রহস্যভেদী মাসুদ রানার স্রষ্টা ছিলেন, কিন্তু নিজেকে রেখেছিলেন অনেকটাই রহস্যে মুড়িয়ে, সেই রহস্যের যবনিকাপাত হল।
Published : 19 Jan 2022, 11:46 PM
জেমস বন্ডের স্বাদ বাংলাদেশের পাঠকদের মাসুদ রানার মাধ্যমে দিয়ে অনেকের কৈশোরের নায়কের আসনে ঠাঁই করে নেওয়া কাজী আনোয়ার হোসেন বুধবার চলে গেলেন চিরতরে, ৮৫ বছর বয়সে।
“আমার একজন নায়ক চলে গেলেন। কাজী আনোয়ার হোসেন। এই মানুষটিকে সুশীল সমাজ প্রকৃত মূল্যায়ন করে নাই। তিনি কোটি পাঠকের আনন্দে বেঁচে থাকবেন বহুকাল,” খবরটি শুনেই ফেইসবুকে লিখেছেন চিকিৎসক-গণমাধ্যমকর্মী আবদুর নূর তুষার।
মাসুদ রানার নেপথ্য পুরুষ কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেকে রাখতেন আড়ালে। প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যেত না বললেই চলে, গণমাধ্যমও এড়িয়ে চলতেন। সাক্ষাৎকার দিতেন কালেভদ্রে। তাই তাকে নিয়ে রয়েছে নানা গল্পও।
তার সাহচর্য পাওয়া সেবা প্রকাশনীর লেখক রওশন জামিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি বরাবরই নিভৃতচারী, কখনও ইন্টারভিউ দিতে চাইতেন না। গণমাধ্যম কথা বলতে চাইলে লিখিত প্রশ্ন দিতে বলতেন। উনার মুখে কথা আটকে যেত। এজন্য এড়িয়ে যেতেন, কথা বলতে বেশি পছন্দ করতেন না।”
লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, সম্পাদক, গায়ক, আলোকচিত্রী- নানা পরিচয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় তাকে; কিন্তু মাসুদ রানার স্রষ্টা, এই পরিচয়ের পেছনে পড়ে যাবে সব। আর অগুনতি পাঠকের কাছে তার একটিই নাম ‘কাজীদা’।
আর তার মাসুদ রানা কতটা শিহরিত করত, তা উঠে এলে লেখক-সাংবাদিক সৈয়দ তারিকের কথায়।
“মাসুদ রানা- আরও অনেকের মতো আমার পাঠক জীবনের এক শিহরণময় স্মৃতিকাতর নাম। যৌবনেই এক সময় পাঠকের মৃত্যু হয়েছিল, মাসুদ রানা পড়বার আকর্ষণ আর থাকেনি। কিন্তু যে সময়কাল মাসুদ রানা পড়তে শুরু করেছিলাম, মাসুদ রানার সাথে মানস-বিহার করেছিলাম, সেই সময়ের স্মৃতি, রোমাঞ্চ, উদ্দীপনার সারাংশ আমার সত্তায় মিশে আছে। এখনও তা উদ্বেলিত করে মনের কোনো-কোনো প্রান্তকে।”
গণিতজ্ঞ-দাবাড়ু অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে রহস্যোপন্যাস-রোমাঞ্চোপন্যাস জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে থাকবেন সবার উপরে। পেপারব্যাক বই জনপ্রিয় করে তুলতেও সামনে আসবে তার নাম। ওয়েস্টার্ন ঘরানার বইও বাঙালি পাঠক বাংলায় প্রথম পায় তার মাধ্যমে।
হাকলবেরি ফিন, টম সয়্যার, রবিন হুড, থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের রোমাঞ্চে বাংলার কিশোর মনকে রাঙিয়ে তোলা কিংবা তিন গোয়েন্দার রহস্যভেদে কৌতূহলী করে তোলার কাজটি এই কাজী আনোয়ার হোসেনই করে গেছেন।
কেন- তার উত্তরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে গেছেন- “রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি কৈশোরের সেই অমোঘ টান, বড় হয়েও যায়নি আমার। শুধু নিজে মজা পেয়েই সাধ মেটেনি, আমি যে মজা পাচ্ছি, পাঠককে তার ভাগ দেওয়ার প্রবল ইচ্ছাও সম্ভবত তারাই জন্মে দিয়েছিলেন আমার মধ্যে।”
চটুল কিংবা লঘু- এমন কথা বলে সাহিত্য সমালোচকরা তার বই সরিয়ে রাখলেও সেই মানদণ্ড তার জনপ্রিয়তায় অনুবাদ হয়নি।
এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন তার জবাবের সুরেই বলেছিলেন, “আমার খাতিরে বা আমার মুখ চেয়ে পাঠকেরা এসব বই কিনে পড়ছেন, ব্যাপারটা তা তো নয়, নিশ্চয়ই এসব কাহিনির ভেতর অন্তর্নিহিত বিশেষ কিছু আকর্ষণ ও আবেদন রয়েছে, যেগুলো সমালোচকদের চোখ এড়িয়ে গেছে।
“তা না হলে যেসব সুসাহিত্যিক এত দিন মাসুদ রানার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে নিজেদের অনেক উঁচুতে তুললেন, এতগুলো বছর চেষ্টা করেও তারা কি পাঠকদের এসব বাজে লেখা থেকে সরিয়ে নিজেদের লেখার প্রতি টানতে পেরেছেন? না।”
“লঘু বলেন বা বলেন অকিঞ্চিৎকর সাহিত্য; আমি আমার ভালোবাসার জগতে দিব্যি আরামে ও আনন্দে বিচরণ করছি আজীবন,” নিজের লেখা নিয়ে তার মূল্যায়ন ছিল এমনই।
আর ৪০ বছর ধরে ‘কাজীদা’র সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে থাকা রওশন জামিল বলেন, “রহস্য গল্পের সাহিত্যধারা সৃষ্টিতে কাজী আনোয়ার হোসেন সফলতম একজন। মাসুদ রানা যেভাবে আধুনিকমনস্ক রহস্য পুরুষের ধারণা পেশ করেছিল, এটা বাঙালি পুরুষ পাঠক লুফে নিয়েছিল। সেটা একটা বিরাট ব্যাপার। এরপর কিশোর পাঠকদের জন্য কিশোর গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দাসহ নানা বই বের করার ফলে সেবাকেন্দ্রিক বড় পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হল।
“রেলওয়েতে সব খানে পাওয়া যায়, খুব দাম বেশি না, উনি সতর্ক থাকতেন দাম যেন বেশি না হয়, গোয়েন্দা পড়ে যারা বড় হয়েছেন বহু ছেলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করে উনার অবদানের কথা।”
কাজী আনোয়ার হোসেনের গুরুত্ব কোথায়- তার ব্যাখ্যায় অনুবাদক-সাহিত্যিক অধ্যাপক জি এইচ হাবীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনি কয়েকটা জিনিস করেছিলেন- পেপার ব্যাকের মাধ্যমে, নিউজপ্রিন্টের কাগজের মাধ্যমে বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য বাইরের সব গল্প, কাহিনী তুলে দিলেন- এটা একটা দিক। সেই সঙ্গে বইগুলোর বানান, শুদ্ধ বাংলা এবং গতিশীল বাংলা হাতে তুলে দিলেন। আর মার্কেটিং। সবার হাতে বই তুলে দিতে পেরেছেন।”
মোবাইল ফোন, সোশাল মিডিয়াবিহীন অবস্থায় মানুষের পড়াশোনার জগত বিস্তৃত করতে কাজী আনোয়ারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মানেন জি এইচ হাবীব।
“মানুষের পড়ার, জানার যে ক্ষুধা ছিল এটা স্বল্প মূল্যে সবার হাতে বই তুলে দিতে পেরেছেন। রেল স্টেশন থেকে পাঠাগার সবখানে পাঠকদের হাতে হাতে বই সহজপ্রাপ্যতা এবং কোটি পাঠক সৃষ্টির বিষয়টি অনেক বড় ব্যাপার। যা উনি করতে পেরেছিলেন।”
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ঢাকায়, ম্যাট্রিক পাস করেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে, ইন্টারমিডিয়েট ও বিএ পাসে করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। এরপর এমএ ডিগ্রি নেন বাংলায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
খ্যাতিমান কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের সাত ছেলে, চার মেয়ের একজন কাজী আনোয়ার হোসেন, ডাক নাম ছিল নবাব। তার বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন গানের জগতে পরিচিত মুখ। প্রয়াত ভাই কাজী মাহবুব হোসেনও লেখালেখি করতেন।
পরিবারের শিক্ষা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমরা সাত বোন, চার ভাই একই পরিবারে জন্মেছি বটে, কিন্তু আব্বু আমাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে মানুষ করেছেন, প্রত্যেকের প্রতি আলাদা যত্ন নিয়েছেন। যার যেমন অন্তরের তাগিদ ও চাহিদা, তাকে ঠিক তা-ই জুগিয়েছেন। আমরা যে যার মতো নিজ নিজ পছন্দের লাইনে বেড়ে উঠেছি। প্রয়োজন হলেই তিনি এগিয়ে এসে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।”
বোনদের মতো গান দিয়েই শুরু হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের পেশাজীবনের। ঢাকা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন, চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করতেন। তারপর সেসব ছেড়ে ছুড়ে দিলেন প্রেস, সেটা গত শতকের ষাটের দশকে।
তার ভাষায়, “এমএ পাস করার পর কিছু দিন গানবাজনা নিয়ে সুখেই কাটল। তারপর বড়রা ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন। পড়লাম বিপদে।”
১৯৬২ সালে কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ফরিদার এক বোন বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন। তাদের বোন নীলুফার ইয়াসমিনও ছিলেন খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, যার স্বামী খান আতাউর রহমান।
কাজী আনোয়ার হোসেন ও ফরিদা দম্পতির এক মাত্র মেয়ে শাহরীন সোনিয়াও রয়েছেন গানের জগতে। দুই ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন ও কাজী মায়মুর হোসেন বাবার মতো লেখালেখির পাশাপাশি প্রকাশনা সামলাচ্ছেন।
প্রকাশনা ব্যবসা শুরুটা কেমন ছিল- কাজী আনোয়ার বলেন, “অনেক আগেই ঠিক করেছিলাম, চাকরি করব না। কিন্তু রোজগার তো করতে হবে। তাই ভাবলাম প্রেস ও প্রকাশনা ব্যবসা করব। নিজের লেখা প্রকাশ করব নিজের প্রেস থেকে। শুরু করলাম সেগুন বাগান প্রেস, সেই সঙ্গে প্রকাশনী। কিন্তু নামটা যুৎসই লাগল না, তাই সেগুনের সে আর বাগানের বা নিয়ে নাম দিলাম সেবা প্রকাশনী। সবাই পছন্দ করল।”
এই সেবা প্রকাশনী থেকে কুয়াশা সিরিজ দিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন লেখার জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে পা রাখেন। তারপর আসে মাসুদ রানা।
“বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে...কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না।’- এমন এক চরিত্র তিনি নিয়ে আসেন বাঙালি পাঠকের সামনে।
নিজের লেখার শুরুটা কেমন ছিল? কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, “বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে দুর্বোধ্য বা অলঙ্কৃত বাংলা না লেখার পণ ছিল আমার। যা বলার, বাহুল্যবর্জিত সহজ ভাষায় সহজ করে বলব। বিষয়বস্তু যদি আকর্ষণীয় হয়, পড়বে পাঠক, এ-ই ছিল আশা।
“মাসুদ রানার প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড় আট-দশবার চেষ্টা করেও শুরু করতে পারিনি। কিছুটা লেখার পর ফেলে দিতে হয়েছে, বুঝেছি পাণ্ডিত্য অ্যাকশন-থ্রিলারের জন্য নয়। ঠিক যা ঘটছে সহজ ভাষায় তা-ই বলতে হবে।”
কাজী মোতাহার হোসেনের পরিবারে থেকে ‘সিরিয়াস’ সাহিত্য থেকে ‘পপুলার’ সাহিত্যে ঝোঁকার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলে গেছেন, “আমার বাবা কাজী মোতাহার হোসেন প্রবন্ধ রচনা করতেন, বোন সনজীদা খাতুন আত্মজীবনীমূলক সরস লেখার পাশাপাশি কঠোর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ধাঁচের বইও লিখেছেন, বড় বোন যোবায়দা মির্যা আত্মজীবনীর মতো করে লিখেছেন- সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।
“আমার ভাই আর আমি লিখেছি রহস্য-রোমাঞ্চের বই। এ নিয়ে কারও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি আমাদের। বাবা তো রীতিমতো উৎসাহ দিয়েছেন। সনজীদা খাতুনও আমার প্রথম রচনা ‘কুয়াশা’ ১ ও ২-এর পাণ্ডুলিপি পড়ে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন।”
সমালোচনা রয়েছে যে কাজী আনোয়ার হোসেনের মৌলিক লেখা নেই বললেই চলে, প্রায় সবই বিদেশি কাহিনীকে অবলম্বন করে।
এ বিষয়ে তিনি বলে গেছেন, “আমার পক্ষে দুই-চারটি স্পাই থ্রিলার লেখাটা কঠিন কিছু ছিল না। কিন্তু বিদেশি কাহিনীর সাহায্য ছাড়া ৪১৩টা মাসুদ রানা নামাতে আমার ৪০০ বছর লাগত। সে কারণেই আমার বিদেশি কাহিনী অবলম্বন।”
মাসুদ রানা সিরিজের কয়েকশ বই বের হলেও এর অনেকগুলো নিজে লেখেননি কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘ঘোস্ট রাইটার’ হিসেবে অন্যরা লিখতেন, তবে লেখকের নাম যেত কাজী আনোয়ার হোসেন।
এনিয়ে শেষ জীবনে বিতর্কও সঙ্গী হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের। সেবা প্রকাশনীরই লেখক শেখ আব্দুল হাকিম মাসুদ রানার স্বত্ব দাবি করলে বিষয়টি আদালতেও গড়ায়। শেষে হাই কোর্ট মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে মালিকানা স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দিয়ে আদেশ দেয়।
অধিকাংশ বইয়ের মালিকানা হারালেও ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা হিসেবে চরিত্রটি কাজী আনোয়ার হোসেনের মালিকানায় থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেয় কপিরাইট অফিস।
যৌনতার জন্য আবার শুরুর দিকে মাসুদ রানার স্বর্ণমৃগ সরকারের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছিল, আইনি লড়াই চালিয়ে তা মুক্ত করেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
মাসুদ রানার জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে তা রুপালি জগতও তাকে নিয়ে ঋদ্ধ হতে চেয়েছে। ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানার প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটে সিরিজের ‘বিস্মরণ’ বইটি নিয়ে। মাসুদ রানা হয়ে সোহেল রানার সিনেমায় নামা সেটাই প্রথম। আর মাসুদ রানার জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতার বাচসাস পুরস্কার জেতেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
মাসুদ রানাকে নিয়ে আরও দুটি চলচ্চিত্রও এখন নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্যাকেজ নাটকের শুরুতেও জড়িয়ে মাসুদ রানা। সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নিয়ে আতিকুল হক চৌধুরী তৈরি করেন নাটক প্রাচীর পেরিয়ে, যাতে মাসুদ রানার ভূমিকায় ছিলেন নোবেল, তার সঙ্গী সোহানা হয়েছিলেন বিপাশা হায়াৎ।
সৌখিন আলোকচিত্রী হলেও স্বাধীনতার পরপরই কাজী আনোয়ার হোসেনের তোলা একটি ছবি ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। গণপিটুনির শিকার ফারুক নামে যুবকের সেই ছবি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল।
সেই ঘটনা যে নিজের জীবনের বেদনাদায়ক এক অধ্যায় হয়ে রয়েছে, এক সাক্ষাৎকারে সেটা বলেছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
“খুব সম্ভব সেটা ছিল ১৯৭৩ সাল। দোতলায় আমার পড়ার ঘরে বসে টাইপরাইটারে কী যেন লিখছিলাম। দুপুরের দিকে কাছাকাছি কোথাও থেকে দুটো গুলির শব্দ হলো, সেই সঙ্গে কানে এল ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার। ক্যামেরা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখলাম ৪০ গজ দূরে রাস্তার তেমাথায় দুটি অল্প বয়সী ছেলেকে বেদম পেটাচ্ছে মানুষ। কী হয়েছে, কেন মারছে, কিচ্ছু জানি না। যারা মারছে, তারাও জানে না কী ওদের অপরাধ। মানুষের মাথায় যেন খুন চেপে গেছে। কারও হাতে লাঠি, কেউ নিয়েছে ১০ ইঞ্চি ইঁট, কেউ সমানে কিল-ঘুসি চালাচ্ছে দুই হাতে। আমার হাতে ক্যামেরা দেখে ছেলেটি হয়ত ভাবল আমি সাংবাদিক, ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাঁচান! প্লিজ, আমাকে বাঁচান!’ আমার গেঞ্জি ভিজে গেল ওর রক্তে। আমার বুক থেকে টেনে হিচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওকে উন্মত্ত জনতা। বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোকের ছেলে, মার খাচ্ছে বেঘোরে। ঠিক তখনই কানে এল, পুলিশ এসে গেছে। আশ্বস্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অপর তরুণের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে ফিরে গেলাম নিজের কাজে। ১০ মিনিটও যায়নি, শুনলাম, নিচের রাস্তায় কে যেন বলছে, মাইরা ফালাইছে, গলায় পাও দিয়া মাইরা ফালাইছে ছ্যারাটারে!”
“আবার ছুটলাম। সত্যিই, জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় চিত হয়ে পড়ে আছে ফারুক, জামা-কাপড় ছিড়ে নিয়ে গেছে মানুষ। পুলিশ যথারীতি নীরব ভূমিকা পালন করেছে, উন্মত্ত জনতার সামনে পড়ে গেলে যেটা স্বাভাবিক। ছবিগুলো নিজেই ডেভেলপ ও প্রিন্ট করেছিলাম রাত জেগে, ঘটনার বর্ণনা ও আমার অসহায় উপলব্ধির কথা লিখেছিলাম,” বলেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে মাসুদ রানা আর সেবা প্রকাশনী দিয়েই মনে রাখতে হবে কাজী আনোয়ার হোসেনকে।
রওশন জামিল বলেন, “চল্লিশ বছর সম্পর্ক। আজ তাতে দাঁড়ি পড়ল। অনুবাদে আমার হাতেখড়ি কাজীদার হাতেই, সেই ঋণ অপরিশোধ্য। যদিও সময়ে তার শিল্প ধারণার দূরবর্তী হয়েছি।
“মাসুদ রানাকে রেখে উনি চলে গেলেন। ব্যাপারটা এখন তাই। একই চরিত্রে একই মায়া-মমতা এবং কঠিনতা রয়েছে। এটা বাঙালি গ্রহণ করেছে দারুণভাবে।”
সেই ‘ম্যাজিক’ আর কতদিন থাকবে- এমন এক প্রশ্নে কয়েক বছর আগে ‘কাজীদার’ উত্তর ছিল- “সুদীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে পাঠক মাসুদ রানা পড়েছে এবং মজা পেয়েছে। এখনও সেই প্রথম বই ‘কুয়াশা’,‘ধ্বংস পাহাড়’–এর মতোই নতুন বইগুলো যারা সাগ্রহে কিনে পড়ছে, তাদের মধ্যে নিত্যনতুন কিশোর আছে, তাদের স্বপ্নের বাগান ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করে দিচ্ছে সেবা প্রকাশনী; আগামী ৩০ বছরেই তাদের সব আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে, এটা আমি মনে করি না।”