দেশব্যাপী সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জের ধরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার জোয়ার দেখছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু এই সিটির প্রথম মেয়র হিসেবে করা কাজের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নগরবাসীর সমর্থন চাইছেন।
Published : 29 Mar 2017, 12:07 AM
এই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচারের শেষদিন মঙ্গলবার জমজমাট পরিবেশে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ভোটারদের কাছে গিয়ে নিজস্ব প্রতীকে সমর্থন চাওয়ার পাশাপাশি দিয়েছেন শেষ সময়ের নানা প্রতিশ্রুতি।
রিকশা কিংবা অটোরিক্সায় চড়া মাইকে স্লোগান আর গানে পুরো সিটি কর্পোরেশন এলাকা সরগরম ছিল অন্যান্য দিনের মতো; ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রার্থীর পক্ষে শেষদিনের মিছিলে উৎসবমুখর দেখা গেছে সমর্থকদের।
সকাল ৯টায় ‘দ্বিতীয় মুরাদপুর’ এলাকা দিয়ে শেষ দিনের প্রচার শুরু করেন নৌকার প্রার্থী সীমা। সেখানে আগে থেকে জড়ো হওয়া ভোটারদের সামনে গিয়ে হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য দিয়ে এবং প্রচারপত্র বিতরণ করে গণসংযোগের কাজ শেষ করেন তিনি।
এরপর একই ধরনের গণসংযোগে সময় পার করেন দক্ষিণ ঠাকুরপাড়া ও শাকতলা এলাকায়।
গণসংযোগ চলার মধ্যে গৌবিন্দপুর ও অশোকতলা এলাকায় দুটি উঠান বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের এই মেয়র প্রার্থী।
এর আগের উঠান বৈঠকগুলোতে নারী-পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও শেষদিন একসঙ্গে নিয়ে মানুষের সমস্যার কথা শুনে তাদের কাছে ভোট চান সীমা।
বিএনপির বিভিন্ন অভিযোগকে ‘কেবল অভিযোগের জন্য অভিযোগ’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।
বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভায় দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করা সীমা বলেন, “দেশব্যাপী শেখ হাসিনার উন্নয়নের জোয়ারে কুমিল্লায় নৌকার জোয়ার বইছে। কুমিল্লায় নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।”
বিএনপি প্রার্থীর পক্ষ থেকে মিছিলে বাধা দেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা নাকচ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, “তারা কেবল অভিযোগ করার জন্যই অভিযোগ করছে।”
বিকাল সাড়ে ৪টায় নগরীর কাসেমুল উলুম মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভোট চাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষদিনের প্রচার শুরু করেন বিএনপির মনিরুল হক সাক্কু।
তারপর রানীবাজার মাদ্রাসায় গিয়ে একই কায়দায় ধানের শীষের পক্ষে ভোট চান কুমিল্লা সিটির প্রথম এই মেয়র।
সন্ধ্যায় উঠান বৈঠক করেন নগরীর রেসকোর্স এলাকায়। সেখানে মানুষের বক্তব্য শুনে ‘যে উন্নয়ন তিনি করেছেন’ সেগুলো এগিয়ে নিতে পুনরায় সমর্থন চান এই প্রার্থী।
“জনগণ আমাকে ভোট দিলে আমাকে দিক, সীমাকে ভোট দিলে সীমাকে দিক। মানুষ যেন নিজের ভোটটা দিতে পারে।”
এই নির্বাচনে মেয়র পদে আরও দুজন লড়ছেন। তারা হলেন- জেএসডির শিরিন আখতার ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মামুনুর রশীদ।
এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু থাকার কথা প্রার্থী ও নির্বাচন কর্মকর্তার মুখ থেকে এলেও ভোটারদের মধ্যে চাপা আতঙ্ক এখনো রয়েছে।
নগরীর রানীর বাজার এলাকায় কথা হয় শাসনগাছা এলাকার ভোটার মো. সৈকতের সঙ্গে; বিভিন্ন এলাকায় ‘সন্ত্রাসীরা’ কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় সংঘাতের আশঙ্কা করেন এই রিকশা চালক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিস্থিতি ভালো। তবে ভোটের দিন এটা থাকবে বলে মনে হয় না। ভোট দিতে যাব কি না চিন্তায় আছি। এমন থাকলে যাব।”
এদিন গাড়ি ভাংচুর ও শিশু গুলিবিদ্ধের ঘটনায় একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তবে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন তিনি।
ভোটারদের আতঙ্ক কাটাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছেন নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সর্বশেষ পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো। এখন পর্যন্ত নির্বাচন ঘিরে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি। বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, আনসারসহ পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী মোতায়েন আছে। ভোটের শেষ সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত রাখার কাজ আমরা করে যাব।”
নির্বাচন ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তিন হাজার ৯০০ সদস্য মোতায়েন রয়েছে বলে জানান রকিব উদ্দিন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে যথাক্রমে ৩৭ ও ৪৩টি কেন্দ্রকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসাবে চিহ্নিত করে সোমবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়ার কথা এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, “কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র নাই। ১০৩টি কেন্দ্রকেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করছি। পরিস্থিতি বুঝে সব জায়গায় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাননি বলে জানান তিনি।
নির্বাচন ঘিরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখা গেছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়; পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতির পাশাপাশি আছে বিজিবি ও র্যাব সদস্যদের টহল।
সন্ধ্যায় টাউন হলের সামনে ব্রিফিংয়ে বিজিবি’র কুমিল্লা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল গাজী মো. আহসানুজ্জামান বলেন, “নির্বাচনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য কাল থেকে আমাদের ২৬ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন রয়েছে। আজ সারাদিন আমরা পুরো এলাকায় পরিচিতি করেছি। বিজিবি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে কাজ করবে, সাথে ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তারা আমাদের সহায়তা প্রদান করবেন।
“এছাড়া কুমিল্লা শহর যেহেতু সীমান্তবর্তী শহর সেটাকে মাথায় রেখে এলাকায় আমাদের যেসব চৌকি রয়েছে সেগুলোকে জোরদার করা হয়েছে, যাতে কেউ সীমান্ত এলাকাকে নেতিবাচকভাবে নির্বাচনে ব্যবহার করতে না পারে।”
তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত খারাপ কোনো খবর নেই। কেউ যাতে পরিস্থিতি ঘোলাটে বা নষ্ট করতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য সব চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
বিকালে দোকান মালিক সমিতি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে বৃহস্পতিবার ভোটের দিন সব দোকান বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে কুমিল্লা শহরে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে মোট ওয়ার্ড ২৭টি। ভোটার রয়েছে দুই লাখ সাত হাজার ৫৬৩ জন।
কাউন্সিলর প্রার্থী গ্রেপ্তার, জামিনে মুক্ত
সোমবার রাতে গাড়ি ভাংচুর ও মঙ্গলবার ভোরে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জিল্লুর রহমান জিলানীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ জিলানীকে আদালতে পাঠালে তিনি জামিন পান বলে জানান সদর দক্ষিণ থানার ওসি সজল কুমার কানু।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে গ্রামচৌয়ারা এলাকায় ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী খলিল মজুমদারের বাড়ির সামনে তার ভাতিজা আবুল কালাম মজুমদারের মাইক্রোবাস ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী জিল্লুর রহমান জিলানীসহ চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন খলিল।
এরপর মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে মসজিদের পথে গ্রামচৌয়ারার চৌধুরী বাড়ির সামনে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মমিন চৌধুরীর নাতি আবু সাঈদ অনিক (১৪) গুলিবিদ্ধ হন।
ভাংচুরের ঘটনায় মামলার জেরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সন্দেহ অনিকের মা সাবিনা বেগমের। তার বাবা মমিন চৌধুরী কাউন্সিলর প্রার্থী খলিলকে সমর্থন দেওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী জিলানীর সমর্থকরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা অভিযোগ করেন, বিএনপির লোকজনই আওয়ামী লীগ নেতার নাতিকে গুলি করেছে।