তাকে শুধু বলা যাবে না, এলআরবি’র এবি, বা ব্যান্ড সম্রাজ্যের রাজকুমার, তিনি বাংলাদেশের, বাংলা ভাষার ‘গিটার উইজার্ড’, তিনি কিংবদন্তী- আইয়ুব বাচ্চু।
Published : 18 Oct 2020, 04:57 PM
আইয়ুব বাচ্চুর প্রয়াণের দিনে তাকে স্মরণ করলেন গীতিকবি শেখ রানা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে।
গ্লিটজের পাঠকের জন্য থাকছে তার নিজ বয়ানে আইয়ুব বাচ্চুর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ।
(১)
সোলস, রেনেসাঁ, ফিড ব্যাক সহ তাবৎ ব্যান্ডের গান গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করি তখন।
নব্বই শুরু হয় হয়। একটা পালাবদল চারিদিকে। রাজনীতি, সমাজ অথবা ব্যক্তিগত মননে।
নব্বই শুরু হয়ে গেল তারপর। একটা নতুন ব্যান্ড এল। খুব সাধাসিধে প্রচ্ছদে। কিন্তু খুব নতুনত্ব নিয়ে। কারণ এর আগে ডাবল অ্যালবাম কেউ প্রকাশ করেনি। একসঙ্গে চব্বিশ গান! পত্রিকা মারফত বিনোদনের সব খবর জানা হয়ে যেত ততদিনে। হাইকোর্ট থেকে হাঁটা দূরত্ব পল্টন। একদিন সকাল, ছুটির দিন। ক্যাসেট কিনে আনি। ব্যান্ডের নাম এলআরবি। সাদা কালো দিন। প্রচ্ছদ-ও সাদা-কালো।
ঘুম ভাঙা শহর শুরু হতেই চমকে উঠি!
(২)
তার আগে থেকেই তো বাচ্চু ভাইকে চিনি। আইয়ুব বাচ্চু। কোঁকড়া ছোট করে চুল, ছোটখাট একজন মানুষ। তপন চৌধুরীর প্রথম অ্যালবামে অপূর্ব সব গানের সুর সঙ্গীত অথবা নাসিম আলী খানের ‘যতীন স্যারের ক্লাসে’, ‘পথে যেতে যেতে’। কিংবা ময়না অ্যালবামে ‘ও বন্ধু তোমায় যখনই মনে পড়ে যায়’, ‘মানবতা প্রেমেরও বাণী’, ‘দূরপাল্লা ট্রেনের কামরায়’।
(৩)
লিটল রিভার ব্যান্ড। এই নামে আগে থেকেই অস্ট্রেলিয়ান একটা ব্যান্ড থাকায় নাম পাল্টে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’। কিন্তু সত্যি বলতে এখনও অনেকে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’ নামেই এলআরবি-কে চেনে। আর চিনে গেছে দূর্দান্ত সব বিষয়ভিত্তিক গান একের পর এক।
‘হকার’-কে নিয়ে গান হতে পারে, হাসপালে শুয়ে থাকা একজন নিঃসঙ্গ রোগীর একাকিত্ব নিয়ে গান হতে পারে, ‘মাধবী’ নিয়ে হতে পারে একটা হার্ড রক, ‘রিটায়ার্ড ফাদার’য়ের অসহায়ত্ব নিয়ে তৈরি হতে পারে একটা অনুগল্প! কে ভেবেছিল আগে এ রকম করে?
অথবা ‘এক জন্মহীণ নক্ষত্রের জেগে থাকা’, এলোমেলো হয়ে থেকে জল-জোছনার গিটার উন্মাতাল, অচেনা জীবনের কোরাস। নীরবতার অসামান্য সরব উপস্থিতি আর আহা! জীবন।
আহা! জীবন!!
নতুন একটা ব্যান্ডের সফল অভিযাত্রা। শ্রোতার পছন্দ মাথায় নিয়ে গান না বেঁধে, নতুন করে শ্রোতা তৈরি করা। বাচ্চু ভাই সেই অভিযাত্রার সারথী। সঙ্গে বেজ এ স্বপন, কি বোর্ডে টুটুল আর ড্রামস এ জয়।
(৪)
সেই অল্টারনেটিভ রকে বুঁদ না হতেই একটা সুরেলা ঝড় এসে হাজির। ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে, সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম...’
