রমযান মাস আসলে এই লাইনগুলো সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে এবং কষ্টের মাত্রা আরঅ দ্বিগুন হয়ে যায় শারিরীক আর মানসিক দিক দিয়ে। প্রথমত, পরিবারকে মিস করি, আর দ্বিতীয়ত নিজে আয় করে নিজের চাহিদা মেটাতে হয়।
আমরা যারা এইখানে শিক্ষার্থী হিসেবে আছি, আমাদের জন্য খুব কষ্ট হয়ে যায় বাহারি রকমের ইফতার তৈরি করাটা। তাই কোনোভাবে রোজার মাসটা কেটে যায়। পরিবার জিনিসটা যে কি এবং মায়ের মূল্যটুকু কতোখানি, এখন বুঝতে পারছি। যখন মা মুখের সামনে খাবার তুলে দিতেন, তখন খেতাম না। আর এখন মিস করি মায়ের হাতের রান্না।
আগে দেশে থাকতে দেখতাম, রোজার সময় মা বাসার সব কাজ শেষ করে আবার ঠিকমতো ইফতারও তৈরি করতো। সবাইকে নিয়ে এক টেবিলে একসাথে আনন্দের সাথে ইফতার করতো। ঠিক সেই পরিবেশটি এবং পরিবারের মানুষগুলোকে আমি এখন মিস করছি।
তারপরও শত কষ্টের মাঝে সুখ খুঁজে পাই, যখন দেখি আমার বোন আমার সাথে আছে এই দেশে। ইংল্যান্ডে আসার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে যে মানুষটিকে আমি মিস করি সারাক্ষণ, সে হচ্ছে আমার ‘মা’।
এদেশে এমনিতে অনেকক্ষণ ধরে রোজা রাখতে হয় এবং তার মধ্যে চাকরিও করতে হয়। তাই এতোটা ক্লান্তি অনুভব করি যে বাসায় গিয়ে ইফতার তৈরি করার শক্তি পাই না। যার কারণে পেঁয়াজু ও ছোলা বা বুটের পরিবর্তে খেঁজুর আর ভাত দিয়ে ইফতার করে ফেলি। কিন্তু এই কষ্টগুলো মাকে বুঝতে দেই না।
‘মা’ জিনিসটা কী, এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এখানে আসার পরে। আগে খুব বিরক্ত হতাম মায়ের উপরে, খালি অনেক শাসন করে আর সব কিছুতেই ‘এটা করবা না, ওইটা করবা না’ আরও কতো কি! কিন্তু এখন সেই শাসনের মর্মটা বুঝতে পারছি। এই দেশে কীসের অভাব, কোনো কিছুরই অভাব নেই। শুধু একটি জিনিসই নেই, সেটি হচ্ছে- মায়ের আদর ও মমতা।
জানেন, আমার মা সবসময় বলতো আগে- “আরে, তোরা কেউ আমাকে রান্নায় একটু সাহায্য কর যাতে করে আমি তাড়াতাড়ি রান্নাটা শেষ করতে পারি, আমি একা আর কতো করবো।”
হায়রে মা, কতো কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। একটুও বোঝার চেষ্টা করিনি, কথায় কথায় খালি বিরক্ত হতাম আপনার উপরে। আর এখন বুঝতে পারছি, মায়ের মূল্য কতোখানি। যখনি কথা বলি মায়ের সাথে, তখনি শুধু একটা কথাই বলি, “আম্মা, দেশে আসলে আর কোনদিন আপনাকে রান্না করতে দিবো না। সব কাজ আমি নিজেই করবো।”
যখন এই কথাটি বলি, তখন আমার মা হাসতে থাকে আর বলে, “উপলব্ধি করতে পেরেছো, এটাই আমার জন্য অনেক। আমি আর কিছু চাই না আর তোমাদের কিছু করতে হবে না। বরং তোমাদেরকে আমি রান্না করে খাওয়াবো, যে জিনিসগুলো তোমরা খেতে পারোনি লন্ডনে থাকতে।”
হয়তো এই কষ্টগুলো বাংলাদেশের মানুষরা বুঝবে না, কিন্তু আমরা যারা পরিবার থেকে অনেক দূরে আছি, তারা এখন বুঝতে পারছি, পরিবারের বাবা-মা, ভাই-বোনের উপস্থিতি কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ।
ওহ! আরেকটি কথা। আমার বাবা যখন চাকরি করতেন, তখন তিনি কখনোই বাইরে ইফতার করতেন না বা কোনো ইফতার দাওয়াতেও যেতেন না। কারণ তিনি সবসময় বলতেন, “পরিবারের সবাই একসাথে ইফতার করার আনন্দটাই অন্যরকম। যা আছে তাই দিয়ে পরিবারের সবার সাথে এক সাথে খাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে।”
আমার বাবা ঠিক কথাটি বলেছেন, যা এখন প্রতিমুহূর্তে বুঝতে পারছি। আসলেই একা ইফতার করাটা অনেক কষ্টের। আগে শুধু শুনতাম মানুষের কাছে প্রবাসে যারা থাকে তারা নাকি অনেক বেশি পরিমাণে পরিবারকে মিস করে। কিন্তু আমি তখন ভাবতাম, বাবা-মার শাসন নেই, সুতরাং ভালো তো থাকারই কথা, তাই না?
আমি আর কিছু লিখতে পারছি না, খালি কান্না পাচ্ছে। শুধু একটি কথা বলবো, আম্মা অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে, দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন। আজকে জীবনে যা কিছু অর্জন করেছি, সবই আপনার কারণে।
আর সেই সাথে প্রতিজ্ঞাও করছি, দেশে আসার পর আর কোনোদিন আপনাকে একটা কাজও করতে দেব না।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ই-মেইল: topu1212@yahoo.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |