগলকে চিনে কমপক্ষে এক যুগ ধরে। বিকেল থেকে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করছে, আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে আর বলছে নাহ! কোন অঘটন ঘটবে না। সব ঠিকঠাক আছে। ইদানিং তার হাতে ভিনদেশি এক পতাকা সব সময় দেখা যায়, ছোট্ট এক শিশু আদর করে তার হাতে তোলে দিয়েছে। সে তা সাদরে গ্রহণও করেছে। যদি কোনোকিছু তার পছন্দ না হয় তবে তা যত দামিই হোক না কেন সে কিছুতেই গ্রহণ করবে না।
কিন্তু পতাকাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। আকাশি আর সাদা চেক। শিশুটি যেদিন তার হাতে পতাকাটি তুলে দেয় সে একবার পতাকার দিকে তাকায় আর একবার আকাশের দিকে তাকায়।
হয়ত ছেলের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। এভাবেই কাটে প্রথম দিনটি। এরপর অবশ্য আগের মতো আর করে না।
তবে মাঝেমধ্যে আকাশ আর পতাকা এই দুটিকে পালা করে দেখতে থাকে। সেই জন্যই হয়ত আকাশ সম্পর্কে কদিনে বেশ ভালো একটা ধারণা হয়ে গেছে। আর তা থেকেই তার ধারণা আজকে মুষলধারে বৃষ্টি হবে না, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হলেও হতে পারে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যত গভীর হচ্ছে, টাউন হল মোড় সংলগ্ন শহিদ মিনারের সামনের ফাঁকা মাঠটাতে লোক সমাগত ততই বেড়ে চলেছে। দেখতে দেখতে রাত পৌঁনে দশটা বেজে গেছে। কয়েক শত লোক সমাগম হয়েছে বড়া পর্দায় খেলা দেখার জন্য। বড় পর্দায় সবাই মিলে বিশ্বকাপ খেলা দেখাটা যুবকরা বিশেষ করে তরুণ ছাত্ররা বেশ উপভোগ করে। মিহির আলিও বেশ উপভোগ করে। মিহির খেলা কতটুকু বোঝে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারে।
কিন্তু তার উল্লাস দেখে কেউ বলতে পারবে না যে সে খেলা একদমই বোঝে না। বল নিয়ে যখন মেসি কিংবা হিগুয়েইনরা ছুটে চলে তখন তার আনন্দের সীমা থাকে না। হাতের পতাকাটির দিকে একবার তাকায় আর একবার বড় পর্দায় ভেসে ওঠা মেসিদের গায়ের জার্সির দিকে, আর অমনি চিৎকার করে ওঠে। মিহিরের উদযাপন দেখে পথশিশুরাও যোগ দেয় তার সঙ্গে। তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনাল চলছে আর্জেন্টিনা আর বেলজিয়ামের মাঝে। কেউ কেউ ভাবছে আজকে বেলজিয়াম তাক লাগিয়ে দেবে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে। আবার কেউ কেউ বলছে পাত্তাই পাবে না।
যে যাই বলুক মিহিরের মুখে দুটো শব্দই শোনা যাচ্ছে পালাক্রমে; মেসি আর গোল, গোল আর মেসি! সেই কবে ১৯৯০ সালের পর থেকে আর প্রিয় দলটি যে কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি। তাই তো আজকে উত্তেজনাটা একটু বেশিবেশিই কাজ করছে ভক্তদের মধ্যে। বল নিয়ে মেসি হিগুয়েইনরা যখন বেলজিয়ামের দিকে ছুটে চলে দর্শকরা উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। আর মিহির আলির কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। সপ্তম মিনিটের খেলা পার হয়ে অষ্টম মিনিটের খেলা চলছে। হিগুয়েইন দৌড়ে এসে উড়ন্ত এক বলকে শুন্যের উপর থেকেই কিক দিয়ে পাঠিয়ে দিল জালে, আর অমনি সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল, “গোল! গোল!”
মিহির আলি আনন্দে হাতের পতাকাটি আকাশে ঘুরাতে ঘুরাতে নাচতে লাগল ‘গোল গোল’ বলে চিৎকার করতে করতে। বেলজিয়াম সমর্থকদের হৃদয় শুরুতেই যেন চৌচির হয়ে গেল। সবাই ভাবল আজকে কম করে হলেও এক হালি খাবে। বেলজিয়ামের খেলোয়াড়েরা মাঝেমধ্যে আক্রমণে গেল। কিন্তু কাজ হল না। উল্টো মেসি দর্শকহৃদয়ে আশা জাগিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দেরকে ভেলকি দেখিয়ে বল প্রায় জালে ঢুকিয়েই দিয়েছিল।
ভাগ্য যেন বেলজিয়ামের সহায় হল। কোনো অঘটন ঘটল না। দেখতে দেখতেই নব্বই মিনিটের খেলা শেষ। ইতোমধ্যেই একাধিক প্লেয়ার হলুদ কার্ডও দেখল। কিন্তু লাভ হল না। কারণ ওটা যে বাঁচামরার ম্যাচ!
কে শোনে কার কথা! যে যার মতো প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে ল্যাং মেরে চলল। রেফারি অবশ্য বেশ শান্ত থাকার চেষ্টা করল। সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ করে বেলজিয়ামকে গোল পরিশোধ করার জন্য ইনজুরি টাইম হিসাবে আরও পাঁচ মিনিট সুয়োগ দিল।
কিন্তু ভাগ্য যেন ওদের সহায় হল না। অবশেষে লাখো বেলজিয়ান সমর্থককে শোকের সাগরে সমাহিত করে আর্জেন্টাইনরা মেতে উঠল জয়োৎসবে। আর মিহির পাগল নাচতে লাগল প্রিয় দলের পতাকা নিয়ে ‘গোল গোল’ বলে।
খেলা শেষে একে একে সবাই চলে গেল, শুধু পড়ে রইল নিঃস্ব মিহির আলি।