আব্দুর রাজ্জাক ও শাহরিয়ার নাফীসকে কিভাবে মনে রাখবে বাংলাদেশের ক্রিকেট? রাজ্জাকের শ্রেষ্টত্ব ফুটিয়ে তুলবে পরিসংখ্যান। রেকর্ড বইয়ে আলাদা জায়গা থাকবে শাহরিয়ারেরও। দুজনকে নিয়ে প্রাপ্তির গল্প আছে। আছে অপূর্ণতার হাহাকারও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে একটি জায়গায় হয়তো দুজনকে মেলানো যায় এক বিন্দুতে-নিবেদন।
Published : 13 Feb 2021, 08:35 PM
নিবেদন ক্রিকেট খেলাটির প্রতি। দেশের ক্রিকেটের প্রতি। ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি।
প্রতিটি ক্রীড়াবিদের চাওয়া থাকে, নিজ আঙিনায় ছাপ রেখে যাওয়া। ‘লেগাসি’ তৈরি করা, উত্তরাধিকার। রাজ্জাক ও শাহরিয়ারের ‘লেগাসি’ ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি নিবেদনে। এখানে দুজন কিংবদন্তি। এখানে দুজন বাংলাদেশ ক্রিকেটে হয়ে থাকবেন সবসময়ের আদর্শ।
দুজনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অধ্যায় বন্ধ ছিল অনেক দিন ধরেই। সেখানে নতুন পাতা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আর ছিল না। শনিবার এই দুজন যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বললেন, সেটি আসলে ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই বিদায়। সেই ঘরোয়া ক্রিকেট, যা হয়ে উঠেছিল তাদের অস্তিত্বের অংশ।
২২ গজে দুজনের ব্যাট-বলের ঝংকার রেকর্ড বইয়ে তোলে গর্জন। স্বীকৃত ক্রিকেটে এক হাজার ১৪৫ উইকেট রাজ্জাকের। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবিশ্বাস্য সংখ্যা। এক হাজার উইকেটও নেই দেশের আর কারও। ৫ উইকেট নিয়েছেন মোট ৫০ বার। ১১ বার ম্যাচে ১০ উইকেট।
সঙ্গে তার রান আছে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি। অনেকেরই মনে থাকে না, ব্যাট হাতেও দারুণ এক রেকর্ড আছে তার। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্রুততম ফিফটি! (২১ বলে, যুগ্মভাবে মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে)।
শাহরিয়ার করেছেন ১৪ হাজার ৬৫৮ রান। সেঞ্চুরি ২৫টি। তিন সংস্করণেই পেয়েছেন তিন অঙ্ক ছোঁয়ার স্বাদ।
তবে এসব সংখ্যার ঝনঝনানিতে শুধু নন, তারা আলাদা ওই নিবেদনের জায়গায়।
নিবেদন তো দেশের ক্রিকেটে কতজনের কতভাবেই আছে। তবে এই দুজনের নিবেদন বিশেষ কিছু, কারণ দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে অবহেলিত জায়গাটিতেই তাদের অনুরাগ ছিল সবচেয়ে বেশি। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট!
জাতীয় লিগ, বিসিএলকে যে গুরুত্ব, পেশাদারিত্ব, আবেগ ও ভালোবাসায় তারা দেখেছেন ও খেলেছেন, এই জায়গাটায় দেশের সব ক্রিকেটারের জন্য, জাতীয় দলের ভেতরে-আশেপাশে-বাইরের ক্রিকেটার, উঠতি-লড়াইয়ে থাকা-প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার, কিংবা স্বপ্নাতুর চোখে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে থাকা কিশোর-তরুণ, সবার জন্য উদাহরণ এই দুজন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুজনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-আক্ষেপ, হাসি-হাহাকারের চর্চা হয়েছে অনেক। হবে আরও। বিদায় বেলায় আরেকবার আলতো করে ছুঁয়ে দেওয়া যেতে পারে।
শাহরিয়ারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের অধ্যায়গুলোর একটি হয়ে রইবে আরও বহুদিন। ২০০৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দল থেকে বিতর্কিতভাবে বাদ পড়ার পর প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১৬ চারে ১০১ রানের ইনিংস, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের খরার দেশে বাঁহাতি সৌন্দর্যের রোমাঞ্চ নিয়ে আবির্ভাব, লম্বা চুল আর শরীরী ভাষার দুঃসাহস, ফতুল্লার ঐন্দ্রজালিক ১৩৮, ৬ মাসের মধ্যে ৪টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির অবিশ্বাস্য অনুভূতি, এক বছরে হাজার ওয়ানডে রানের অভাবনীয় ধারাবাহিকতা…সব মিলিয়ে সেই সময়ের সাফল্য বুভুক্ষু বাংলাদেশের ক্রিকেট শাহরিয়ারের কাছে অনেক ঋণে আবদ্ধ।
আইসিএলে না গেলে তার ক্যারিয়ারের গতিপথ কেমন হতো, সেই প্রসঙ্গ তার ক্যারিয়ারের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসবেই। আইসিএল থেকে ফেরার পরও টুকটাক পারফর্ম করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, ব্যর্থ হয়েছেন আরও বেশি। খেসারত দিয়েছেন বাদ পড়ে।
তবে শাহরিয়ার বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্য উচ্চতায় উঠে গেছেন এর পরের অধ্যায়ের জন্য। ২০১৩ সালে ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার শেষ পদচারণা। ২০১৪-১৫ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ১ হাজার ৬৪ রান করেন ৬৪.২৩ গড়ে। পরের মৌসুমে এক হাজার ১১৭ রান ৬২.০৫ গড়ে। পরের মৌসুমে ৫৫.৮৭ গড়ে ৮৯৪ রান। দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা! ওই সময়টায় অন্তত একবার টেস্ট দলে ডাক না পাওয়া তার প্রতি হয়তো ছিল বড্ড অবিচার।
রাজ্জাকের ক্যারিয়ার শেষ হতে পারত আরও এক যুগ আগেই। তার বোলিং অ্যাকশনই যে ছিল ত্রুটিপূর্ণ! কিন্তু চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় নিজেকে শুধরে তিনি ফেরেন আরও ধারাল হয়ে, দোর্দণ্ড প্রতাপে। ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক, দেশের দ্রুততম ১০০ উইকেট, সবার আগে ২০০ উইকেট, ওয়ানডেতে বাঁহাতি স্পিনে বিশ্বরেকর্ড চারবার ৫ উইকেট, কত কীর্তি তার!
তারপরও তার ক্যারিয়ার শুধু আক্ষেপের গল্প নয়, বরং অর্জনের প্রতিশব্দ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গত ৮ মৌসুমের ৬টিতেই রাজ্জাক উইকেট নিয়েছেন ৫০টির বেশি করে (বাকি দুই মৌসুমে ৪২ ও ৪৩ উইকেট)। এমনকি সবশেষ মৌসুমেও তার ছিল ৫৩ উইকেট।
৫০০ উইকেট, ৬০০ উইকেট, এসব একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেটে ছিল দূর আকাশের তারা। রাজ্জাক মুঠোয় ভরে দেখিয়েছেন।
বয়স যখন ৩০ হয়ে গেছে, তখনও প্রথম শ্রেণিতে ২০০ উইকেট ছিল না তার। ৩০ পেরোনোর পর নিয়েছেন ৪৩৭ উইকেট!
এই সংখ্যাগুলোও রাজ্জাক ও শাহরিয়ারের নিবেদনের জীবন্ত স্বাক্ষী। তবে তাদের মূল নিবেদন, এই সংখ্যাগুলির জন্ম প্রক্রিয়ায়।
প্রতিটি ঘরোয়া মৌসুম শুরুর আগে রোমাঞ্চ উত্তেজনা নিয়ে তাদের অপেক্ষা, খুলনা আর দক্ষিণাঞ্চলের হয়ে রাজ্জাকের এক দিনেই ২৫-৩০ ওভার বোলিং করে যাওয়া দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ, মৌসুমের পর মৌসুম, নেতৃত্বে দলকে উজ্জীবিত করা আর ট্রফি এনে দেওয়া, শাহরিয়ারের অফ মৌসুমের খাটুনি, জাতীয় দলে ফেরার আশা ক্ষীণ জেনেও বোলিং মেশিন কিনে কসরত চালিয়ে যাওয়া, ঘরোয়া ক্রিকেটের সিস্টেম, সীমাবদ্ধতা আর প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে দুজনের লড়াই, সব মিলিয়ে দেশের ক্রিকেটের প্রতিটি দিন জানে তাদের নিবেদনের গল্প। জানে তাদের নিবেদনের মূল্য।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের প্রতি তাদের যে মমতা, বাংলাদেশের ক্রিকেট এমন কিছু দেখেনি আগে।
সেই অধ্যায়, সেই ছুটে চলা থেমে গেল আনুষ্ঠানিকভাবে।
থেমে যাওয়া মানেই অবশ্য সমাপ্তি নয়। দুজনেরই নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে ক্রিকেটের আঙিনায়। রাজ্জাক এখন জাতীয় নির্বাচক। শাহরিয়ার কাজ করবেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের ডেপুটি অপারেশন্স ম্যানেজার হিসেবে।
বিসিবিতে আগেও নানা ভূমিকায় নানা সময়ে সাবেক ক্রিকেটারদের দেখা গেছে। প্রত্যাশা পূরণ হয়নি অনেককে নিয়েই। রাজ্জাক ও শাহরিয়ারের সুযোগ আছে সেই ধারা বদলানোর, নিজেদের ছাপ রাখার।
আপাতত, গৌরবদীপ্ত খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার দিনটিতে দুজনকে কুর্নিশ জানানোই যায়!