সবগুলো কাজ আমি আমার জীবনে কোন না কোন এক সময় করেছি এবং প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড। আর এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে দুটি বিষয়- নতুন কিছু করার বা দেখার উন্মাদনা আর ভবিষ্যতে ঠাকুরমার নয় আমার নিজস্ব গল্পের ঝুলি বানানো।
তবে অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে সব সময়ই যে বিষয়টি মাথায় রেখেছি, তা হলো নিজের কোনও কাজে যেন অন্যের ক্ষতি কিংবা নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করি।
লোকমুখে প্রচলিত গল্প এই যে,কুইন মেরিকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সেখানে অবস্থিত চার্চটি তিনবার প্রদক্ষিণ করে এসে 'ব্লাডি কুইন মেরি' বললে নাকি সেই মিশরীয় মমির চেহারা দেখা যেতো চার্চের জানালায়।
এ কাহিনী শুনে বিশ্বাস করবো কি করবো না-যখন এ দোদুল্যমানতায় ছিলাম, তখনই খেয়াল আসলো কুইন মেরিকে যেখানে সমাহিত করা হয়েছে তা দেখবার। অদ্ভুত এ খেয়ালের কথা অন্য তিন বন্ধুকে জানানোর সাথে সাথে সবাই একবাক্যে রাজী হয়ে গেল।
আমরা যখন সাইকেল নিয়ে গোরস্তানে ঢুকলাম, তখন ঘড়িতে বাজে বিকাল সাড়ে ৩টা। শীতকালে তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে যায় বলে একটু দ্বিধায় ছিলাম পুরো জায়গাটা ঘুরে দেখার ব্যাপারে। নিজের দ্বিধা আর সাহসিকতার অভাববোধ অনুভব করছিলাম ক্ষণে ক্ষণে। তবে তিন বন্ধুর কেউই আমরা কাউকে তা বুঝতে না দিয়ে চার্চ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি গোরস্তানের ভেতর।
গোলাকার স্থানটির একটি কোণে চার্চ আর তার তিনদিকেই সারি সারি সমাধিস্থল। আর এ চার্চ ও সমাধিস্থলের মাঝেই সরু পাকা রাস্তা যেখানে কেউ হেঁটে আর কেউবা আমাদের মতো সাইকেলে চড়ে যাচ্ছিল লোকালয়ের দিকে।
প্রথম গোরস্তান পার হওয়ার পর দেখলাম সামনে দেয়াল দিয়ে ঘেরা আরেকটি বড় গোলাকার জায়গা। তবে সামনে ছোট একটি গেট আছে যা খোলা। আর যতদূর চোখ যাচ্ছিল সেটির মাঝখান দিয়ে আরেকটি সরু পাকা রাস্তা গিয়ে ঠেকেছে শেষ প্রান্তের গেটে গিয়ে।
তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার কারণে আমার বোন শিপু সেদিকটায় যাওয়ার ব্যাপারে অমত জানালো। জোরাজুরি করায় অনেকটা বাধ্য হয়েই সে রওনা দিলো আমাদের সঙ্গে। ডানে-বামে শুধুই সারি সারি করব আর বড় বড় গাছের ডালের কালণে জায়গাটা বেশ ঘন অন্ধকার। প্রতিটি পাতার মড়মড় শব্দ স্পষ্ট পৌঁছে যাচ্ছে কানে। চারদিকে কেবলই নি:স্তব্ধতা আর শূন্যতা পরতে পরতে।
যেই কুইন মেরির সমাধি দেখবো বলে গোরস্তানে ঢুকব,মুহূর্তের মধ্যেই সে ইচ্ছে মিলিয়ে গেলো ভয় আর বিষণ্ণতায়। আমরা একজন আরেকজনকে শুধুই বলছিলাম,লোকটিকে অনুসরণ করতে আর সামনে গেট দিয়ে বের হয়ে যেতে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ঝাপটা মেরে উড়ে গেল এক দল পাখি। বলে বোঝাতে পারবো না, ঠিক সেই অবস্থায় আমাদের তিনজনের কী হাল হয়েছিলো!
বিশাল এক গোরস্তানের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিন হতভাগা। দুই পাশে কবর দেখে দেখে মাঝের রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে আমাদের আবার ফিরতে হবে চার্চের সামনে। সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের আরেক বন্ধু। তার কাছে ডিএসএলআর ক্যামেরা আর আমাদের মোবাইলগুলো।
সাইকেল চালাতে গেলে মোবাইল প্যান্টের পকেট থেকে পড়ে যাবে- এই ভয়ে সবগুলো মোবাইল আমাদের বন্ধু অপুর কাছে রেখে এসেছিলাম। তখন একবারের জন্যেও মনে হয়নি,হয়তো কোন এক সময় আমাদেরও মোবাইলের দরকার হতে পারে।
আমাদের কারোরই আত্মায় যখন পানি নেই নেই অবস্থা তখনও ভাবতে লাগলাম, এখানে শুয়ে থাকা মানুষগুলো যখন তাদের বন্ধু-পরিচিতজনদের সাথে ছিলো তখন কী তাদের মাঝে এতো ভয় ছিলো, মৃত্যু নিয়ে এখন আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি শুধু কবর দেখে। ক্ষণিকের মধ্যেই জগত সংসারের সব হিসেব-নিকেশ মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো!
সামনে আমি,মাঝে শিপু আর শেষে তৃণা এভাবে সারি বেঁধে আসতে থাকবে কারণ রাস্তাটি চওড়া নয়। আর সবাই একে অন্যের সাথে জোরে জোরে কথা বলতে বলতে আসবে যাতে করে যেন মাথা থেকে ভয়টা একটু দূরে থাকে। আর যেহেতু অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, তাই কোনভাবে যাতে নিজেকে একা মনে না করি ওই সময়টাতে। শিপু আর তৃণার কথা যতটা না শুনেছি তার চেয়ে বেশি শুনেছি তাদের যার যার ধর্ম অনুযায়ী পবিত্র বিভিন্ন দোয়ার শব্দমালা।
সাইকেল যখন চালাচ্ছিলাম তখন শুধু মনে হচ্ছিল,এ দুনিয়ায় যে যত বড়ই রাজা আর প্রজা হোক না কেন,সবারই একটা না একটা সময় এখানে এসেই ঠিকানা গড়তে হবে। এতো ক্রোধ,হিংসা আর অহমিকা যা পৃথিবীকে ঘিরে ধরছে প্রতিনিয়ত তার শেষ কোথায়…? কেনই বা মানুষ একে অন্যের অনিষ্ট সাধন করতে গিয়ে বিসর্জন দিচ্ছে নিজের সুখের সময়টুকু?
এসব উপলব্ধি করতে করতে কখন যে চার্চের গেটের সামনে এসে পৌঁছালাম তা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আর তার ওপর দূর থেকে অপুকে ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আত্মায় যেন পানি ফিরে পেলাম। নিজেদের তুলে নিয়ে এলাম জীবিত আর মৃতের মাঝখান থেকে। আর এভাবেই অসমাপ্ত রয়ে গেলো কুইন মেরিকে খোঁজার অভিযান।
তবে যে আত্মোপলব্ধি হলো তা হয়তো কুইন মেরিকে সহজে খুঁজে পেলে হতো না। কুইন মেরিকে না পাওয়ার বেদনা থাক না আমায় ঘিরে। কবিগুরু তো আর এমনিতে বলে যাননি- অতৃপ্তির বেদনা থাকা ভালো। আমিও আছি সেই ভিড়ে…
লেখক: সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!