বছরের এই একটি দিনের জন্য লন্ডনের সব প্রবাসী বাঙালিরা অপেক্ষা করতে থাকে অনেক আগ্রহ ও আনন্দের সাথে। আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কোন দিনটির কথা বলছি। হুম, ঠিকই ধরেছেন- পহেলা বৈশাখের দিনটি।
আমরা সবাই জানি, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব ‘বাংলা নববর্ষ’ আর বাংলা নববর্ষের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। এখানেও অনেক আনন্দ ও উদ্দীপনার সাথে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। তবে এখানে পালন করার নিয়মটি একটু অন্য রকমের।
গত বছর টাওয়ার হামলেট আয়োজন করেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং সেই সাথে আরও ছিল শিশুদের জন্য রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানগুলো সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল, তবে কাজের কারণে মিস করেছিলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা।
ইংল্যান্ডে আসার পর মনে হচ্ছিল, এখানে যদি সবাই পহেলা বৈশাখটি পালন করতে পারতো! মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মেলার জন্য খুব মন টানছিলো। কারণ বাংলাদেশে থাকতে কখনও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না যেয়ে থাকতে পারতাম না।
ঠিক তখনই আমার ছোট বোন বললো, চিন্তা করিস না এইখানেও সব বাঙালিরা খুব আনন্দ ও উদ্দীপনার সাথেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে।
তারমধ্যে প্রথম চিন্তা ছিল, কীভাবে কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি পাবো? আবার একদিক দিয়ে বেঁচে গেলাম, মেলাটি রোববারে হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিয়ে চিন্তা করতে হলো না।
আমার যতদূর মনে আছে, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করে কোনো রকমে তৈরি হয়েই ছুটে গিয়েছিলাম মেলাতে। সাধারণত বাংলা নববর্ষের মেলাটি সবসময়ই আয়োজন করা হয় পূর্ব লন্ডনেই।
তবে সবচেয়ে যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করেছে তা হলো, বেশিরভাগ পুরুষরা পাঞ্জাবি ও নারীরা লাল পাড়ের সাদা রংয়ের শাড়ীর সাথে মিলিয়ে দেশিয় গহনা পরে এসেছিল।
মেলাতে ঢোকার সাথে সাথে দেখতে পেলাম, বিশাল মাঠ জুড়ে পুরো মেলাটি আয়োজন করা হয়েছিল। এ যেন অন্য রকম অনুভূতি! সবচেয়ে অবাক লেগেছিল, আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়েছিল দীর্ঘ ১০ বছর পর।
একটু মন খারাপ ছিল প্রথমে। কারণ আমি মনে হয় কনসার্টটা মিস করবো। কিন্তু সেটা শুরুর প্রায় পরপরই পৌঁছে গিয়েছিলাম। এরপর পুরো মেলাটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং উপভোগ করলাম।
চারিদিকে শুধু বাঙালি আর বাঙালি! এ যেন আরেক বাংলাদেশ। মেলাতে সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয় ছিল বিভিন্ন রকমের বাংলা খাবার, যেমন- সাদা ভাত, ইলিশ মাছ, বিরিয়ানি, তেহারি, চটপটি, ফুসকা, সমুচা ও সিঙ্গারা ইত্যাদি।
এছাড়াও ছিল দেশিয় পোশাকের স্টল, যেমন- সালোয়ার কামিজ থেকে শুরু করে জামদানি, টাঙ্গাইল ও সুতি টাইপের বিভিন্ন ধরনের ডিজাইনের শাড়ী এবং মূল্য ১০ পাউন্ড থেকে শুরু করে ৫০০ পাউন্ড পর্যন্ত ছিল। এমনকি আয়োজকরা বাচ্চাদের জন্য আয়োজন করেছিল বিভিন্ন ধরনের খেলনা বা রাইডস।
এছাড়াও কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিলো, ওই মুহূর্তে আমি শাহবাগ চত্বর বা চারুকলায় আছি। একের পর এক বাংলা গানে মুখরিত হয়ে উঠছিল পুরো মাঠ। টানা ৬ দিন কাজ করার পরও এক ফোঁটা ক্লান্তি অনুভব করিনি ওইদিন, বরং আনন্দের সাথেই দিনটি কাটালাম।
যেহেতু বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পেয়েছে, সেহেতু এবারেরটি হয়তো অন্যরকম হবে।
ধন্যবাদ জানাচ্ছি এখানকার বাঙালি কমিউনিটিকে, যাদের প্রচেষ্টায় প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা ও মেলাটি আয়োজিত হয় এবং এই আয়োজনের মাধ্যমেই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ফুটে উঠে। আরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই কারণে যে, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি এখনও বেঁচে আছে।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী
ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ
ই-মেইল: topu1212@yahoo.com
লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |