তেলের দাম বাড়ার ঘোষণা আছে। কিন্তু চিনি, আলু, পেঁয়াজ এগুলোর দর বাড়ছে ঘোষণা ও ব্যাখ্যা ছাড়াই
Published : 05 May 2023, 08:04 PM
সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর বাজারে গিয়ে আরও ‘ধাক্কা’ খেল নগরবাসী।
মৌসুম শেষ না হতেই আলু-পেঁয়াজের দর এভাবে কেন বাড়ছে বুঝে উঠতে পারছে না তারা। আর কয়েক মাস আগেই একশ টাকার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া চিনি বাজার থেকে উধাও হওয়ার দশা।
চিনি সরকারের ঠিক করে দেওয়া দরে পাওয়া যাচ্ছে না বহু মাস ধরেই। এ নিয়ে সরকারি সংস্থার কার্যকর কোনো তৎপরতাও নেই। এখন দোকান থেকে পণ্যটি হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর দাম আরও বাড়বে, সেটি বলে দিচ্ছেন বিক্রেতারা।
দেশে উৎপাদিত আলু ও পেঁয়াজের দর সরকার ঠিক করে দেয়নি। ঈদের আগে আগে রান্নার এ দুটি উপকরণের দাম লাফাতে থাকে। কেন, সে প্রশ্ন ক্রেতাদের মুখে মুখে।
সব মিলিয়ে মাসের প্রথম শুক্রবার বাজারদর মানুষের বিরক্তি আরও খানিকটা বাড়িয়েছে। ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির ‘ধাক্কা’ সামাল দেওয়া সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য কতটা কঠিন, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তারা।
মিরপুরের কাজীপাড়া বাজারে দেখা হল আমিনুর রহমানের সঙ্গে। ক্রমেই বাড়তে থাকা বাজার খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে তিনি কমাচ্ছেন অন্য খরচ। কিন্তু শখ আহ্লাদ সব বাদ দিয়ে টাকা বাঁচানোর সব পথই গেছে বন্ধ।
“এভাবে চলে বলেন? তেলের দাম আবার বেড়েছে। চিনির দাম অনেক। ফিক্সড ইনকাম, আমাদের তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। পেঁয়াজ কিনতে গেলাম ৬০ টাকা কেজি। রোজায় ছিল ৩৫ টাকা। হুট করে এত কীভাবে বাড়ে,” প্রশ্ন তার।
“পাঁচ লিটার তেল কিনে হাজার টাকা শেষ। হাতে আর পাঁচশ টাকা আছে। এটা দিয়া মাছ মাংসই কী নেব, আর অন্য বাজারই বা কী করব,” হতাশা ঝরে পড়ে আমিনুরের কণ্ঠে।
কিছু দোকানে এখনও আগের দরের তেল
বৃহস্পতিবার লিটারে ১২ টাকা করে বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ দাম ঠিক করা হয় ১৯৯ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে করা হয়ে ১৭৬ টাকা।
তবে কারওয়ান বাজারে কয়েকটি দোকানে আগের দামের বোতল দেখা গেছে। সেই দোকানিদের একজন ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, “নতুন তেল ঢুকে নাই। ৫ লিটার তেল পুরনো দামে ৯০০ টাকা, আর এক লিটার ১৮৭ টাকা।"
কিচেন মার্কেটের পাইকারি তেলের ডিলাররা বলছেন, এখনও নতুন দরের তেল বাজারে না আসায় বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই।
তবে খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে দাম ছাপা না থাকার সুযোগ নিচ্ছেন বিক্রেতারা। আগের দিন দাম ছিল লিটারে ১৬৮, সেটি হয়ে গেছে ১৭৬ টাকা টাকা।
চিনি এখন ‘তেতো’
রোজার মাঝামাঝি সময়ে প্রতিকেজি চিনির দাম কেজিতে তিন টাকা করে কমানোর ঘোষণা আসে। তবে তার প্রভাব বাজারে দেখা যায়নি।
খোলা চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১০৪ আর প্যাকেটের চিনির দর হওয়ার কথা ছিল ১০৯ টাকা। কিন্তু এই দরে একদিনও চিনির দেখা মেলেনি।
শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন মুদি দোকানে খোলা চিনি ১৩৫ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে প্যাকেটের চিনির দেখাই মিলছে না। পাইকারি কারওয়ান বাজারেও একই চিত্র।
মিরপুরের দুই খুচরা বাজারে খোলা চিনি মিললেও প্যাকেটের চিনি পাওয়া যায়নি। সেই চিনি আবার সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে ২৬ টাকা বেশি। ১৩০ এর নিচে কেউ বেচবে না।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা ওমর ফারুকের দোকানেও একই চিত্র। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে বলেন, “খোলা চিনি ১৩০-১৩৫ টাকা কেজি। চিনি দেয় না, ঈদের তিন চার দিন আগ থেকেই চিনি দেওয়া বন্ধ। সিটি, মেঘনা, এস আলম এরা কেউ এক কেজি চিনিও দেয় নাই।”
মো. মাসুম নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, “কোম্পানিই তো মারা গেছে ভাই। বাজারে সাদা চিনির প্যাকেট নাই। লাল চিনি আছে। দাম ১৫০।”
