প্রবাসীর স্বদেশ ভাবনা: আমরা রেকর্ডে বিশ্বাসী

বরাবরই আমরা প্রতিযোগিতায় মেতে থাকি। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠার প্রাধান্য শৈশবকালে ছিটেফোঁটা দেখা গেলেও পরবর্তীতে ডুমুরের ফুলে পরিণত হয়।

শারমিন জান্নাত ভুট্টো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2017, 08:01 AM
Updated : 29 April 2017, 04:32 AM

শৈশবে প্রতিযোগিতার ধরণ যা ছিলো, তা মনে করলে এখনও হাসি পায়। তবুও তাতে কয়েকবার মত্ত হয়েছিলাম আমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। এই যেমন ধরুন, আমার মা বাসায় এসে বললেন, ওমুকের মেয়ে দিনে ৮ ঘণ্টা পড়ালেখা করে কিংবা তমুকের ছেলে অংকে ৯৮ পেয়েছে। পড়ালেখা বিষয়ক মায়ের কথা বেশিরভাগ সময়ই না শোনার ভান করতাম।

তবে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে একবার অংকে ফেল করায় (৪০ নম্বরে পাস ছিলো, ৩৮ পেয়েছিলাম) যখন মান-ইজ্জত আর অস্তিত্বের সংকটে পড়লাম, তখন ভাবলাম- এইবার আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আসলে ঠেলার নাম বাবাজি! কারণ চূড়ান্ত পরীক্ষায় ৭০ এর ঘরে নাম্বার না থাকলে গড়ে আমার পাশ হবে না। আর সেই সাথে একই ক্লাসে পরপর দু’বছর থাকার তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে।

যাই হোক, উপায়ন্তর না দেখে টানা এক সপ্তাহের প্রস্তুতি আর দিনে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা অংক কষে মূল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে ৭৮ নম্বর পেলাম আর রোল নম্বর ৬৩ থেকে সোজা এসে নামলো ১৩ তে। অংকের নাম্বার থেকে শুরু করে রোল নাম্বার, সবই আমার আজও মুখস্থ শুধু ওই বিভীষিকাময় সময়টার কারণে।

তবে এটাও বুঝলাম, কোন মতে যদি একবার কাউকে প্রতিযোগিতায় ঠেলে নামিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই কেল্লা ফতে। তবে আমাদের সময় যাকে আমরা প্রতিযোগিতা বলতাম, সময়ের পরিবর্তনে এখন তা পাল্টে হয়েছে রেকর্ড। এই যেমন- অমুক সরকারের আমলে তমুক শিক্ষাবোর্ডে পাশের হার সবোর্চ্চ। নতুবা রেকর্ড পরিমাণ জিপিএ পেলো শিক্ষার্থীরা। রেকর্ডের ছড়াছড়িতে মোটামুটি ভেসে যাচ্ছি আমরা। ‘গিনেস’ বাবার কারণে এখন তো উঠতে-বসতে রেকর্ড আর রেকর্ড।

বছর কয়েক আগে কোনও এক দেশ জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে রেকর্ড করলো, আর তা দেখে তেলে-বেগুনে জ্বলে গাইলাম আমরাও নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত একসাথে। তাও আবার বিজয় দিবসে। দেশে-প্রবাসে যেখানেই বাঙালি ছিলো, সবাই কম-বেশি চেষ্টা করেছে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ডের গর্বিত অংশ হতে। এমনকি বিলেতের বাঙালিদের একটি অংশও জড়ো হয়েছিলো পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে।

সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমারও। ভালোই লেগেছিলো একসাথে কণ্ঠ মেলাতে। তবে অন্তরে ধারণ করার চাইতে যদি কণ্ঠ মেলানো বা অংশগ্রহণই মূল হয়ে ওঠে, তখন অবশ্য তুলনামূলক অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর জানা নেই বিজয় দিবস কবে।

এমনকি বৃহত্তম মানব পতাকার রেকর্ডেও আমাদের দেশের নাম।

বিশ্ব রেকর্ডে নিজের দেশের নাম দেখতে কার না ভালো লাগে। আর কোন এক বিজ্ঞাপনের ভাষা পাল্টে আমাকেও বলতে হচ্ছে, রেকর্ড থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে রেকর্ডই ভালো। কমপক্ষে এ উসিলায় তো কিছু হাসিল হচ্ছে, নাকি?

তবে এখানে যে সমস্যাটি আছে তা হলো, একদিনের রেকর্ডে আমরা যতটা শ্রম দিচ্ছি আর উৎসাহ দেখাচ্ছি, তার সিকিখানি যদি বহু বছর আগে থেকে চলে আসা সংস্কৃতির জন্য হতো, তবে তা অন্তরে ধারণ করাটা আরও সহজতর হতো।

আমরা যা, তাই আমাদের সংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতি একদিন-দু’দিনে গড়ে ওঠেনি। আমাদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য আমাদের ব্যক্তিসত্তা আর ইতিহাস জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে আসছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা দিবস পালন করে আসার প্রেক্ষিতে এখন তা আন্তর্জাতিক দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ দিনটির জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতেও বাঙালিদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।

সর্বপ্রথম কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালি- রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রথম ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণার আবেদন জানায়। এরপর ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ৪৭ বছর পর কোন জাতীয় দিবস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি পাওয়ার রেকর্ডটিও কি আমাদের দেশের কিনা, তা ঠিক জানা নেই।

মজার বিষয় হচ্ছে, যে ইউনেস্কা থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা মিলেছে, ঠিক তেমনি পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার বিষয়ে আমাদের যে উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার কথা, তা কতিপয় গোষ্ঠী ধর্মের সুতা টেনে দ্বিধাবিভক্ত করতে চাইছে।

দুনিয়ার হেন কোন দিবস নাই যে আমাদের দেশে পালন করা হয় না। শুধু পহেলা বৈশাখ পালন করার সময় আসলেই কেউ মেয়েদের বুক খামচে ধরে মেলায় ভিড়ের মাঝে নয়তো কেউ হিজরি বর্ষপঞ্জিকার খোঁজ লাগাতে থাকে আর কেউ আবার ধর্মের দোহাই দিয়ে অগ্রিম উৎকণ্ঠায় হাশর মিস হওয়ার ঘোষণা দিতে থাকেন।

একটা তথ্য জানিয়ে রাখি এখানে। সৌদি আরব ২০১৬ সালের ১ অক্টোবর থেকে হিজরি বর্ষপঞ্জিকা বাদ দিয়ে পশ্চিমা বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা শুরু করেছে তাদের সরকারি কর্মকাণ্ডের সুবিধার্থে। ধর্মের কারণে তো আমাদের অনেকেই সৌদির রীতি-নীতি উঠতে-বসতে অন্ধের মতো অনুসরণ করে। তো তারা কি জানেন, তাদের ধর্মপ্রিয় দেশটিও মাঝে-মধ্যে পরিবর্তন, পরিবর্জন আর পরিবর্ধনের দিকেও চলা শুরু করে।

সে যাক গে, কথা শুরু করেছিলাম রেকর্ড দিয়ে। আজ যদি কোনভাবে জানা যায় অমুক দেশ সবচেয়ে বড় র‍্যালি বা শোভাযাত্রা করে গিনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ডে ঠাঁই করে নিয়েছে তাদের নাম, দেখবেন কাল নয়তো পরশুই আমরা নেমে পড়বো সেই রেকর্ডটি ভাঙতে। তখন অবশ্য ধর্মের কল বাতাসে নড়বে না, এমনকি কোনভাবে আপনার দরজায় কড়াও নাড়বে না।

অবস্থা তখন এমন দাঁড়াবে যে, টক্কর দিতে শুধু পহেলা বৈশাখেই মঙ্গল শোভাযাত্রা নয় বরং পহেলা জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ প্রায় প্রতিটি মাসেই কোন না কোনভাবে শোভাযাত্রা করা হবে আর রেকর্ডটি আমাদের নামে রাখার চেষ্টা চলবে।

আমরা বাঙালিরা বেশ আমুদে কিনা, তাই অল্প পরিশ্রমে পাওয়া কোন স্বীকৃতি তেমন একটা গায়ে না লাগিয়ে বরঞ্চ পাড়া-প্রতিবেশী জড়ো করে গড়ে তোলা কোন রেকর্ডেই বেশি খুশি আর বেশি বিশ্বাসী।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার

ই-মেইল: Sharminbhutto@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!