‘সুখ’ অ্যালবাম আমাদের জন্য অপার্থিব সুখ নিয়ে এল। তখন বোধহয় এসএসসি-র সময়কাল। তারস্বরে চিৎকার করে গাই ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’। হাইকোর্টের বন্ধুদের সঙ্গে গলা মেলাই আর বাসায় আম্মা-আব্বার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করি। আমি ততদিনে ব্যান্ডের ভক্ত আর খুঁজে পেয়েছি আমার সবচেয়ে প্রিয় বাংলা ব্যান্ড এলআরবি। মাথায় গেঁথে গিয়েছে বাচ্চু ভাইয়ের নাম।
(৫)
একবার তারকালোক অথবা আনন্দ বিচিত্রায় কি মনে করে যেন অনেক ব্যান্ড তারকার ফোন নাম্বার দিয়ে দিল। খালাতো ভাই হাসান তখন অনেক ছোট। কিন্তু আমার পছন্দই ওর পছন্দ। মোহামেডান, আর্জেন্টিনা আর এলআরবি। আমরা বাচ্চু ভাইকে ফোন করতাম। টুলু ভাইকে ফোন করতাম। পিলু ভাইকে ফোন করতাম। একটু কথা বলতে পারলে বর্তে যেতাম।
অনেক পরে, ২০১১/১২ এর দিকে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। পার্থদা নিয়ে গিয়েছিলেন। দেখা হতেই আমি এত আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। পার্থদা আর বাচ্চু ভাই চাঁটগা ভাষায় আলাপচারিতা শুরু করলেন। আর এক পর্যায়ে পার্থদা পরিচয় করিয়ে দিলেন পরী, মার ঘুরিয়ের গীতিকার হিসেবে। আমি আরও কাচুমাচু হয়ে যাই। খুব বলতে ইচ্ছে হয়, বাচ্চু ভাই আমি আপনার কত বড় ভক্ত আমি কীভাবে বোঝাবো!
কিছু জিনিস বোঝানো যায় না, হয়না। ভিতরে ভিতরে আক্ষেপ বাড়ে কেবল। ভালোবাসার।
(৬)
আমি একটা কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। কাল যখন হাহাকার মানুষের আদল পেয়ে আমাকে আলিঙ্গন করলো তখন মনে পড়ে গেল।
৯২-৯৩ এ আমি যখন ভুল ছন্দে কবিতা লেখা শুরু করেছি, গীতিকার হব ভাবি-ই নি একবার কয়েকটা কবিতা গান ভেবে সাউন্ড গার্ডেনে স্টুডিও ক্রু পরিমলের কাছে দিয়ে এসেছিলাম। বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে সেই তারকালোক-এর সুত্রে পাওয়া ফোনালাপ ধরে। বলাই বাহুল্য সেই লিরিকগুলো বাচ্চু ভাই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আমার গীতিকার হওয়ার গল্পের সঙ্গে বাচ্চু ভাই জড়িয়ে আছেন এ ভাবেই।
বছর দুয়েক আগে ফেসবুকের কল্যাণে বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপচারিতা শুরু হয়। অংশু ভাই, বাপ্পী ভাই এর উৎসাহে বাচ্চু ভাইকে লিরিক দিয়েছিলাম দুটো। বাচ্চু ভাই পছন্দ করেছিলেন। আমি এত খুশী হয়েছিলাম, বলে বোঝাতে পারবো না।
কি একটা প্রজেক্ট করতে চেয়েছিলেন। সেটা হলো না!
আমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যান্ড তারকার জন্য আমার লিরিক গান হলো না।
(৭)
বাচ্চু ভাই, আপনাকে ভুলতে পারছিনা কেন?
আপনার সঙ্গে তো আমার খুব বেশি কথা হয়নি, দেখা হয়েছে একবার। একদিন তো চলে গেছে, আমি কেনো শোক সামলে উঠতে পারছিনা!
কেন মনে হচ্ছে আমার খুব কাছের মানুষ এর মহাপ্রয়াণ! আপনি কখন আমার এত কাছের মানুষ হয়ে গেলেন বাচ্চু ভাই! আপনার এক এক গান আমাকে গতকাল থেকে মনে করিয়ে দিচ্ছে এক একটা সময়ের কথা। এক একটা দৃশ্যকল্প চোখের সামনে ভেসে আসছে। ‘সেই তুমি’র কথা ভাবতেই বন্ধু রানাকে মনে পড়ছে। আলমগীর ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে। ‘ঘুমন্ত শহরে’র কথা ভাবতেই হাসান এর কথা মনে পড়ছে। সেই সময় এর কথা, আমার উচ্ছ্বাস-আবেগ! আমার রুপকথা নেই, আমার শুকসারি নেই গানটার কথা। এই গানটা আমার কী যে প্রিয়!
এডিনবার্গ থাকতে একদিন রাত অনেক। বাস মিস করে গেছি বাড়ি ফেরার। পরের বাস আধা ঘন্টা পর। প্লে লিস্টে গানটা চালিয়ে আপনাকে ইনবক্স করেছিলাম। মনে আছে, বাচ্চু ভাই?
(৮)
বাংলা গান শুনছি, অথচ আপনি নাই! কী এক অমোঘ সত্য অথচ সেই সত্য গলার কাছে আটকে যাচ্ছে দুঃখ হয়ে।
আমার রুপকথা নেই
আমার শুকসারি নেই
ঝাড়বাতি জ্বালানো
সাজানো সাজঘর নেই
শুধু একটা গিটার, আর একটা তুমি ছাড়া
আমার আর কিছু নেই...
শ্রদ্ধাঞ্জলী, প্রিয় বাচ্চু ভাই।