প্রায় পাঁচ বছর আগে তদন্ত শেষ হলেও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে এর ফয়সালা চেয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম হান্নান খান।
Published : 01 Jan 2019, 09:37 PM
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, এর ফয়সালাটা হওয়া উচিৎ। অলরেডি তার (জামায়াতের) নিবন্ধন নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, পর্যবেক্ষণ এসেছে। জাজমেন্টে এসেছে জামায়াত ক্রিমিনাল অরগাইজেশন। এটার সুরাহা হওয়া উচিৎ বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।”
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধে অংশ নেওয়া কয়েকজন জামায়াত নেতার বিচার হলেও দল হিসেবে জামায়াতের বিচার শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন হান্নান খান।
তিনি বলেন, “বিচার কেন হচ্ছে না, এটা আমর প্রশ্ন। এটা প্রসিকউশনকে জিজ্ঞেস করেন আপনারা। এক সময়ে এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল, তার জন্য এই মামলাটির উপর আমাদের চাপ ছিল। আমারা তাড়াহুড়ো করে তদন্ত করে দিয়েছি ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ। প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন ১১ দফাসহ বিভিন্ন দাবির বিরোধিতা করে জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও এর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ।
সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মত যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। সেই অপরাধে সর্বোচ্চ আদালতে এ পর্যন্ত জামায়াতের সাত শীর্ষ নেতার সাজা হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে আদালতের একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার আদেশ হলে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। তাদের সাত দফা দাবির মধ্যে জামায়াতসহ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও ছিল।
পরে যুদ্ধাপরাধ মামলায় আপিলের সমান সুযোগ এবং ব্যক্তির পাশাপাশি দল বা সংগঠনের বিচারের সুযোগ রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের বিল সংসদে পাস হয়। এরপর যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং প্রসিকিউশনের তদন্ত দল তাদের তদন্তও শেষ করে।
কিন্তু কোনো দল বা সংগঠন যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি কী হবে তা আইনে না থাকার বিষয়টি উঠে এলে সাজা নির্দিষ্ট করতে আবার আইন সংশোধনের কথা ওঠে। সরকার এরপর আইনের ওই সংশোধনী সংসদে তোলার বিষয়ে কয়েক দফা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা আর হয়নি।
এদিকে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করলে দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তার পাঁচ বছর পরগত অক্টোবরে নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
সে প্রসঙ্গ টেনে হান্নান খান বলেন, “সিইসি অলরেডি কাজ করে দিয়েছেন নিবন্ধন বাতিল করে দিয়ে। তাহলে দল হিসেবে বিচার করার জন্য বাধাটা কোথায় আছে? আমরা সকলেই চাই। কিন্তু কেন এটা হচ্ছে না আমার জানা নেই।”
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ার বিষয়েও হতাশা প্রকাশ করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হান্নান। এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিৎ বলে তিনি মত দেন।
তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক এ বিষয়ে বলেন, “শুধু তদন্ত সংস্থার সদস্য হিসেবে না, আমরা মনে করি, এই বিচারকাজগুলো যে কোনো উপায়ে হোক, হওয়া উচিৎ। এসব মামলার ভিকটিম যারা বা আসামি যারা তারা প্রায় সবাই বয়োবৃদ্ধ। তারা সবাই এই মামলাগুলোর শেষ দেখতে চায়, আমরাও দেখতে চাই “
আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধের ২০টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকার তথ্য দেন তদন্ত সংস্থার এই কর্মকর্তা।
বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সানাউল হক বলেন, “মেজর মান্নান সম্পর্কে যেহেতু অভিযোগ এসেছে অবশ্যই এটা আমাদের দায়িত্ব, এটার খোঁজ-খবর নেব আমরা। আরও কয়েকজনের নাম এসেছে। তবে তাদের নাম আমরা বলতে চাই না।”
আওয়ামী লীগেও যুদ্ধাপরাধী আছে- এমন দাবি করে দুই সপ্তাহ আগে ২২ জনের একটি তালিকা দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
ওই ২২ জনের বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান তদন্ত সংস্থার আছে কিনা জানতে চাইলে সানাউল হক বলেন, যাদের নাম বলা হয়েছে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধানে বা অন্য মামলার তদন্তের সময় কিছু পায়নি তদন্ত সংস্থা।
“এগুলো আসলে নাম দেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়েছে। এমন একজনের নাম দিয়ে বলা হয়েছে উনি অমুক ক্যান্টনম্যান্টে ছিলেন। ওই ক্যান্টনম্যান্টের সমস্ত তালিকা আমাদের কাছে আছে। কিন্তু যার নাম বলা হয়েছে তার নাম নেই। এগুলা হচ্ছে কি, কাদা ছোড়াছুড়ির চেষ্টা।”
সানাউল হক বলেন, “আমাদের জানা মতে যে সাত হাজার লোকের নাম রেকর্ড বুকে আছে বা পাকিস্তান আর্মির অফিসারদের যে দুইশ জনের তালিকা আছে, তার মধ্যেও এই তালিকার (রিজভীর দেওয়া ২২ জনের তালিকা) আর্মি অফিসারদের নাম নাই। এই তালিকার তেমন কোনো সত্যতা আমরা পাইনি।”
হবিগঞ্জের দুজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন
হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের দুই আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ এই সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে তদন্ত সংস্থা।
দুই আসামির মধ্যে মুরাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মধু মিয়া তালুকদার (৬৬) ওরফে মধু মিয়া গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তিনি বিএনপির সমর্থক বলে জানিয়েছেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন।
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক হান্নান খান বলেন, “মধু মিয়া এবং তার বংশের লোকজন মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বানিয়াচং থানাধীন মুরাদপুর ইউনিয়নে শান্তি কমিটি ও ‘মধু বাহিনী’ নামে একটি রাজাকার দল গঠন করেন তবে সাক্ষীদের জবানবন্দিতে জানা গেছে। ”
তদন্ত সংস্থা বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মধু পলাতক ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রামে ফিরে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ২০১৬ সালে বানিয়াচং থানার মুরাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি ওই ইউনিয়নে বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে আছেন।
প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপে বলা হয়, আসামি মধু মিয়া ও পলাতক অপর আসামির বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মত অপরাধের পাঁচটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
এর মধ্যে ৩ জনকে হত্যা, ৩ জনকে ধর্ষণ, ২টি বাড়ির ৮টি বসত ঘরে অগ্নিসংযোগ, ৪ জনকে অপহরণ এবং ৩ জনকে নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে।
গত বছরের ২৬ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। এরপর ২৩ মে মধুকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তদন্ত শেষে তিনটি ভলিউমে ২৫০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে তদন্ত সংস্থা।