প্রবাসে অভিজিৎ রায়কে স্মরণ

অভিজিৎ রায়, একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক। কিছুদিন আগেও নিয়মিত তার লেখা পাওয়া যেত।এক ধরনের অপেক্ষায় থাকতাম- কবে, কখন অভিজিৎ’দার লেখা প্রকাশিত হবে আর তা থেকে নতুন কিছু শিখতে পারবো।

শাফিনেওয়াজ শিপু, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2017, 05:53 AM
Updated : 26 Feb 2017, 05:53 AM

এখন অভিজিৎ রায় শুধুই আমাদের স্মৃতির পাতায় বন্দি। আর আসবে না নতুন কোন প্রকাশনা। চিন্তা করলেও যেন বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করি। ব্যক্তিগতভাবে অভিজিৎ’দার সাথে কোন পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি, নিজেকে কখনও যোগ্য মনে করিনি তার সাথে যোগাযোগ করার মতো।

হয়তো তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতেন। কিন্তু তার জ্ঞানের পরিধির কাছে আমি যে অতি নগণ্য! তাই সাহস করে কখনও ইমেইল কিংবা ফেসবুকে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু নিয়মিত তার লেখা অনুসরণ করেছি অনেক দিন।

তার লেখনীতে যেন ছিলো অন্যরকম এক ধরনের নেশা ধরানো ব্যাপার। আমাদের দেশের অনেক লেখকই রয়েছেন, যারা বিভিন্ন ধরনের তাত্ত্বিক বিষয়ে লিখে থাকেন। কিন্তু অভিজিৎ’দার বিষয়টা ছিলো সম্পূর্ণ অন্য ধরনের।

ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তার লেখাতে দিয়েছেন হাজার হাজার প্রমাণ। বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ সহকারে খুব সহজ ভাষায় নিরলসভাবে লিখে গেছেন আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তার প্রতিটা লেখায় বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্কের ছাপ ছিলো খুবই সুস্পষ্ট।

কতিপয় ধর্মান্ধ মানুষের এ ধরনের বৈজ্ঞানিক যুক্তি অকাট্য মনে হওয়ায় তারা সব সময়ই অভিজিৎ’দার বিপক্ষে আজে-বাজে মন্তব্য করতো। হয়তো কখনও তাদের সাথে তর্কে জড়াইনি, তবে ভালোও লাগেনি একদম। কেননা অভিজিৎ রায় বা তার লেখনীর মূল্য ছিলো আমার কাছে ভিন্ন ধরনের।

ফাইল ছবি

অনেক ব্লগাররাই তাদের যুক্তি স্থাপন করতে অনেক সময় বেছে নেন আক্রমণাত্মক লেখনী বা শব্দ। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের কোন লেখাতেই কখনও আমি কোন আক্রমণাত্মক কিছু খুঁজে পাইনি, বরং পেয়েছি সহজ সরল যুক্তি। সকল বিষয়ের অনেক জ্ঞান ও তার উদার মনমানসিকতা, যা প্রমাণ করে একজন প্রকৃত মুক্তমনার।

হয়তো কখনও অভিজিৎ রায়’কে বা তার লেখার সাথে পরিচয় হতো না। একদিন নীলক্ষেতে কিছু বই খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’। সেই বইটি পড়তে গিয়েই আসলে পরিচিত হই ‘মুক্তমনা’ ব্লগের সাথে। মুক্তমনা হলো একটি অন্যরকম ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম যেখানে যে যার যুক্তি অনুযায়ী নিজের মনোভাব প্রকাশ করতে পারে।

মুক্তমনার লেখাগুলো খুব আকর্ষিত করতো আমাকে। প্রায় নিয়মিতই মুক্তমনার লেখাগুলো পড়তে লাগলাম। সেখানকার অনেকের লেখাই ভালো লাগতো, তাদের মধ্যে একজনের লেখা আমার কাছে খুব তীক্ষ্ণ ও দৃঢ় মনে হয়েছিলো। আর সেই একজন ছিলেন অভিজিৎ রায়। তার লেখনী ছিলো ভিন্ন ধরনের, অনেক শক্তিশালী। তার পুরনো লেখার আর্কাইভ থেকে প্রায় সবগুলো লেখাই পড়তে শুরু করি। যতই পড়তে থাকি, ততোই চিন্তাধারার ধরন পালটে যায়। অনেকটা উদার মানসিকতা ধারণ করতে সক্ষম হই।

কেন জানি মৌলবাদীরা অভিজিৎ’দাকে খুব অপছন্দ করতো। অনলাইনে বিভিন্ন জায়গায় অভিজিৎ’দাকে নিচু দেখানোর চেষ্টা করা হতো। একটা পর্যায়ে তারা কোনভাবে খবর পেলো অভিজিৎ রায় বাংলাদেশ ভ্রমণে আসছেন। তাও তার একটি বই প্রকাশ করবার জন্যই মূলত দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। কিন্তু তাকে বাঁচতে দেয়নি মৌলবাদীরা!

