মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে ৩৩ জনকে গুলি করে হত্যার দায়ে একাত্তরের রাজাকার কমান্ডার মোবারক হোসেনের ফাঁসির রায় এসেছে, যিনি পরে ভোল পাল্টে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগ নেতা বনে যান।
Published : 24 Nov 2014, 05:34 PM
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এই যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় ঘোষণা করে।
রায়ে বলা হয়, মোবারকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এর মধ্যে ১ নম্বর অভিযোগে আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামের ৩৩ জনকে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৩ নম্বরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী আব্দুল খালেককে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগে আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
রায়ে বলা হয়, “আসামি মোবারক যে ১ ও ৩ নম্বর অভিযোগের ঘটনায় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি অপরাধে যুক্ত ছিলেন তা সাক্ষীদের বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, সেই ভূমিকার জন্য নিজের এলাকাতেও তার রাজাকার হিসাবে কুখ্যাতি আছে।”
তবে প্রসিকিউশন অপরাধের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে না পারায় ২, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে মোবারককে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
একাত্তর পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করলেও মোবারক পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং এক পর্যায়ে আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তিন বছর আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সর্বোচ্চ সাজা
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২২ অগাস্ট আখাউড়ার টানমান্দাইল গ্রামের হাজী নূর বক্সের বাড়িতে ১৩০/১৩২ জন গ্রামবাসীকে জড়ো করেন মোবারক ও তার রাজাকার সহযোগীরা। পরে তাদের আটক করে নৌকায় করে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে সেখানে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হয়। এরপর ৩৩ জনকে বাছাই করে আটকে রাখা হয় তেরজুড়ি হাজতখানায়। পরদিন ২৩ অগাস্ট পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ওই ৩৩ জনকে দীঘির পাড়ে পানিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(২)(এ)(জি), ২০(২) এবং ৪(১) ধারা অনুযায়ী এ ঘটনায় মোবারককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
যাবজ্জীবন
অভিযোগ ৩: মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানার ছাতিয়ান গ্রাম থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতাকারী আব্দুল খালেককে অপহরণ করে মোবারক ও তার সহযোগী রাজাকাররা। তাকে সুহিলপুর রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়, যার প্রত্যক্ষদর্শী তার ছেলে রফিকুল ইসলাম। একই রাতে তাকে তিতাস নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার পরে মোবারক বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খালেকের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় মোবারককে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তিন অভিযোগে খালাস
অভিযোগ ২: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হিন্দু মন্দির ‘আনন্দময়ী কালীবাড়ী’ দখল করে ‘রাজাকার মঞ্জিল’ নামকরণ করে মোবারক ও তার সহযোগী রাজাকাররা। তারা মন্দিরের সব ধনসম্পদও লুট করে। ২৪ অক্টোবর শিমরাইল গ্রামের উমেশ চন্দ্র দেবের ছেলে কলেজ ছাত্র আশুরঞ্জনকে ধরে এনে সেখানে চার দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তাকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে বলা হলে সে ‘জয় বাংলা’ বলে। এরপর তাকে কুরুলিয়া খালে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ২৪/২৫ নভেম্বর দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার খড়মপুর গ্রাম থেকে খাদেম হোসেন খানকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বসানো পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায় মোবারক ও তার সহযোগী রাজাকাররা। সেখানে তাকে পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেল হাজতে নিয়ে আটকে রাখা হয়।
অভিযোগ ৫: ওই বছর ২৮/২৯ নভেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার খড়মপুর গ্রামের আব্দুল মালেক এবং আমিনপাড়ার মো. সিরাজকে তাদের বাড়ি থেকে অপহরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাকে আটকে রাখা হয় স্থানীয় জেলখানায়। ৬ ডিসেম্বর সিরাজসহ আরো কয়েকজনকে কুরুলিয়া খালে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই তিন ঘটনায় মোবারকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ২০(২) এবং ৪(১) ধারায় লুটপাট, অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল। তবে অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
এই পাঁচ ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল মোবারকের বিচার শুরু হয়। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ৩০ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন।