পাহাড়ে মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি খাবারের অভাবে লোকালয়ে নেমে আসছে হাতি, বানর ও অজগরসহ নানা প্রাণী।
Published : 04 Jul 2017, 02:42 PM
মিরসরাইয়ের লোকালয়ে গাছের ডালে অজগর
গাছের মগডালে অজগর, তছনছ কাকের বাসা
চলতি বছর চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় থেকে প্রাণী নেমে আসার ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন নষ্ট হওয়ায় খাবারের খোঁজে লোকালয়ে আসছে বিভিন্ন প্রাণী।
পাহাড়ি বনে বন্য প্রাণীর খাবারের সংস্থান করা না গেলে এই প্রবণতা বাড়তে পারে। এতে করে প্রাণিকূল হুমকির মুখে পড়বে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
২৩ জুন বাঁশখালী উপজেলার কালীপুর ইউনিয়নের কোকদণ্ডী গ্রামে পাহাড় থেকে নেমে আসে একটি হাতি।
“আগে এখানে হাতি আসত না। এ বছর এখন পর্যন্ত ২৭ বার হাতি নেমেছে। কখনো দলে ছয়-সাতটা আবার কখনো একটা বা দুটো হাতি আসে।”
বাড়ির আশেপাশের গাছপালা ভেঙে, বাগানের কাঁঠাল, আনারস, কলা গাছ ও বাঁশ ঝাড় খেয়ে কয়েকদিন অবস্থানের পর আবার পাহাড়ে ফিরে যায় হাতির দল।
পুলক দেবদাস বলেন, একবার নামলে দুই থেকে তিন দিন থাকে হাতি। কখনো কখনো বাড়ির উঠানেও এসে বসে। তবে এখানকার লোকজন বিরক্ত না করায় তারাও মানুষের তেমন ক্ষতি করে না।
“শুরুতে দুয়েকবার ভয় পেয়েছিলাম। এখন তেমন ভয় পাই না।”
বন বিভাগের কালীপুর ফরেস্ট রেঞ্জার শাহজাহান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড়ে হাতির খাবারের অভাব আছে। শুকনো মৌসুমে খাবারের খোঁজে হাতি তুলনামূলক বেশি লোকালয়ে নেমে আসে।
বন বিভাগ কালীপুর পাহাড়ে আগামী বছর থেকে বনায়ন শুরু করবে বলেও জানান শাহজাহান চৌধুরী।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে ৪০-৫০টি বানরের একটি দল পাশ্ববর্তী পাহাড় থেকে সীতাকুণ্ডের শম্ভুনাথ মন্দির এলাকায় নেমে আসে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী টেরিয়াইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক রতন চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মন্দিরে নিয়মিত যাই। এরকম কখনও দেখিনি।
“বাচ্চাসহ ৪০-৫০টি বানরের একটি দল হঠাৎ করে পেছনের পাহাড় থেকে নেমে আসে। তারা খুবই কাতর ছিল। মানুষের দিকে তাকিয়ে ছিল। উঁকি মারছিল এদিক ওদিক- যদি কেউ কিছু খেতে দেয়।”
রতন চক্রবর্তী বলেন, “আমিসহ মন্দিরে আসা বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী তাদের কলা কিনে দিই। বানরগুলো বেশ আগ্রহ নিয়েই খাচ্ছিল।
সীতাকুণ্ড অভ্যন্তরীণ বন বিটের বন কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খাবারের অভাব, পাহাড়ে মানুষের আনাগোনা এবং প্রবল বর্ষণের কারণে মূলত বানরগুলো পাহাড় ছেড়ে নিচে এসেছে।
“পাহাড়ে থাকা প্রাণী মূলত প্রাকৃতিক বন থেকে খাবার সংগ্রহ করে। মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় ফল গাছ তেমন নেই। ওই এলাকায় প্রবেশ করে স্থানীয়রা শাক-সবজি চাষ করছে।”
সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে প্রাকৃতিক বন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গাছের পরিমাণ তুলনামূলক কম জানিয়ে আবদুল মজিদ বলেন, “প্রাকৃতিক বনে ফলের গাছ থাকে। মনুষ্য সৃষ্ট বনে সেটা থাকে না।
“বড়তাকিয়া ও বারৈয়ারঢালা বনে কিন্তু এ ধরনের প্রবণতা নেই। সেখানে বনে গাছের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি।”
এদিকে ২৪ জুন মিরসরাই উপজেলার হিংগুলি ইউনিয়নের বৈদ্য গ্রামের বিমান কুমার দের বাড়ির জাম গাছে ১২ ফুট লম্বা ও ২০ কেজি ওজনের একটি অজগর সাপ দেখতে পায় স্থানীয়রা।
উদ্ধার করা অজগর দুটি স্থানীয় বনে মুক্ত করে বন বিভাগ।
চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের মিরসরাই অঞ্চলের কর্মকর্তা রেজাউল করিম সেদিন বলেছিলেন, খাবারের সন্ধানে অজগরটি বন ছেড়ে লোকালয়ে চলে এসেছে বলে তারা ধারণা করছেন।
স্থানীর সংবাদকর্মীরা জানান, ২০১৬ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত লোকালয়ে মোট ১৭টি অজগরের সন্ধান মেলে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক দানেশ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে আগে হাতির পর্যাপ্ত খাবার ছিল।
“গত বছর খানেক ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড় থেকে খাবারের অভাবে হাতি লোকালয়ে নেমে আসার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ প্রাকৃতিক বন ধংস করা।”
বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে পাহাড় থেকে লোকালয়ের দিকে অজগরের নেমে আসার প্রবণতা ‘স্বাভাবিক’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“সীতাকুণ্ড-মিরসরাই অঞ্চলে প্রাকৃতিক বন কেটে ফলের বাগান করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক বন না থাকলে প্রাণী যেখানে খাবার পাবে, সেখানে যাবে।”
তিনি বলেন, “পাহাড় থেকে খাবারের সন্ধানে বন্যপ্রাণীর লোকালয়ে নেমে আসার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে সংঘাত বাড়তে থাকবে।
“এটা মানুষ ও বন্যপ্রাণী উভয়ের জন্য হুমকি। দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকালয়ে আসা হাতির মৃত্যু সংবাদ গণমাধ্যমে নিয়মিত দেখতে পাই।”