কেন চিনি নেই? বিক্রেতা বললেন, “চিনি বাজারে ক্যান যে নাই, এইটা আমি আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবর কইতে পারমু না। ডিলার আর সরকাররে জিগান। তারা জানব চিনি ক্যান নাই।”
বাজারের দোতলায় চিনির ডিলার মো. করিম বলেন, “আমরা মালই তো পাই না, নানান পার্টি থাইকা কিইন্না বেচি। হেরা সরকারের দেওয়া রেইটে আমগোরে না দিলে, আমরা তো লসে বেচুম না।”
নিজের সাম্প্রতিক কেনা চিনির দরের ফর্দও দেখান তিনি। সেখানে দেখা যায় এই ব্যবসায়ী ৫০ কেজির ৮০ বস্তা চিনি কেনেছেন প্রতি বস্তা ৬ হাজার ২৯২ টাকা দরে। তিনি নেন ৬ হাজার ৩০০ টাকা। কেজি পড়ে ১২৬। সেই চিনিই নিচের তলার খুচরা দোকানে বিক্রি হয় ১৩৫ টাকা কেজি দরে।
দামের এই অবস্থায় চিনি বিক্রিই বন্ধ রেখেছেন মা বাবার দোয়া জেনারেল স্টোরের ফজলে রাব্বি। তিনি বললেন, “ক্যাচালের কী দরকার? চিনি ছাড়া ব্যবসা চলতাছে না? ব্যবসা একটু কম করুম। ডিলারে দেয় আমরা আনি না। সরকার যে রেইট দেয় সেই রেইটে তো আমরা ডিলারের কাছে পাই না।”
আদা-পেঁয়াজের দর চড়ছেই
বাসার জন্যে একটু বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ কিনতে কারওয়ানবাজারে এসেছিলেন সুজন মিয়া। ৩২০ টাকায় কিনতে পেরেছেন এক পাল্লা বা পাঁচ কেজি। দাম পড়েছে ৬৪ টাকা করে।
বিস্মিত সুজন বলেন, “রমজানে পেঁয়াজ কিনেছি ১৪০০ টাকা মণ। কেজিতে হয় ৩৫ টাকা। এই কয়েক দিনে আরও এক হাজার টাকা বেড়ে গেছে!”
ব্যাপারীরা বলছেন, দেশি জাতের ফলন কম হয়েছে। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ। এই দুইয়ের প্রভাব বাজারে।
আব্দুল মান্নান নামে এক ব্যাপারী বলেন, “চাহিদা বেশি। আমদানি কম। চাহিদা ২০০ মণ হইলে আমদানি হচ্ছে ১৫০। তো ঘাটতি। আবার যাদের দরকার ২০ কেজি সে ৪০ কেজি নিচ্ছে সারা বছর রাইখা খাবে। সারা বছর তো আর দাম বাড়ে নাই। এইসব কারণে এখন দামটা বাড়তেছে। ভারতের পেঁয়াজ না আসলে দাম বাড়তে থাকবে।“
নিত্য দিন দাম বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “পেঁয়াজের বস্তা কাটা হচ্ছে ৫৬ টাকায়, আর ভাইঙ্গা খুচরা ৫৮ টাকা। আস্তে আস্তে বাড়ছে এই দাম, আজকে ২ টাকা কালকে ৩ টাকা এইভাবে। হুট কইরা বাড়ে নাই।”
আলু দৌড়াচ্ছে পেঁয়াজের পাশে। বড় আকারেরটি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে, লাল আলুর দর আরও ১০ টাকা বেশি কেজিতে। অথচ রমজানে বড় আলুর দাম ছিল ২০ থেকে ৫০ টাকা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক সপ্তাহ আগে দর ছিল ২৮ থেকে ৩০ টাকা, এক মাস আগে ২২ থেকে ২৫।
আদাও বাদ যাচ্ছে না। পাইকারি আদা বিক্রেতা আজিজুর রহমান বাচ্চু বলেন, “ইন্দোনেশিয়ান আদায় কেজিতে ১৫০ টাকা বাড়ছে, বার্মার আদায় বাড়ছে ১০০ টাকা, চায়না আদায় দাম বাড়ছে ১০০ টাকা। চায়না এখন ৩২০, ইন্দোনেশিয়ান ৩৫০, আর বার্মারটা ২২০ টাকা।”
দাম বাড়তি জিরারও। রমজান মাসের পর কেজিতে প্রায় ৩০০ টাকা বেড়ে এক কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ টাকায়।
কমতি কিছুই নেই
ঈদের পরপর রাজধানীতে যখন মানুষের সংখ্যা ছিল কম, সে সময় সবজির দরে কিছুটা হলেও মিলেছিল স্বস্তি। ‘নীড় থেকে’ সবার নগরে ফেরার পর উবে গেছে সেটাও।
কেজিপ্রতি মিষ্টি কুমড়া বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, সজনে ১৪০, পেঁপে ৭০ থেকে ৮০, বেগুন ৬০ থেকে ৮০, বরবটি ও কাঁকরোল ৮০, তিন তিন আগেও ৪০ টাকায় বিক্রি হওয়া ঢেঁড়স ৬০ থেকে ৭০, পটল ৫০ ছাড়িয়ে, চিচিঙ্গা ও শসা ৬০, গাজর ও ঝিঙা ৮০ টাকায় এবং টমেটো ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
মাঝারি আকারের চাল কুমড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ছোট আকারের লাউয়ের দাম ৫০ এর নিচে পাওয়া কঠিন।
ব্রয়লার মুরগি রোজার আগের মত আবার চড়েছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকা দরে। সোনালী মুরগির কেজি ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা।
লাল ডিমের দাম ডজন এখন কমসেকম ১৪০ টাকা, সাদা ডিমের ১২০ টাকা।
ঈদের পরে দাম কমেনি গরুর মাংসের। কেজি এখন ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা, খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকা।