ওই নারীদের একজন জানালেন, মালিবাগের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলেন তারা। লালবাগের বাসায় ফেরার পথেই এ বিপত্তি।
মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকায় গত তিন মাস ধরে শান্তিনগর চৌরাস্তা থেকে মালিবাগ, মৌচাক হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। গত তিন দিনের বৃষ্টিপাতের পর সড়কে পানি আরও বেড়েছে। সেইসঙ্গে সড়কে তৈরি হয়েছে অসংখ্য খানাখন্দ, যাতে প্রায়ই যানবাহন বিকল হচ্ছে, ঘটছে দুর্ঘটনা।
জলে ঢাকা মৌচাক মোড়ের এই রাস্তা খানাখন্দে ভরা-এরমধ্যে চলতে গিয়ে অনেক সময় উল্টে পড়েন রিকশা ও মটরসাইকেল আরোহীরা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
জলাবদ্ধ মৌচাক মোড়ের এই ছবি রোববার দুপুরের। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
রোববার ঘুরে দেখা গেছে, শান্তিনগর থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের দুপাশে কোনো কোনো অংশে হাঁটু পানি জমে আছে। পানি আছে মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক পর্যন্ত। এছাড়া মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটু পানি।
শনিবার পুরো সড়কে হাঁটু পানি ছিল বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন রিকশাচালক এমদাদুল।
“কাইলকা পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটুপানি আছিল। রিকশার বডি পর্যন্ত ডুইবা গ্যাছে। এইখানি রিকশা চালান খুব কঠিন। গাড়া-গোড়ায় রিকশা পইড়া যায়, পল্টি খায়।”
জলাবদ্ধ মৌচাক মোড়ের এই ছবি রোববার দুপুরের। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে পয়োঃনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর কাজ করছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। গর্ত খুঁড়ে রাস্তায় মাটি ফেলে রাখায় সড়কের এই অংশে বন্ধ রয়েছে চলাচল। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
ইঞ্জিনে পানি ঢুকে বিকল হয়ে যাওয়া একটি অটোরিকশা নিয়ে বসেছিলেন চালক মো. জাকির হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দয়াগঞ্জ থেকে মালিবাগ রেল গেইট যাচ্ছিলেন তিনি। ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় যাত্রীরা নেমে চলে গেছে।
“রাস্তা এইরম জানলে জিন্দেগিতে এইদিকে আইতাম না। রাস্তায় অনেক গর্ত। কিন্তু পানির লাইগ্যা দেখা যায় না। গর্তে পইড়া ইঞ্জিনে পানি ঢুকছে।”
অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলার সময়ই ওই সড়কেই আরেকটি প্রাইভেটকার বিকল হয়ে পড়ে।
ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই এ এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ করেন মগবাজার ওয়্যারলেসগেট এলাকার বাসিন্দা শারমিন জাহান। কয়েকদিন আগে রিকশা উল্টে তিনিও পড়ে গিয়েছিলেন।
এখানে ওখানে ফ্লাইওভার নির্মাণের সরঞ্জাম, তার উপরে সড়কের গর্তে জমেছে জল-এরমধ্যেই চলছে চলাচল। ছবিটি রোববার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ মোড় থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
একপাশে জল-কাদা, অন্যপাশে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী-এর মধ্যেই কোনোভাবে চলছে পথচারীদের এগিয়ে যাওয়া। ছবিটি রোববার দুপুরে মৌচাক থেকে মালিবাগ চৌরাস্তামুখী সড়কের। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
“ভাগ্য ভালো যে হাত-পা ভাঙেনি। কিন্তু প্রতিদিনই দুর্ভোগ সয়ে যাতায়াত করতে হয়। নোংরা পানি মাড়িয়ে পথ চলতে চলতে পায়ে এলার্জি হয়ে গেছে। স্বামীর অফিস কাছে বলে বাধ্য হয়ে এ এলাকায় থাকছি।”
ভাঙাচোরা এই সড়কে পানি জমে থাকায় প্রতিদিন যানজট হচ্ছে বলে জানান মৌচাকে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট নূরতাজুল ইসলাম।
“সামনে গর্ত আছে এই ভয়ে অনেক গাড়ি সামনে এগুতে চায় না। এছাড়া প্রায়ই গাড়ি বিকল হয়ে যায়। ফলে পেছনে গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়ে যায়।”
সড়কে পানি জমে থাকায় ফুটপাতের দোকানগুলোও খোলা যাচ্ছে বলে জানালেন ফুটপাতের দোকানি ইদ্রিস বেপারী।
মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক মোড় হয়ে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে পয়োঃনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর কাজের জন্য নেই ফুটপাত ব্যবহারের সুযোগ, অপরদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপরে এলোমেলোভাবে ফেলে রাখায় বিপাকে পথচারীরা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক মোড় হয়ে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে পয়োঃনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর কাজের জন্য নেই ফুটপাত ব্যবহারের সুযোগ, অপরদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপরে এলোমেলোভাবে ফেলে রাখায় বিপাকে পথচারীরা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
“আইজ ২-৩ দিন ধইর্যাট দোহান খুলতে পারি না। রাস্তায় জইম্যা থাহা পানি ফুটপাতে উইড্যা আহে।”
মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক হয়ে রামপুরা যেতে এ সড়কের এক পাশে পানি জমে আছে। সড়কে তৈরি হয়েছে ছোটবড় অসংখ্য গর্ত। দুর্ভোগ এড়াতে খিলগাঁও হয়ে আসা রামপুরাগামী যানবাহন খিলগাঁও কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়ক হয়ে আবুল হোটেল পর্যন্ত যাতায়াত করে। কিছু বাস চললেও ছোট যানবাহন চলতে দেখা যায়নি। সড়কের এ অংশে কোনো রিকশা চলে না।
মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে পরিবহনের কাউন্টার থাকায় এ সড়কে আসতে হয় বলে জানান তরঙ্গ প্লাস পরিবহনের চালক মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ সড়কটুকু পার হতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
"ভাই এইটুকু রাস্তা পার হইতে কী যে কষ্ট হয় তা বুঝাইতে পারুম না। গাড়ির চাক্কা পাংচার হয়। স্প্রিং ভাইঙ্গা যায়। অন্য গাড়িতো ওইদিক দিয়া যায় গা, আমাগো আসতে হয়।"
মালিবাগ চৌরাস্তা থেকে মৌচাক মোড় হয়ে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে পয়োঃনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর কাজের জন্য নেই ফুটপাত ব্যবহারের সুযোগ, অপরদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার উপরে এলোমেলোভাবে ফেলে রাখায় বিপাকে পথচারীরা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
এখানে ওখানে ফ্লাইওভার নির্মাণের সরঞ্জাম, তার উপরে সড়কের গর্তে জমেছে জল-এরমধ্যেই চলছে চলাচল। ছবিটি রোববার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ মোড় থেকে তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা এবং মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে নিষ্কাশন নালা বসানোর কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের একপাশে গর্ত খুড়ে মাটি তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে। রাস্তায় রাখা হয়েছে পাইপসহ নির্মাণসামগ্রী। ফলে সড়কের ওই অংশে পথচারী ও যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। মৌচাক থেকে মালিবাগ চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের একপাশেও রাস্তা খুঁড়ে রাখায় লোকজনের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে।
এক সঙ্গে একাধিক উন্নয়নকাজ এবং কাজের ধীরগতির কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের ভোগান্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মালিবাগের বাসিন্দা আফসার আহমেদ।
জলাবদ্ধ মালিবাগ মোড়ের এই ছবি রোববার দুপুরের। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
জলাবদ্ধ আর খানাখন্দের কারণে রাজধানীর মৌচাক এলাকায় ঝুঁকি নিয়ে পথচলা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
“একই সময়ে একই রাস্তায় তিনটি উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে। ফলে এই অস্বাভাবিক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আমাদেরকে। এসব কাজ ধাপে ধাপে করলেও তো ভোগান্তিটা আমাদের কম হত। এছাড়া দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য বেশি যন্ত্রপাতি ও লোকবল নিয়োগ করলেও উন্নয়নের নামে এই নিগ্রহ থেকে আমরা রেহাই পেতাম।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিষ্কাশন নালার জন্য এলাকায় খোড়াখুঁড়ি করছে বলেই জলাবদ্ধতা হয়েছে- এমন দাবি করেন ফ্লাইওভার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. শরীফুল ইসলাম। তার ভাষ্য, জলাবদ্ধতা নিরসনে তাদের কিছুই করার নেই।
“আমাদের পক্ষ থেকে এইখানে ব্যবস্থা নেওয়ার কিছু নাই। কারণ ড্রেন কাটতেছে বলে সবকিছু বন্ধ করে রাখছে। আমরা কিভাবে পানি নিষ্কাশন করব?”
জলাবদ্ধতার এই ছবি রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে রোববার তোলা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
তিন দিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর মৌচাক মার্কেটের প্রবেশ পথসহ মার্কেট সংলগ্ন গলিতে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা; ভোগান্তিতে দোকানিরা। রোববারের ছবি। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
এ অভিযোগ অস্বীকার করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হানিফ পাটোয়ারী বলেন, এ এলাকার দুর্ভোগের জন্য সিটি করপোরেশন দায়ী নয়। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্যই লোকজনের দুর্ভোগ হচ্ছে।
“আমরা সেখানে কাজ শুরু করেছি ছয় মাস আগে। আর ওই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ আরও দুই বছর আগে শেষ হওয়ার কথা। সেটা ঠিক সময়ে শেষ হলে আমাদের প্রজেক্টের সঙ্গে কনফ্লিক্ট করত না। মূল ব্যাপার হল দীর্ঘদিন ধরে তারা নির্মাণকাজ করছে। এ কাজ করার সময় ওয়াসার নিষ্কাশন নালা ভরাট হয়ে পানি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে সড়কে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।”
রাজধানীর মৌচাক মার্কেট সংলগ্ন এই গলির কিছু দোকান রোববার খুললেও জলাবদ্ধবতায় ক্রেতার অভাবে অলস সময় কাটান বিক্রেতারা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
রাজধানীর মৌচাক মার্কেট সংলগ্ন এই গলির কিছু দোকান রোববার খুললেও জলাবদ্ধবতায় ক্রেতার অভাবে অলস সময় কাটান বিক্রেতারা। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক
সিটি করপোরেশনের নিষ্কাশন নালা তৈরি হয়ে গেলে মৌচাক ও মালিবাগ এলাকার জলাবদ্ধতা থাকবে না বলে জানান হানিফ পাটোয়ারি। তবে এই বছর কোনো সুসংবাদ দিতে পারছেন না তিনি।
“এ বছর আমাদের কাজ চলায় একটু কষ্ট হবে। আশা করি আগামী বছর থেকে এ এলাকায় আর জলাবদ্ধতা হবে না।”