গতকাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার মুখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে ফোন পেলাম: শওকত ভাই, শুনেছেন নিশ্চয়। কাজী আনোয়ার হোসেন বিকেলে মারা গেছেন। বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো লাগলো আমার কাছে।
Published : 20 Jan 2022, 01:08 PM
আমরা যারা সেবায় লিখেছি, এখনও লিখছি, যারা সেবার বই পড়ে বড় হয়েছি, আমাদের সবার কাছে কাজীদা নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। কাজীদার কুয়াশা এবং মাসুদ রানা আর আমাদের একটা প্রজন্মের বেড়ে ওঠা প্রায় সমার্থক।
কাজীদার সাথে পরিচয়ের বয়স কত হবে? হিসাব মেলানো কঠিন। চাক্ষুষ পরিচয় ১৯৮৫ সালে হলেও কাজীদাকে চিনি অনেক অনেক দিন আগে থেকে।
আমি যখন খুব ছোট, গল্পের বই পড়া ধরেছি মাত্র, চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম বেড়াতে। সিআরবিতে তখন আমার খালা থাকতেন। টিলার চূড়ায় দালান। সামনে খোলা উঠোন। উঠোন ঘেষে বিশাল গাছের সারি।
খালার বাড়িতে বুক শেলফ ঠাসা বই। সেখানেই হঠাৎ চোখ গেল কুয়াশা সিরিজের একটা বইয়ের দিকে। প্রচ্ছদে দানবীয় এক মানুষের ছবি। দেখলেই পিলে চমকে ওঠে।
কেন যেন বইটা আমার কৌতূহল উসকে দিল। বিকেলে বাইরের সিঁড়িতে বসে পড়তে শুরু করলাম। কখন যে সন্ধ্যা মিলিয়েছে বলতে পারব না, এমন মজে গিয়েছিলাম।
শেষে সহসা তক্ষকের ডাকে ঘোর ভাঙল। চমকে উঠে দেখি আশপাশে নেই কেউ। মনে হচ্ছিল আমার পেছনে বুঝি এসে হাজির হয়েছে ছাপা হরফ থেকে প্রাণ পাওয়া দানব! হুড়মুড় করে তখন ঘরে ঢুকে পড়ি।
এরপর আর অনেক দিন সিরিজের কোনো বই চোখে পড়েনি। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। এই অবসরে মাঝে মাঝে অন্যান্য বই পড়েছি, তবে বই পড়ার নেশা তখনও ধরেনি।
ছোট বেলায় মাকে দেখতাম শহরের বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে পড়তেন। সেটাও আমার মনে বইয়ের প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি করেছিল।
যা হোক, চাকরি থেকে বাবা অবসর নেওয়ার পর আমরা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি সেই ১৯৭৩ সালের দিকে। মফস্বল থেকে ঢাকায় আসার পর আমার জগৎ হয়ে পড়ে সীমিত। সেই সময় হঠাৎ করে আবার একদিন আমার বড় ভাই কুয়াশা সিরিজের দুটি বই, ৩৫ ও ৩৬ এনে দেন।
বই দুটি পড়ে সিরিজের বাকি বইগুলোও ধীরে ধীরে জোগাড় করে পড়তে শুরু করি। তখনই কাজীদার ভক্ত পাঠক হয়ে উঠি আমি।
সেবায় কুয়াশার প্রুফ দেখেছি। প্রুফ দেখার হাতে খড়ি আমার সেবাতেই। কাজীদাকে এক নজর দেখার আশায় উঁকিঝুঁকি মারতাম। তখন তো কাজীদাই আমাদের নায়ক। (যদিও দেখা হয়ে গিয়েছিল হাকিম ভাইয়ের সাথে!)
