অনেক অনেক দিন আগের কথা। মিয়ানমারের ইরাবতী নদীর তীরে ছিলো একটা গ্রাম, সে গ্রামে বাস করতো থুজা নামে এক তরুণী। তার বিয়ে হয়েছিলো সুদর্শন তরুণ থিঙ্গির সঙ্গে, তারা ছিলো খুব সুখী।
Published : 18 Jul 2018, 04:51 PM
কিন্তু একটি সমস্যা ছিলো যা থুজাকে খুব জ্বালাতন করতো। তার স্বামী থিঙ্গি নিজেকে একজন অ্যালকেমিস্ট ভাবতো, সারাদিন ধুলো থেকে সোনা তৈরি করার স্বপ্ন দেখতো। সারাটা দিন, সব দিন, দিনের একেবারে শেষ পর্যন্ত থিঙ্গি তার গবেষণাগারে সময় কাটাতো গবেষণা করে। সে শুধু একটি সফল আবিষ্কারের অনুসন্ধানে থাকতো। আর তা হলো ধুলো নেড়ে সোনা পাওয়ার আবিষ্কার।
খুব শীঘ্র তাদের সব টাকা খরচ হয়ে গেলো। তরুণী থুজার খুব কষ্ট হতো তাদের দুজনের জন্য খাবার কিনতে। দুশ্চিন্তায় তার চেহারা গেলো ফ্যাকাশে হয়ে। একদিন সে তার স্বামী থিঙ্গিকে বললো, ‘এবার তোমার একটা চাকরি খোঁজা উচিৎ। এভাবে চললে আমরা না খেয়ে মারা যাবো।’
কিন্তু থিঙ্গি তার কথা শুনলো না। বললো, ‘আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণা করছি, এটা হলো ধুলোকে সোনায় রূপান্তরিত করার গবেষণা। এটা সফল হয়ে গেলে আমাদের আর দুশ্চিন্তা নেই, সংসারের সব অভাব অনটন দূর হয়ে যাবে, আমরা ধনী হয়ে যাবো।’
স্বামীর কথা শুনে থুজার মন ভেঙে গেলো, সে গেলো তার বাবা থেতের কাছে যিনি একজন বুড়ো ও বিজ্ঞ লোক। বাবার কাছে গিয়ে সমস্যার সমাধান চাইলো থুজা। থেত শুনে অবাক হলো যে তার মেয়ের বর একজন অ্যালকেমিস্ট। কিছুক্ষণ ভেবে সে থুজাকে বললো থিঙ্গিকে ডেকে আনতে। সেদিন থুজা খুব খুশিমনে ঘরে ফিরে এলো। কারণ সে জানতো তার বাবা একটা সমাধান করবেই।
পরদিন থিঙ্গি ভয়ে ভয়ে গিয়ে তার শ্বশুরের সামনে উপস্থিত হলো। থিঙ্গি মনে মনে ভাবছে তার শ্বশুর নিশ্চিত তার ওপর ক্ষেপে আছে এবং তার কাণ্ডকারখানার জন্য তাকে বকুনি খেতে হবে। থুজার বাবা থেত কিছুই করলো না, বরং থিঙ্গিকে দেখে সে খুশি হয়ে গেলো। থিঙ্গিকে একপাশে নিয়ে গিয়ে কানে ফিসফিস করে বললো, ‘মজার ব্যাপার কী জানো! তোমার মতো যখন তরুণ ছিলাম তখন আমিও একজন অ্যালকেমিস্ট ছিলাম!’
এ কথায় জামাতা-শ্বশুরের খুব ভাব জমে গেলো। থিঙ্গির গোপন গবেষণা নিয়ে নানা কথা বলতে বলতে পুরোটা বিকেল কাটালো তারা। শেষ পর্যন্ত থেত উঠে দাঁড়ালো আর বললো, ‘আহা থিঙ্গি, তোমার বয়সে যখন ছিলাম তখন আমি যা যা আবিষ্কার করেছি তুমি তা তা-ই আবিষ্কার করেছো। তুমি তোমার সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছো। অভিনন্দন!’
