লন্ডনের চিঠি: দেশে-প্রবাসে অভিজ্ঞতা ও পাকিস্তানি ধৃষ্টতা

এরমধ্যে অনেকেই জেনেছেন যে, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের আত্মত্যাগের বিষয়টিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে ডক্টর জুনায়েদ আহমাদ নামের এক পাকিস্তানি লেখক লিখেছেন- 'ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ: মিথস এক্সপ্লোডেড'।

শারমিন জান্নাত ভুট্টোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2017, 12:05 PM
Updated : 19 March 2017, 12:05 PM

বইটিতে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাকে অস্বীকারের পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর ওপরই উল্টো দোষ চাপানো হয়েছে গণহত্যার জন্য।

এ ধরনের একটি বই পাকিস্তানের পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে তার থেকেও বড় ধৃষ্টতা দেখিয়েছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা।

তারা রীতিমত চিঠি লিখে পাকিস্তানে বাংলাদেশ হাই কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছে, এ বইটিকে যেন ‘মূল্যবান দলিল’ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। ফ্রান্সের প্যারিসে প্রবাসী বাঙালিরা এরই মাঝে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে সেখানকার পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে। হয়তো অন্যান্য দেশেও প্রবাসীরা একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন।

গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আছে বলেই দেশটির দিনকেদিন এতো অধঃপতন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যখন যুদ্ধাপরাধীরা ফাঁসির দড়িতে ঝুলে, তখন পাকিস্তান তাদের সংসদ অধিবেশনে সেইসব স্বীকৃত খুনিদের পক্ষে শোক প্রস্তাব পাশ করে।

এতোদিন জানতাম, দেশটির নাক কাটা গেছে। কারণ একাত্তরে সশস্ত্র আর সজ্জিত সৈন্যবাহিনী থাকার পরও তারা আমাদের দেশের দামাল ছেলেদের কাছে হেরে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরও নানাভাবে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কাটা নাক আর গোবর মাথা খেলানোর চেষ্টায় রত ছিল।

অবশ্য কিছু কিছু রাজনৈতিক দল দেশটিকে তৈলমর্দন করতো। তবে এখন মনে হচ্ছে, দেশটির চক্ষু বলেও কিছু নেই। থাকলে তো চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও অন্তত মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে বিকৃত ছবি আর তথ্য উপস্থাপন করতে পারতো না।

তালেবানে বিধ্বস্ত এ দেশটি দেখলে এখন করুণাই হয় বটে। বিলাতে থাকার দরুণ বাংলাদেশিদের অন্যান্য এশিয়, বিশেষত পাকিস্তানি ও ভারতীয়দের সঙ্গে উঠ-বস করতে হয়। কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে হয়তো পাঠক বুঝতে পারবেন, কেন আমাদের দেশের ইতিহাস বিশ্বব্যাপী সঠিকভাবে তুলে ধরা দরকার।

ঘটনা-এক

একটি খাবারের দোকানে কাজ করতাম । সেখানকার পাকিস্তানি ম্যানেজার 'পদাধিকারের সুযোগ' নিয়ে প্রায়ই এসে দেশ, রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান দিতো।

২০১৩ সালে যখন লন্ডনের গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ট্রাফালগার স্কয়ার, আলতাব আলী পার্ক, বিবিসি’র সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি করছে আর পুরো বিশ্বকে জানান দিচ্ছে একাত্তরে ঘটে যাওয়া গণহত্যা, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে।

তখন একদিন সেই ম্যানেজার এসে আমাকে বোঝাতে লাগলো- কেন আমরা পুরনো ইতিহাস নিয়ে পড়ে আছি? আর ১৯৭১ সালে যা ঘটেছে, তা ভারতের একনিষ্ঠ ষড়যন্ত্রের কারণেই হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

ম্যানেজার আরও বললো, ভারত চায়নি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই ভাই একসাথে মিলেমিশে থাকুক।

কথাগুলো শোনার পর তাকে খুব সুন্দরভাবে বলতে বাধ্য হলাম, এতোই যখন বুঝলে, তখন রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লে কেন? ভাইদের মেরে ফেলার সময় এ বোধটুকু কোথায় ছিলো?