তিনি কী করেন, কী তার শখ, এসব নিয়ে মেতে ছিলাম। সেবার তখনকার ব্যবস্থাপক জনাব কুদ্দুসের কাছ থেকে বেশ কিছু পুরনো কুয়াশা জোগাড় করেছি। কুয়াশার খোঁজে পায়ে হেঁটে বাংলাবাজার ঢুঁড়ে বেরিয়েছি। কুয়াশা থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পর্যন্ত নানা কিছু লেখার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছি! যদিও সেসব লেখা এখন কোথায় হারিয়ে গেছে, খোদা মালুম।
এইচএসসি পাশ করার পড়ার আমি চলে যাই চট্টগামে, ওখানেই পড়াশোনা শেষ করেছি। ১৯৮৪ সালের দিকের কথা, তখন এরশাদ ক্ষমতায়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। অনার্স পরীক্ষার ঠিক আগে আন্দোলন ঠেকাতে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর নাম দিয়েছিলাম এরশাদ ভ্যাকেশন।
এই আচমকা বন্ধের সময় হঠাৎ মনে হলো একটা বই অনুবাদ করে ফেললে কেমন হয়? সেই সুবাদে অনেক চেষ্টাচরিত্র করে আর্থার হেইলির রানওয়ে জিরো এইট তর্জমা করলাম। সাহস করে পাঠিয়ে দিলাম সেবায়। তারপর অনিশ্চিত অপেক্ষা।
শেষে ধৈর্য হারা হয়ে হাজির হলাম সেবায়। অনেকদিনের ব্যবধানে মনে হলো কুদ্দুস সাহেব আমার কথা ভুলে গেছেন। যাই হোক, শুকনো মুখে তিনি জানালেন, আমার অনুবাদ বাতিল হয়ে গেছে। চাইলে পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে নিতে পারি।
কি আর করা! প্রত্যাখ্যাত পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে দেখলাম একটা চিরকুটে গোটা গোটা স্পষ্ট হরফে কাজীদা কিছু মন্তব্য করেছেন। যার মানে ঘষেমেজে লেখাটাকে আরেকটু মানুষ করা গেলে ছাপানোর আশা আছে।
সেই আশায় বাড়িতে মা আর ছোট বোনের অকৃপণ সহায়তায় (মানে লেখাটা পাঠযোগ্য হলো কিনা সেটা যাচাই করা আরকি) ফের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে জমা দিলাম। তারপর আবার অপেক্ষা। কিন্তু অনেকদিন খবর নেই।
সেটা ১৯৮৫ সালের অক্টোবর। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আবার হাজির হলাম সেবায়। খোঁজ নিতেই কুদ্দুস সাহেব বললেন ‘সাহেব’, মানে কাজীদা দেখা করতে বলেছেন!
আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া! কাজীদা তখন পুরোনো কাজী মঞ্জিলের একটা কামরায় বসতেন। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে পরিচয় দিলাম।
কাজীদা বললেন, ‘বসুন।’
কাজীদার সামনে বসব? আমার তখন মেজর জেনারেল বুড়ো রাহাত খানের সামনে বিসিআই এজেন্টদের দশা!
বললাম, আমাকে তুমি করে বললেই খুশি হব। কাজীদা বললেন, ‘তোমার জন্যে খবর আছে!’ বলে উঠে পেছনের শেলফ থেকে রানওয়ে জিরো এইটের দুটো ঝকঝকে কপি আমার হাতে তুলে দিলেন।
সেই শুরু। প্রথম পরিচয়ের সেদিন আমাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। তার হাতেই আমার হাতে খড়ি বলা যায়। এক সময় জানতে চাইলেন, আমি আরও লিখতে চাই কিনা। বললাম হ্যাঁ। ওয়েস্টার্ন সিরিজের প্রতি আমার আগ্রহের কথা শুনে উৎসাহ জোগালেন। আমিও উঠে পড়ে লাগলাম।
আমার লেখা ওয়েস্টার্নগুলো তখন বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেবায় প্রায় দশ বছর একটানা লিখে গেছি। কাজীদার সাথে কোনও বিষয়ে দেখা করতে বা কথা বলতে কোনও বাধা ছিল না। অন্তত আমি আমার পছন্দমতো যে কোনো বই লিখতে পেরেছি। তার বিপুল সংগ্রহ থেকে স্বাধীনভাবে বই এনে পড়েছি মাসুদ রানাসহ বিভিন্ন সিরিজের উপযুক্ত কাহিনী বাছাই করতে।
আমাকে তিনি রহস্যপত্রিকায় নিয়মিত লিখতে উৎসাহিত করেছেন। সেবা অঙ্গ প্রতিষ্ঠান প্রজাপতি থেকেও তার উৎসাহেই তখন অবধি আমার একমাত্র বোর্ড-বাঁধাই বই ‘ছন্নছাড়া’ বেরিয়েছিল।