শ্বশুরের অনুপ্রেরণা পেয়ে থিঙ্গির বুকের ওপর থেকে যেনো ভারি একটা পাথর সরলো। কিন্তু থেত আরও বলতে থাকলো, ‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু তোমার গবেষণায় একটা উপাদানের খুব অভাব দেখতে পাচ্ছি আমি। তুমি যদি সত্যিই ধুলোকে সোনায় পরিণত করতে চাও তাহলে তোমাকে এই উপাদান অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। এইতো কিছুদিন হলো আমি আমার গবেষণায় এ বিষয়টা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু দেখো, এতো গভীর মনোযোগের কাজ করার মতো বয়স আমার এখন নেই। এর জন্য দরকার প্রচুর পরিশ্রম।’
‘তাহলে আমাকে উপায়টা বলুন বাবা! আমি করতে চাই আপনার অসমাপ্ত কাজ’, বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেললো থিঙ্গি। চোখের কোণায় একটু জলও জমে উঠলো। থিঙ্গি উৎসাহী হয়ে থেতের কাছে এসে ঘেষে বসলো। তার অনেকদিনের অধরা স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সত্যি হতে যাচ্ছে। সে থেতের দিকে চেয়ে কণ্ঠ করুণ করে বললো, ‘তাহলে বাবা বলুন, কোন সে উপাদানের খোঁজ আপনি পেয়েছেন? আমি ধুলোকে সোনায় পরিণত করতে চাই।’
‘বাহ! তোমার উৎসাহ দেখে ভালো লাগছে’, থেত বললো। সে থিঙ্গির কাছে ঘেষে ফিসফিস করে বললো, ‘বাবা, গোপন উপাদানটা হলো একটা রূপালি গুড়ো, এই গুড়ো কেবল কলাগাছের পাতায় পাওয়া যায়। এর জন্য তোমার নিজেকেই কলাচাষ করতে হবে। গাছগুলো বড় হবার পর গাছের লম্বা লম্বা পাতা থেকে যে গুড়ো হবে তাই হবে জাদুর গুড়ো।’
‘কিন্তু সোনা পেতে কতোটুকু গুড়ো লাগবে বাবা?’ থিঙ্গি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘এক কিলোগ্রাম’, থেত বললো।
‘এক কিলোগ্রাম! সেতো অনেক!’, কেঁদে ফেললো থিঙ্গি, ‘এর জন্য তো দেখছি কয়েক হাজার কলাগাছ রোপন করতে হবে আমাকে!’
‘আমারও তাই ধারণা বৎস্য, কমসে কম এক হাজার গাছের পাতা লাগবে এক কেজি যাদুর গুড়ো বানাতে। এজন্যই তো আমি আমার গবেষণায় সফল হতে পারিনি’, থেত বিমর্ষ হয়ে বললো।
থিঙ্গি বললো, ‘আপনি মন খারাপ করবেন না বাবা, আপনি পারেননি তো কী হয়েছে, আমি করে দেখাবো।’ ওইদিন সন্ধ্যায় বুড়ো জ্ঞানী থেত তার জামাতা থিঙ্গিকে জাদুর রহস্য বলে দিলো, শিখিয়ে দিলো যাদুমন্ত্র, আর জমি ও কলার চারা কিনতে কিছু টাকা ঋণ দিলো।
পরদিনই থিঙ্গি তার বাড়ির পাশে এক টুকরো জমি কিনলো এবং ঘাস-লতাপাতা পরিষ্কার করে মাটিতে মই দিলো। তারপর শ্বশুরের শিখিয়ে দেওয়া যাদুমন্ত্র বিড়বিড় করে বলতে বলতে নিজেই মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুর করলো। শ্বশুরের কথামতো থিঙ্গি নিজেই এসব করলো আর চারাও রোপন করলো সে নিজে। প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই থিঙ্গি জমিতে যেতো, মনোযোগ দিয়ে দেখতো চারাগুলো ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কিনা। যদি কোথাও আগাছা, ঘাস বা পোকামাকড় পেতো তখনই তা সরিয়ে দিতো।
এভাবে একদিন কলাগাছগুলো বড় হয়ে উঠলো, সবুজ পাতায় ছেয়ে গেলো মাঠ, আর সবুজ পাতার আড়ালে থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখা গেলো কাদি কাদি কলা। থিঙ্গি সেই সবুজ পাতা থেকে রূপালি গুড়ো সংগ্রহ করতে লাগলো আর তা একটা বাক্সে যত্ন নিয়ে জমাতে লাগলো। দেখা গেলো কিছু কিছু পাতায় কোনো গুড়োই নেই। কিন্তু থিঙ্গির পুরো এক কেজি যাদুর গুড়ো দরকার। তাই সে আরও জমি কিনে ফেললো, আরও কলাগাছ চাষ করলো। দেখতে দেখতে তার বাড়ির চারপাশ সবুজে ছেয়ে গেলো। যেভাবেই হোক সফল তাকে হতেই হবে, ধুলো থেকে সোনা তৈরি করার আবিষ্কার সে করতে চায়।
এমন করে এক বছর কেটে গেলো। তারপর আরও কয়েক বছর। থিঙ্গি এবার এক কিলোগ্রাম যাদুর গুড়ো জমাতে সক্ষম হলো। যাদুর বাক্স নিয়ে সে ছুটে গেলো তার শ্বশুরের কাছে। উত্তেজনায় থিঙ্গির মুখ থেকে কথাই বেরুচ্ছিলো না। এবার সে নিশ্চয়ই ধুলো থেকে সোনা তৈরি করতে পারবে, আর সে হয়ে যাবে অনেক অনেক ধনী!
‘বাবা, এই নিন এক কেজি যাদুর গুড়ো!’, থিঙ্গি বললো।
বুড়ো জ্ঞানী থেত বললো, ‘সাবাশ আমার প্রিয় জামতা! সাবাশ!’
‘তুমি এখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছো। এখন আমি তোমাকে দেখাবো কীভাবে ধুলোকে সোনা করে ফেলতে হয়। কিন্তু তার আগে থুজাকে ডেকে নিয়ে এসো।’
থিঙ্গি একটু অবাক হলো, কিন্তু সময় যাতে নষ্ট না হয় তাই সে দৌড়ে বাড়ি গেলো আর থুজাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো।
থিঙ্গি ও থুজা দুজনেই এখন থেতের সামনে। থেত থুজাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘থুজা, থিঙ্গি যখন কলাপাতা থেকে যাদুর গুড়ো সংগ্রহ করছিলো তখন তুমি কলার কাদিগুলো কী করেছিলে?
‘কেনো বাবা? আমিতো সেগুলো বিক্রি করে দিয়েছি! আর সে টাকা দিয়েই তো সংসারের খরচ চালিয়েছি।’
‘তাহলে তো তোমার অনেক টাকা জমেছে নিশ্চয়ই? থিঙ্গি কয়েক হাজার কলাগাছ চাষ করেছে’, থেত বললো।
‘হ্যাঁ বাবা, সংসার খরচের পর যা থাকতো তা আমি সঞ্চয় করেছি’, থুজা আমতা আমতা করে বললো।
থেত বললো, ‘আমরা কি তোমার সঞ্চিত টাকাগুলো দেখতে পারি!’
‘অবশ্যই বাবা, বাড়িতে অনেক যত্ন করে আমি টাকাগুলো লুকিয়ে রেখেছি’, বলতে গিয়ে থুজার মুখ আলোকিত হয়ে উঠলো।
তারপর তিনজন মিলে থুজার বাড়িতে গেলো। থুজা তাদের চিলেকোঠায় মাটির নিচে লুকিয়ে রেখছে কয়েকটা বস্তা। সে মাটি খুঁড়ে একটা বস্তা ওপরে টেনে তুললো আর বস্তার মুখটা খুলে দিলো। থেত বস্তার ভেতরটা দেখে মুচকি হাসলো আর পুরো বস্তাটা উল্টে টেবিলের ওপর ঝেড়ে দিলো। দেখতে দেখতে পুরো টেবিল ভরে গেলো সোনার পয়সায়, ঝনঝনিয়ে উঠলো পুরো ঘর, আর সোনার আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠলো তিনজনের মুখ।
থেত কলাগাছের জমিতে গিয়ে এক মুঠো ধুলো নিয়ে এলো আর তা রাখলো সোনার পয়সাগুলোর পাশে। তারপর থিঙ্গির দিকে তাকিয়ে থেত বললো, ‘দেখলে থিঙ্গি, তুমি ধুলো নেড়ে সোনা পেয়েছো।’
তারপর থেকে থিঙ্গি আর কোনোদিন কলাপাতা থেকে যাদুর গুড়ো সংগ্রহ করলো না। কিন্তু সে আরও আরও জমি কিনে কলাচাষ করতে লাগলো। তার অ্যালকেমিস্ট শ্বশুর থেত তাকে শিখিয়ে দিলো কীভাবে ধুলো নেড়ে সোনা করতে হয়। এখন তার আর যাদুর গুড়ো দরকার নেই।
বই: দ্য ম্যাজিক পাউডার- অ্যা ফোকটেইল ফ্রম মিয়ানমার, লেখক: গ্রেস্ট্রোক, পি. জি. দীনেশ, অলঙ্করণ: পি. জি. দীনেশ, প্রকাশনী: প্রথম বুকস, প্রকাশকাল: ২০০৫