প্রবাসীর স্বদেশ ভাবনা:  ধর্মের অজুহাতে উৎসবে সংকোচ

জন্ম হওয়ার পর থেকে আমরা ইংরেজি নববর্ষ, বাংলা নববর্ষ ও ফসলী সনের নববর্ষসহ বিভিন্ন নববর্ষ পালন করে আসছি। এই ইংরেজি নববর্ষ পালনের মাধ্যমে আমরা পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে আনন্দের সাথে নতুন বছরকে স্বাগত জানাই।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Jan 2017, 06:05 AM
Updated : 17 Jan 2017, 06:16 AM

সাধারণত উৎসব বলতে সামাজিক, ধর্মীয়  এবং ঐতিহ্যগত প্রেক্ষাপটে পালিত আনন্দ অনুষ্ঠানকে বোঝায়। আমরা নিজেরাই তফাৎ সৃষ্টি করেছি ইংরেজি ও বাংলা নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে। এক কথায়, ইংরেজি নববর্ষ পালনের ধরনটা বাংলা নববর্ষের বিপরীত।

পহেলা বৈশাখে আমরা দেশিয় ধরনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পুরো দেশ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠি। তবে ইংরজি নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে কিছু বাধা সৃষ্টি হয় আমাদের মানসিকতার জন্য। এছাড়াও ধর্ম ও রাজনীতির কারণেও এই উৎসবগুলো পালনে অনেক বাধা-বিপত্তি আসে।

বাল্যকাল থেকে পরিবার ও সমাজ থেকেশুনে আসছি, ইংরেজি নববর্ষ হচ্ছে খ্রিস্টানদের উৎসব। আর বাংলা নববর্ষ হচ্ছে হিন্দুদের উৎসব। শুধু তাই নয়, বলা হয়ে থাকে যে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করা মুসলমানদের জন্য হারাম।

এই ধারণা থেকেই বোঝা যায়, শিশুকাল থেকে আমাদের চিন্তা ও চেতনার মধ্যে পার্থক্যের সৃষ্টি করছে ধর্ম। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুতে আমরা ধর্মকে টানি এবং বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করি।

আমাদের দেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ এবং সবারই মৌলিক অধিকার রয়েছে যার তার মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার। যদি তাই মনে করি, তাহলে প্রত্যেকটি উৎসবকে কেন আমরা বিভক্ত করে ফেলি ধর্মের ভিত্তিতে। শুধু উৎসব নয়, আমাদের ব্যবহারেও ভিন্নতা দেখা যায়।

অনেকের ধারণা,যারা থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করে, তারা কেউ ভদ্র পরিবারের নয়। সেই সাথে রাতটি উদযাপনের মাধ্যমে আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতি কলুষিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা আমাদের আনন্দগুলোকে কবর দিচ্ছি ধর্মের কারণে।

আমরা যতই বলি, আমাদের জাতি শিক্ষিত হয়েছে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। বলতে গেলে আমরা পরিপূর্ণ শিক্ষিত জাতি। কিন্তু আপসোস, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের বিবেক-বুদ্ধি এখনও বিকশিত হয়নি!

২০১৭ সালে এসেও যদি আমরা বলি, থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করা হারাম এবং আমরা আমাদের সংস্কৃতিকে কলুষিত করছি, তাহলে কোথায় গিয়ে আমরা দাঁড়াবো?

বিলেতে পড়ালেখা করতে এসে পরিচিত হলাম এখনকার বাঙ্গালী কমিউনিটির সাথে। এতদিন ধারণা ছিল, বিদেশে যারা থাকে তারা মনে হয় অনেক উদার বা লিবারাল মানসিকতার। কিন্তু পরে বুঝলাম, মাঝে মাঝে বিপরীত চিত্রও দেখা যায়।

এখানে অনেক পরিবার আছে যারা থার্টি ফার্স্ট নাইটকে মনে করে নোংরামীর রাত। এদের অনেকেই বলেন, আমি মুসলিম, এজন্য এই রাত আমার জন্য হারাম। বিদেশের সংস্কৃতি মেনে নিতে এত সমস্যা থাকলে পাশ্চাত্য দেশে না থাকাই ভালো।

অনেককেই আবার দেখলাম, নতুন বছরকে স্বাগত জানানো থেকেও বিরত থাকতে। সারা বছর ইংরেজি সাল অনুসরণ করা হয়, তখন তাদের কোন আপত্তি থাকে না, শুধুমাত্র বর্ষবরণের বেলায় যত ঝামেলা!