এখন আমার মনে হয়, কাজীদা বোধহয় আমাকে একটু অন্যভাবেই দেখতেন। একটা সময় সেবায় লেখা থেকে বিরতি নিয়ে আমি ভিন্ন ধরনের বই অনুবাদে মনোযোগী হয়ে পড়ি। সেবার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও মাঝেমাঝেই কাজীদার খবর নানাভাবে পেতাম। বেশ কিছুদিন আগে কাজীদা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে কাজীদার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
তখন কিন্তু একবারও মনে হয়নি যে দীর্ঘ প্রায় বিশ/বাইশ বছরের ব্যবধানে আমাদের দেখা হচ্ছে। সেদিনও অনেক কথা হয় তার সাথে। এরপরও আরও বেশ কয়েকবার কাজীদার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে গেছি। তিনি আমাকে প্রচুর সময় দিয়েছেন।
আমার প্রতি তার স্নেহে খাদ ছিল না এটা এখন বুঝতে পারি। কাজীদার সাথে শেষ দেখা গত ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯। গিয়েছিলাম সেবছর বইমেলায় বেরুনো কাজীদাকে উৎসর্গ করা আমার অনুবাদ গ্রন্থ আইজ্যাক আসিমভের আই, রোবট তার হাতে তুলে দিতে।
সেটা ছিল তার প্রতি আমার ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষুদ্র প্রয়াস। বইটি হাতে পেয়ে তিনি যে কত খুশি হয়েছিলেন, সেটা তার বইটি বারবার নাড়াচাড়া করে উল্টেপাল্টে দেখার ভেতরই বোঝা যাচ্ছিল।
সেদিন তার গল্পগন্থ পঞ্চ রোমাঞ্চের কমিক্স ভার্শনে অটোগ্রাফও নিয়ে এসেছিলাম। এবারও কাজীদা লিখলেন: ‘সুপ্রিয় শওকত হোসেনকে অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা-কাজী আনোয়ার হোসেন-৭.১২.২০১৯।’
আজ কাজীদা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। কোনও কিছুই তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু তার সৃষ্টি মাসুদ রানা, কুয়াশাসহ অন্যান্য স্মরণীয় চরিত্রগুলো আমাদের আপন হয়ে থাকবে।
তার কাছেই আমরা বিশ্ব সাহিত্যের অসাধারণ সব বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। রুদ্র প্রয়াগের চিতার মতো শিকার কাহিনী, স্যাবটাজের মতো যুদ্ধ-উপন্যাস, মন্টেজুমার মেয়েরের মতো ক্লাসিক, তিন গোয়েন্দার মতো কিশোর থ্রিলার, আলেয়ার পিছের মতো ওয়েস্টার্ন, কি বের হয়নি তার সেবা থেকে?
ছায়া অরণ্য, তিনটি উপন্যাসিকা, পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছয় রোমাঞ্চের মতো অসাধারণ গল্প সঙ্কলনও তো সেবা থেকেই বেরিয়েছে! আমরা পাগলের মতো এসব বই পড়েছি! আমাদের ঘরোয়া আড্ডার বিষয়ও প্রায়ই হয়ে দাঁড়াত সেবার বই!
এক আসাধারণ কৈশোর আর তারুণ্য কাটানোর সুযোগ করে দেওয়ার বিরাট কৃতিত্বের দাবিদার তো কাজীদাই। তার হাত ধরে অসংখ্য লেখক গড়ে উঠেছেন, পাঠক তৈরি হয়েছেন। তিনি আজ চলে গেছেন অনন্ত জীবনে। বিদায়, কাজীদা!
আমরা এখন কেবল তার অনন্ত জীবনে আত্মার শান্তির জন্যে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করতে পারি। মহান করুণাময় তাকে অপার শান্তি দিন।
আই, রোবট-এর উৎসর্গপত্রের লেখাটি এখানে তুলে ধরে কাজীদার প্রতি আমার ঋণ এবং কৃতজ্ঞাটুকু আবার স্বীকার করছি।
শ্রদ্ধেয় কাজী আনোয়ার হোসেন (কাজীদা)
আপনার হয়তো মনে আছে, আজ থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর আগে, এই আমার অনিশ্চিত হাতে সদ্য ছাপাখানা থেকে আসা রানওয়ে জিরো-এইটের দুটি ঝকঝকে কপি তুলে দিয়েছিলেন! সেই দিনের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে! সেদিনের পথ ধরে আজ এই যে এপর্যন্ত এসেছি, সে অনেকটা আপনারই অনুপ্রেরণা আর উৎসাহে। আপনার কাছে এই সুযোগে ঋণ স্বীকার করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি। আপনি ভালো থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
[শওকত হোসেন: ওয়েস্টার্ন ও থ্রিলার লেখক, অনুবাদক। সেবাসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে তার অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পেশাগত জীবনে একজন ব্যাংকার। লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।]