প্রবাসে স্বদেশ ভাবনা: ভিনদেশি সম্পর্কের ভিত ও জঙ্গিবাদ

আজকাল যেকোন কিছু দেখলেই মাথার মধ্যে তারতম্যের অ্যান্টেনা ঘুরতে থাকে অনবরত। ভাল কিংবা খারাপ- যাই হোক না কেনো, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করারটা এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

শাফিনেওয়াজ শিপু, লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2016, 12:43 PM
Updated : 13 Jan 2017, 01:29 PM

অবশ্য অনেকে হয়তো একে বদভ্যাসও বলতে পারেন। অভ্যাস কিংবা বদভ্যাস- যাই বলি না কেন, বিলেতে আসার পর থেকে প্রতিনিয়ত আমরা কিছু না কিছু শিখছি।

এখানে ক্রিসমাসের দিনটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে প্রসঙ্গক্রমে। সাধারণত ক্রিসমাসের সময়টাতে ভালো একটা ছুটি মানে বেশ লম্বা একটা ছুটি। অনেকটা আমাদের দেশের ঈদের ছুটির মতো। একমাস ধরে অনেকেই প্রস্তুতি নেয় এই দিনটিকে উপভোগ করার জন্য।

এবারের ছুটিতে সারাক্ষণ বাসায় থেকে ভুরিভোজ আর বিরতিহীন মুভি দেখবো- এমনটাই প্ল্যান করে এগোচ্ছিলাম। যে বাসায় আমরা থাকি, সেখানে আমাদের এক বৃটিশ হাউজমেটও রয়েছে। নাম তার স্টিফেন আর বয়স বড়জোর ২৩।

স্থানীয় একটি পাবে কাজ করে নিজের খরচ চালায় স্টিফেন। আর তার বাবা চান ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াক। তাই তো নিজ সংসার থেকে তাকে আলাদা করে দিয়ে সংগ্রাম করে জীবন চালানোর পথ বেছে নিতে বলেছেন।

বিলেতের মত পশ্চিমা অনেক দেশেই এই ধারা দেখতে পাওয়া যায়। সন্তান-সন্ততিদের বয়স ১৮ হলেই তারা পরিবার থেকে আলাদা হয়ে স্বাবলম্বী হতে শেখে। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এই ধারাটি একেবারে অপ্রযোজ্য কিংবা বিপরীত স্রোত।

হাউসমেট হিসেবে স্টিফেনকে আমরা ভোজনের দাওয়াত দিলে সে জানায়, ২৫ তারিখে সে উৎসব পালনের জন্য তার বাবার বাড়িতে যাবে। তবে আমাদের খানিকটা অবাক করে দিয়ে উৎসব ও তার পরবর্তী দুইদিন সে বাসায় ছিলো।

আশ্চর্য হয়ে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তোমার বাবার বাসায় যাওনি কেন?

সে জানালো, এই মুহুর্তে তার মা গর্ভবতী এবং সে চায় তার মা ও পালক পিতাকে একসাথে সময় কাটাক। তার কারণে যেন পরিবারের আনন্দটা নষ্ট না হয়।

চার দেয়ালের মধ্যে বলতে গেলে একাই স্টিফেন উপভোগ করলো উৎসবের দিনগুলো। আর আমরাও শুধু আমাদের খাবার নয়, তার সাথে ভাগাভাগি করে নিলাম সুখ-দুঃখের হিসেবগুলোও। স্টিফেনকে দেখে শুধুই মনে মনে ভাবছি, কীভাবে ছেলেটা একাকী দিন কাটাচ্ছে। ইচ্ছে করলে সে কী পারতো না, হিংস্র হয়ে যেতে? কিংবা উগ্র জীবন যাপন করতে?

প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আর তার সাথে মেলানোর চেষ্টা করছিলাম 'হলি আর্টিজান' হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের জীবন-ব্যবস্থা। তখন অনেকের মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ওই ছেলেগুলো জঙ্গি হয়েছে কারণ তারা তাদের পরিবারের আদর-যত্ন থেকে অবহেলিত ছিল। আর সেই সাথে তাদের ব্রেইন-ওয়াশ হয়েছে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ

আজকে এই ছেলেটাকে নিয়ে লেখার একটাই কারণ, বাবা-মা থেকে দূরে থাকলে যে জীবন নষ্ট হয়ে যায় এই ধারণাটি ভুল। বরং সঠিক দিক-নির্দেশনা থাকলে তা স্বাবলম্বী হতে শেখায়।

'হলি আর্টিজান' ঘটনায় জঙ্গিদের কেউ কি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল? বরং সবার বয়স আঠারোর বেশি ছিল এবং সবাই বাংলাদেশের ভাল ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা অর্জন করেছিল। যদি তাদের বয়স ১৮-এর নিচে হতো তাহলে 'ব্রেনওয়াশ' কথাটি তাদের জন্য প্রযোজ্য হতো।

ঠিক স্টিফেনও প্রতিনিয়ত অনেক নেগেটিভ এবং পজেটিভ বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই বলে কী সে মানুষের কথার দ্বারা প্রলোভিত হয়ে কিংবা ব্রেন ওয়াশড হয়ে জড়িয়ে পড়ছে উল্টা-পাল্টা কর্মকাণ্ডে? চাইলেই বিলেতে কিংবা পশ্চিমা সমাজে অনেকে নিজের জীবনটাকে নিয়ে বাজিতে মেতে উঠতে পারে।

সে কি বেছে নিতে পারতো না হলি আর্টিজেনের জঙ্গিদের মতো জীবন! যদি তাই হয়, তাহলে স্টিফেনের জীবন কেন বিপরীত হলো? সেও তো বাবা-মার আদর, শাসন ও পারিবারিক শিক্ষা ছাড়াই বড় হচ্ছে এবং নিজের জীবনটাকে উপভোগ করছে। এদেশে তো আমরা উল্টো চিত্র দেখতে পাচ্ছি, ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলতে পারছে।

তবে এটাও ঠিক যে, আমাদের দেশে ছেলে-মেয়েদেরকে মানুষ করার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবার ওপরে। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে আসে, তখন তারা শিক্ষার পাশাপাশি চাকরিও করে। সেই চাকরির টাকা তারা পরিবারের জন্যও পাঠায়। এভাবে তারা পরিবারকে সহযোগিতা করে আসছে পড়াশোনার পাশাপাশি।

এরা সবাই তো বাবা-মার আদর ও শাসন ছাড়াই নিজেদের গন্তব্যস্থল নিজেরাই তৈরি করছে। তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধের সম্মুখীন হচ্ছে। ইচ্ছে করলে তারা তাদের জীবন নষ্ট করতে পারতো বাবা-মার অনুপস্থিতির কারণে।

শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা তাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে না। অথচ অনুকূলে থেকেও কিসের আশায় কিছু তরুণ জঙ্গিবাদের ভেলায় চড়ে বেড়াচ্ছে আমার তা বোধগম্য হচ্ছে না। একাকীত্ব মানেই ধ্বংসের দিকে যাওয়া নয়, বরং নিজেকে গড়ে তোলার উৎকৃষ্ট পন্থা।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক মিডিয়া কর্মী

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!