মজার বিষয় হচ্ছে, কোন ধর্মেই এই রাত নিয়ে কোন কিছু লেখা নেই। বরং আমরা নিজেরাই এই মনোভাবগুলো তৈরি করছি নিজেদের মধ্যে। তবে এটাও ঠিক, অনেকেই এই রাতটাকে উগ্রভাবে পালন করে।

প্রশ্ন হলো, আমরা কেন পাশ্চাত্য দেশকে অনুসরণ করবো? আমরা আমাদের নিজস্ব ধরনে উৎসব পালন পারি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরাও উগ্রভাবে পালন করবো। প্রত্যেকটি ধর্মের মানুষ যখন একত্রিত হই বাংলা নববর্ষ পালন করার জন্য, ঠিক তেমনি কি পারি না ইংরেজি নববর্ষটিকে পালন করতে?

সারাবিশ্ব যখন আনন্দের সাথে এই দিনটি পালন করে, ঠিক তার বিপরীত চিত্র দেখি আমাদের দেশে। প্রত্যেকটি মানুষ অপেক্ষা করে পুরনো বছরকে ভালোভাবে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগতম জানাতে। আমরা কি পারি না সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে একসাথে ইংরেজি নতুন বছরকে আমন্ত্রণ জানাতে?

লন্ডন কর্তৃপক্ষ থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে প্রতিবছর আয়োজন করে বর্ণিল আতশবাজি এবং এটি উপভোগ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক সমাগম হয়। শুধু তাই নয়, এই আতশবাজির মাধ্যমে উর্পাজিত অর্থ ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক, বিশেষত পর্যটনক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতি বছরই।

একইভাবে আমরাও বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তুলতে পারি আমাদের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে। নানা ধরনের ইভেন্ট ও আতশবাজির ঝলকানি দিয়ে কীভাবে আমাদের পর্যটন শিল্পকে সবার সামনে তুলে ধরা যায়, সে ব্যবস্থাই করা উচিত।

বছরখানেক সময় ধরে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিয়ম-কানুন ও নিরাপত্তা থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে। তবে রাত ৮টার মধ্যে সব ধরনের অনুষ্ঠান পর্যটন নগরীগুলোতে বন্ধ করে দিয়ে আদৌ কোন সমাধান আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

একবার কোন বাস দুর্ঘটনায় পড়লে কি আমরা সারাজীবনের জন্য বাসে চড়া ছেড়ে দেব? এটা কী কোন সমাধান হতে পারে? অবশ্যই না। আর যে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাদের দেশে ইংরেজি বর্ষবরণে বাধা দেওয়া হচ্ছে, সেই একই কারণে তো ইংল্যান্ড-আমেরিকা কিংবা ফ্রান্সও সবধরনের সেলিব্রেশন থেকে দূরে থাকতে পারত। বরঞ্চ সেটা না করে তারা সবার জন্য তারা নিরাপত্তা বিধান করে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে তাদের পর্যটনশিল্পকে।

আমরাও যাতে সুশৃঙ্খল আর আনন্দের সাথে প্রতিবছর ইংরেজি বর্ষবরণে সামিল হতে পারি আর বিকশিত হতে পারে আমাদের পর্যটনশিল্প, তার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানকে। আর সচেতন নাগরিক হিসেবে সংযত ও সুশৃঙ্খল আচরণ করা প্রত্যেকের দায়িত্ব।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!