ঢাকা মহানগরীর আসনগুলোর মধ্যে খানিকটা ভিন্ন চিত্র ঢাকা-৬ আসনের; এখানে বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকলেও প্রতীক ধানের শীষ রয়েছে, আবার নৌকা প্রতীক না থাকায় লাঙ্গলের জন্য ভোট চাইতে হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের।
Published : 16 Dec 2018, 10:40 PM
পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, ওয়ারী, গেণ্ডারিয়ার পুরোটা এবং কোতোয়ালি ও বংশালের একাংশ নিয়ে গঠিত এই আসনটিতে প্রার্থী নির্বাচনে দুই প্রধান দলই একই রকম ছক কষেছে।
বিএনপি আসনটি ছেড়ে দিয়েছে তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দল গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরীকে, তিনি বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই ভোট করছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসনটি ছিড়ে দিয়েছে তাদের মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদকে, তিনি দলীয় প্রতীক লাঙ্গল ছাড়েননি।
পুরান ঢাকার এই আসনে এক সময় সংসদ সদস্য ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; তার পথ ধরে ১৯৯১ সালে শেখ হাসিনা এই আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে হারতে হয়েছিল বিএনপির সাদেক হোসেন খোকার কাছে।
পুরান ঢাকার খোকা এরপর থেকে আসনটি অনেকটা নিজের করে নিয়েছিলেন; ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে প্রার্থী বদলেও আসনটির দখল নিতে পারেনি আওয়ামী লীগ। খোকা পরে ঢাকার মেয়রও হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা নগরীর সবগুলো আসনে আওয়ামী লীগ জিতলেও ঢাকা-৭ আসনে খোকা ঠিকই ধানের শীষ উঁচু করে রেখেছিলেন।
কিন্তু ২০০৮ সালের পালাবদলের ঢেউয়ে খোকার দুর্গ হাতছাড়া হয়, তিন যুগ পর ঢাকা-৬ আসনে নৌকার বিজয় পতাকা ওড়ান মিজানুর রহমান খান দীপু। এই নির্বাচনে খোকার ভোটে ভাগ বসিয়েছিলেন বিকল্প ধারার সভাপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও।
দীপুর মৃত্যুর পর ২০১৪ সালের বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এই আসনটি আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ।
এখন জাতীয় পার্টিতে থাকলেও এক সময় আওয়ামী লীগেই ছিলেন এই ফিরোজ রশীদ; ছাত্রলীগ থেকে পুরান ঢাকার জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপিও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
ফিরোজের মধ্যে আওয়ামী লীগের ছোঁয়া থাকলেও ধানের শীষের প্রার্থী ঠিক বিপরীত; হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী তার ধারার বিপরীতে গিয়েই এবার ধানের শীষের প্রার্থী এখানে।
বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নিজের পুরনো দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নামা কামাল হোসেনের দল গণফোরামের সুব্রতসব সব প্রার্থীই ধানের শীষ প্রতীক নিয়েছেন।
কয়েকটি মামলায় দণ্ড নিয়ে চিকিৎসার জন্য কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা খোকার ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন এবার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। খোকার সমর্থকরাও চাইছিলেন তার ছেলেকে; কিন্তু জোটের স্বার্থে নিজেকে ‘বলি’ দিয়েছেন ইশরাক।
‘বাবার কথায়’ ইশরাক মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পুরান ঢাকার এলাকাটিতে বিএনপি জোটের একক প্রার্থী এখন সুব্রত, যিনি ভোট করতে চাইছিলেন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে। কিন্তু সেখানে জোটের নেতা অলি আহমদ থাকায় তাকে সরে আসতে হয়।
দুই লাখ ৬০ হাজার ভোটারের ঢাকা-৬ আসনে ফিরোজ রশীদ ও সুব্রত চৌধুরী ছাড়াও ছয়জন প্রার্থী হয়েছেন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধানের শীষ ও লাঙ্গলের মধ্যেই যে হচ্ছে, তা স্পষ্ট।
বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ এ আসনে হারিকেন মার্কায় প্রার্থী হয়েছেন। তার দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) নিবন্ধন না থাকায় তিনি বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রতীক নিয়েছেন।
এ আসনের অন্য প্রার্থীরা হলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মো. আবু তাহের হোসেন (কাস্তে), জাতীয় পার্টি-জেপির সৈয়দ নাজমুল হুদা (বাইসাইকেল) ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাজী মো. মনোয়ার খান (হাতপাখা), গণফ্রন্টের আহমেদ আলী শেখ (মাছ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. আক্তার হোসেন (আম)।
কী বলছেন ভোটাররা
ধোলাইখাল এলাকায় গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রেতা মো. রতন মিয়া। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকাতেই তার বসবাস।
নির্বাচনের খবর জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এলাকাটা তো বিএনপির ছিল। বার বার খোকা সাহেব নির্বাচিত হয়েছেন। এই যে চারপাশে যা দেখছেন, সবাই বিএনপি করে।
“এখানে এমনও লোকও আছে তারা যদি রাস্তায় নামে, তাদের একজনের ডাকে হাজার হাজার মানুষ নামবে। কিন্তু কেন যেন তারা সবাই চুপচাপ!”
রোববার এই নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ফিরোজ রশীদের পোস্টার ও প্রচার চোখে পড়লেও ধানের শীষের প্রার্থীর পোস্টার ছিল না বললেই চলে।
ধানের শীষের প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে রতন মিয়া বলেন, “আমি তো এমন দেখিনি যে পোস্টার লাগানোর সময় কেউ কাউকে বাধা দিয়েছে। অনেকের পোস্টার লাগানো হচ্ছে, ধানের শীষের কোনো পোস্টার নাই কেন, বুঝতে পারলাম না।”
ভোট দিতে আগ্রহী রতন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান। তিনি বলেন, “জোর করে ভোট নিয়ে জেতার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই।”
ওয়ারী, গেণ্ডারিয়া, কোতোয়ালি এলাকায় রিকশা চালান ঝিনাইদহের যুবক ইকবাল হোসেন।
প্রচার কার বেশি- জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে-সেখানে লাঙ্গলের জন্য ছোট ছোট মিছিল দেখি, হঠাৎ হঠাৎ সমাবেশও করে। আবার নৌকাও বলে। ওয়ারী এলাকায় তো ধানের শীষের কোনো পোস্টার দেখলাম না।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফিরোজ রশীদের পক্ষে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও থানা ও ওয়ার্ড নেতরাও প্রচারে নেমেছেন। কিন্তু সুব্রত চৌধুরীর জন্য বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে প্রচারে নামতে দেখা যায়নি।
স্থানীয় একটি স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক আব্দুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবাই মাঠে আসুক, তখন যদি কেউ কাউকে বাধা দেয় মিডিয়া ডেকে বলা হোক, ইসিতে গিয়ে অভিযোগ করুক।”
আশাবাদী ফিরোজ, অভিযোগ সুব্রতর
১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে জমজমাট প্রচার চালাচ্ছেন জাতীয় পার্টির ফিরোজ রশীদ। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও দেখা যাচ্ছে।
প্রতিদিনই লিফলেটসহ পাড়া-মহল্লায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন ফিরোজ রশীদ। গত ১২ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার প্রচার শুরুর সময় বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য মীজানুর রহমানও ছিলেন।
ফিরোজ রশীদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের ব্যাপক সাড়া আছে। এখানে নৌকা-লাঙ্গল এক। ইনশাল্লাহ এবারও লাঙ্গলের জয় হবে।”
অন্যদিকে গণেফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার তিন দিন পর প্রচারে নামলেও পুলিশও ও ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, শুক্রবার নামার পর গেণ্ডারিয়া এলাকায় তাকে বাধা গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেন। পরদিন হাটখোলা এলাকায় তার কর্মীদের উপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
সুব্রত বলেন, “আমার পোস্টার লাগাতে দিচ্ছে না। প্রচারণায় বের হলে হামলা করছে। যাদেরকে নিয়ে গণসংযোগ করি তাদেরকে সন্ধ্যায় পর গ্রেপ্তার করে ফেলছে। নির্বাচনের তো কোনো পরিবেশই নেই।”
এ কারণে রোববার দুপুর পর্যন্ত প্রচারে না গিয়ে নিজের নির্বাচনী প্রচার কার্যালয়েই অবস্থান করছিলেন তিনি।
ধানের শীষের প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে ফিরোজ রশীদ বলেন, “আমাদের কোনো কর্মী-সমর্থক কাউকে বাধা দিচ্ছে না। তিনি আমার বন্ধু মানুষ, তাকে কেন আমাদের লোকেরা বাধা দেবে?”
সুব্রত চৌধুরী বলেন, “এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, রিটার্নিং অফিসে অভিযোগ দিয়েছি, থানায় অভিযোগ জানিয়েছি, কিন্তু কোনো ফল হচ্ছে না।”
বিরোধী জোটের প্রার্থীর অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগরীর ১৫টি আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা (ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার) কে এম আলী আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা-৬ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর কোনো অভিযোগ সম্পর্কে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
“তবে আমাদের কাছে এই পর্যন্ত তিন/চারটি অভিযোগ এসেছে। এগুলো সাথে সাথে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”