টিএসসি চত্বরে লোকারণ্য জায়গাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে র‍্যাব-পুলিশ বাহিনীর চোখের সামনে অভিজিৎ’দাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে। আক্রমণ করে তার স্ত্রী বন্যা আপাকেও। বন্যা আপার জীবন কেড়ে নিতে পারেনি ঠিক, কিন্তু তার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রেখে যায় ক্ষত। মুহূর্তের মধ্যে বন্যা আপার সুখের সংসারে নেমে আসে অন্ধকার!

অনেকেই আবার বলে থাকেন, সকল নাস্তিকরা নাকি অভিজিৎ’দাকে তাদের নবী হিসেবে দাবি করে এবং তার কথাতেই নাকি সবাই চলে। এমনও শুনতে পাওয়া যায় যে, অভিজিৎ’দাকে নাকি অনেকে আবার ঈশ্বরের সমতুল্যও ভাবতেন। কিন্তু এ কথাটি যে নিছক একটি বানোয়াট ও মিথ্যা কথা, তা মুক্তমনাসহ অন্যান্য ব্লগে নাস্তিক্যবাদী লেখকদের বিভিন্ন লেখা পড়লেই পাওয়া যায়।

শাফিনেওয়াজ শিপু

অভিজিৎ রায়ের লেখার ভিত্তি ছিল বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ। যাবতীয় কুসংস্কার, সামাজিক নিপীড়ন ও অনাচারের নির্মোহ বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ব্যক্তি জীবনে মানবতাবাদী অভিজিৎ সোচ্চার হয়েছেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনায়, যেখানে মানবতা বিপন্ন হয়েছে।

অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তার জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তার লেখা বইগুলোর প্রতিটিতেই যুক্তি, কার্যকারণ এবং পর্যবেক্ষণের বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তার লেখা ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। এর দু’বছর পর ২০০৭ সালে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ শীর্ষক বইতে পৃথিবীতে প্রাণের উৎস কীভাবে হলো তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে লিখেছেন তিনি ও সহলেখক ফরিদ আহমেদ। আমাদের এই পৃথিবীর বাইরেও অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা, কিংবা এর সম্ভাবনা কতটুকু- তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই বইতে।

আধুনিক জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন নিয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল অভিজিৎ রায়ের। এই বিষয়ের ওপর অসংখ্য ব্লগ লিখেছেন তিনি। এছাড়াও ২০১০ সালে ‘সমকামিতা’ শীর্ষক বইয়ে সমকামিতার জীববৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

২০১১ সালে সহলেখক রায়হান আবীরের সাথে লিখেছেন ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। স্রষ্টাবিশ্বাসী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, নিরীশ্বরবাদী বা মানবতাবাদী, সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক প্রতিটি বাংলাভাষী পাঠকের জন্য এই বইটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজনা। জাত-প্রথা-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়তে এই বইটি মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছে ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে। প্রকাশের সাথে সাথেই মননশীল পাঠকদের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল এই বইটি।

একইসাথে যেমন এখানে ধর্মবিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তেমনি আলোচনা করা হয়েছে চলমান কুসংস্কার নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমেই এসেছে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের স্বরূপ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা। তার পরবর্তীতে অভিজিৎ রায় প্রকাশ করেন ‘ভালোবাসা কারে কয়’ বইটি। এই বইয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা ইত্যাদি মানবীয় অনুভূতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। মানব-অনুভূতির বিবর্তনীয় ব্যাখ্যার এই অভূতপূর্ব বইটিও পাঠক-সমাদর পেয়েছিল। তার লেখা অন্যান্য বইগুলো হলো- ‘স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’, ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’, ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’।

সবশেষে আমি শুধু এটুকুই বলবো, চাপাতির কোপে একজন অভিজিৎ’কে হত্যা করা সম্ভব কিন্তু তার সত্ত্বা আমাদের মতো হাজারও মুক্তমনা ব্যক্তিদের মধ্যে বেঁচে থাকবে চিরজীবন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার ছিলো তীব্র অবস্থান। আর সে ‘অপরাধেই’ তিনি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর চক্ষুশূলে পরিণত হন।

অভিজিৎ রায় যে মুক্তচিন্তার প্রচার ও প্রসারের জন্য কাজ করে গেছেন, সেটা আমাদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ। সেই একই লক্ষ্য নিয়ে আমরা সবাই নিরলসভাবে কাজ করে যাবো, এটাই আমার প্রত্যাশা। মুক্তচিন্তার জয় একদিন হবেই।

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী ও সাবেক গণমাধ্যমকর্মী

ই-মেইল: topu1212@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ

লেখকের আরও পড়ুন