আমার কথাগুলো শুনে ম্যানেজার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শেষে তাকে বললাম, সমালোচনা নয়, বরং সমভাবে আলোচনা করতে চাইলে কাজ শেষে দেখা করো।

মজার বিষয় হচ্ছে, এরপরে আর কোনদিন ওই ম্যানেজার কিছু নিয়েই কথা বলতে আসেনি।

ঘটনা-দুই

স্টেশনের ফুড শপে কাজ করার সুবাদে প্রায় সব দোকানের ম্যানেজার থেকে শুরু করে কর্মচারী, সবাই মোটামুটি সবাইকে চেনে। একবার বিজয় দিবসে কাজ ছিলো ফুড শপে। আর সেটা শেষ করে আমার গায়ে লাল-সবুজ রঙের ফতুয়া দেখে এগিয়ে এসে একজন বিজয় দিবসের শুভেচ্ছাও জানালো।

আর সেই সাথে বীরের হাসি দিয়ে বললো, যুদ্ধটা হয়েছে মূলত ভারত-পাকিস্তানের। আর তার ফলশ্রুতিতে নাকি আমরা জয়ের স্বাদ পেয়েছি! কথাগুলো খুব বিষের মতো লাগলো। বুঝতে তখন বাকি থাকলো না, আমাদের দেশের ইতিহাস অন্যদের দ্বারা কীভাবে পাল্টে উপস্থাপিত হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক, নানা লেখকের বই আর চলচ্চিত্রে।

ঘটনা-তিন

এতোক্ষণ তো গেলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রদের কাণ্ড-কারখানা। এবার ফিরে আসা যাক নিজের দেশে, নিজের বাসায়।

বোনের ছেলে পড়ালেখায় বেশ পটু, পড়ছে ইংলিশ মিডিয়ামে। কাশ্মির থেকে কর্ণাটক- সব তার ঠোঁটের আগায়। তবে কুমিল্লা থেকে কুড়িগ্রাম সম্পর্কে সে যা শিখছে- তা হয় তার মা নয় তো নানির কাছ থেকে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেনো নিজের দেশ সম্পর্কে সে স্কুল থেকে কিছু শিখতে পারছে না? কারণ হচ্ছে- পাঠ্যপুস্তক। ইংলিশ মিডিয়ামে শিক্ষার্থীরা যে বইগুলো পড়ে, তার বেশিরভাগেরই লেখক হলেন ভারতীয়। আর এ কারণে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই লেখকের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, রাজনীতি গোগ্রাসে গিলছে।

ঘটনা-চার

স্কুল থেকে এবার কলেজে আসি। এ বছরের ২২ জানুয়ারি ময়মনসিংহে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ‘অন্বেষা স্কুল অ্যান্ড কলেজ’। স্বাধীনতাবিরোধী মোনায়েম খানকে ‘শহীদ’ আখ্যায়িত করা হয় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন দাপ্তরিক কাগজপত্রে। তাছাড়া মোনায়েম খানের মেয়ে নাসরিন মোনায়েম খান প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলটিতে কখনই স্বাধীনতা, বিজয় দিবসসহ কোনো দিবস পালন করা হতো না। আর কিছুদিন আগেই সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভীর স্ত্রী রিজিয়া রেজা চৌধুরীর তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ করে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতারা।

রিজিয়া একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানান, তার পিতা মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তবে জানা যায়, তার পিতা মবিনুল হক মুক্তিযুদ্ধের সময় আল-বদর কমান্ডার ও জামায়াতের সুরা সদস্য হিসেবে কাজ করতেন আর জড়িত ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে। আর এ অপরাধগুলো লুকাতেই যে যেভাবে পারছে সেভাবেই ইতিহাস বিকৃত করে চলছে।

এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মরণিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে জিয়াউর রহমান হলের ক্ষেত্রে সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে ‘বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সাবেক সেনাপ্রধান ও মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

আর স্মরণিকা প্রকাশিত হওয়ার পর বিক্ষোভের মুখে পড়ে এর দায়িত্বে থাকা রেজিস্টারকে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় স্মরণিকাটি।

আলোচনা দীর্ঘ না করে সরকারের আছে তিনটি বিনীত নিবেদন রাখছি।

প্রথমত, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যে দেশই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করবে, তাদের কড়া জবাব দিতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাই কমিশনের প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে আবোল-তাবোল আর ভুল-ভাল কোন তথ্য দিতে না পারে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যাতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জন্য বই সরবরাহ করে। আর সবশেষে, ইতিহাস বিকৃতি রোধে কড়া আইন প্রণয়ন।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

ই-মেইল:  Sharminbhutto@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!