লন্ডনে গিয়ে কাগজের বিয়ে

অভিবাসী আইনের পরিবর্তন ও কঠোরতা বৃটেন প্রবাসী এশিয়া ও আফ্রিকার শিক্ষার্থীদের জন্য দিনকেদিন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শারমিন জান্নাত ভুট্টো, লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2016, 02:48 PM
Updated : 24 Sept 2016, 03:49 PM

বাংলাদেশ থেকে এখানে পড়তে আসা অনেকেই পাঁচ-ছয় বছর টানা থাকার ফলে বৃটেনের সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে।

উন্নত জীবনের হাতছানি আর অভ্যস্ততা বিসর্জন দিয়ে প্রবাসী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ আর ফিরতে চাইছে না নিজ ভূমে।

ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর অন্য কোনও উপায় না দেখে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বৃটিশ বা ইউরোপিয় নাগরিকদের বিয়ে করার পথ। তবে এই বিয়ে আট-দশটা সাধারণ বিয়ের মতো নয় যেখানে স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে বসবাস করে সনাতনী পরিবার গঠন করছেন।

এই বিয়ে মননে মগজে নয়, কলমে কাগজে; বিনিময়ে ভালোবাসা নয়, থাকে অর্থই প্রধান।   

ইউরোপিয় হিউম্যান রাইট কনভেনশন অনুযায়ী, নন-ইউরোপিয়ান কোনও নাগরিক যদি ইইউভুক্ত কোনো দেশের নাগরিককে বিয়ে করে তবে আইন অনুযায়ী নন-ইউরোপিয়ান সেই নাগরিক ওই দেশে থাকার অনুমতি পাবেন।

আর এ আইনকে সম্বল করেই অনেক বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী হাঁটছেন সেই পথে। পেয়ে যাচ্ছেন তিন থেকে পাঁচ বছরের ভিসা, যা ‘বিয়ে ভিসা’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।

তবে উন্নত ও সুখি জীবনের খোঁজে কাগুজে বিয়ে করা প্রবাসী তারুণ্য আসলে আছে কেমন!  

চার প্রবাসী তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল তাদের নাজুক অবস্থার গল্প।    

এক.

ছবি কৃতজ্ঞতা: আনোয়ার জাহিদ

আরমান মালিক (ছদ্মনাম) সাত বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র এসেছিলেন শিক্ষা ভিসায়। ডিপ্লোমা, অনার্স আর মাস্টার্স করে চুকিয়েছেন পড়ালেখার পাট। আর এর মাঝেই কাজ করছিলেন একটি ফুড কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে।

ভালো বেতন আর ওয়ার্কিং আওয়ার থাকার কারণেই একই কোম্পানির অধীনে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।

আরমান জানালেন, সাত বছর হয়ে যাওয়ার ফলে আর কোনভাবেই ভিসা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছিলো না তার পক্ষে।

শেষে এক বন্ধুর পরামর্শে এগোতে থাকল চুক্তিবিয়ের দিকে। তবে এজন্য নাকি ভালোই পোহাতে হয় ঝক্কি-ঝামেলা।

কারণ, চাইলেই খুঁজে পাওয়া যায় না ইউরোপিয়ান মেয়ে যারা এ ধরণের বিয়েতে সাহায্য করতে আসবে। আর সাহায্যের বিনিময়ে মেয়েটিকে দিতে হবে মোটা অংকের অর্থের পাশাপাশি কিছু সামাজিকতা আর নাটকীয়তা।

এসবের মধ্যে সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ভ্রমণ, পার্টি, ভরণ-পোষণ এমনকি একসাথে রাতযাপনও আওতাভুক্ত।    

বৃটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া পোল্যান্ডের মেয়ে স্টেফানির সাথে ফুড শপে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় আরমানের। আর সেখান থেকেই শুরু হয় স্টেফানিকে কাগুজে বিয়েতে রাজি করানোর বিষয়টি।

স্টেফানি প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে বশে আসেন যখন আরমানও স্টেফানির দেওয়া শর্তগুলো মেনে নেন।

স্টেফানির দেওয়া শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে-তাকে নগদ অর্থ দিতে হবে, যেখানে কাজ করছে সেখানে প্রমোশনের ব্যবস্থা করতে হবে আর যে বাড়িতে তারা থাকবে তার ভাড়া গুনতে হবে আরমানকে।

ভিসা বাড়ানোর অন্য কোনও পথ খোলা না থাকাই সবকয়টি শর্ত চোখ বন্ধ করে মেনে নেন আরমান।

তবে এখন শঙ্কায় রয়েছেন- কখন স্টেফানি তার ওপর থেকে সদয় দৃষ্টি সরিয়ে নেন।

আরমান বলেন, “সব সময় এ ধরনের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপিয় তরুণী খুঁজে পাওয়া যায় না। আর পেলেও সব সময় দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস টিকিয়ে রাখা যায় না।”

ভিসা বিয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, যেসব তরুণীরা এতে সাড়া দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগই পোল্যান্ড কিংবা রুমানিয়ার। আর্থিকভাবে এসব দেশ কিছুটা অস্বচ্ছল হওয়ায় খুব সহজেই তরুণীরা এগিয়ে আসছে এধরনের কাজে।

দুই.

বছর চারেক ধরে লন্ডন থাকেন তানভীর রহমান (ছদ্ম নাম)।

ভিসা বাড়ানোর মত আর কোনও পথ খোলা পাচ্ছিলেন না। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় দায়-দায়িত্বের চাপে হুট করে দেশেও ফিরতে পারছেন না তিনি।

তার ওপর লন্ডনে আসার সময় কিছুটা ধার-দেনা করতে হয়েছে। সেটিও শোধ করতে হচ্ছে।

আর তাই ভিসা জটিলতা নিয়ে কী করবে তানভীর তা ভেবে না পেয়ে প্রথমে রুমানিয়ান হাউসমেটের সাথে শুরু করলেন প্রেমের অভিনয়। উদ্দেশ্য- রুমানিয়ান মেয়েটিকে পটিয়ে কাগজের বিয়ে এবং ভিসার মেয়াদ টিকিয়ে রাখা।

কিন্তু জটিলতা তৈরি হল। প্রেমের অভিনয় করতে গিয়ে তানভীর খেয়াল করেন রুমানিয়ান মেয়েটি সত্যিই তাকে ভীষণভাবে ভালোবাসে। ওদিকে বাংলাদেশে তার প্রেয়সী অপেক্ষা করে আছেন ছ'বছর হলো। 

দোটানায় পড়ে উপায় না দেখে রুমানিয়ান মেয়েটিকেই বিয়ে করেন তিনি। থাকতে শুরু করেন একই ছাদের নিচে।

তানভীরের কাছে বিয়েটা নিছক লন্ডনে টিকে থাকার জন্যও হলেও রুমানিয়ার মেয়েটি দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে।

অপরদিকে তানভীর এখনও অপেক্ষা করছে কবে পাবে তার পাসপোর্ট আর সময় পাবে বাংলাদেশের প্রেয়সীকে আবার নতুন করে বোঝাতে। 

তিন.

এহসান হোসেন (ছদ্ম নাম), বাড়ি ফিরতে চাইলেও এখন তার আর কোনও উপায় নেই।

লন্ডনে টিকে থাকার জন্য পোল্যান্ডের মেয়েকে বিয়ে করায় বাবা-মা কিছুটা তার উপর ক্ষিপ্ত। এখনও এহসানের বাবা চান, ছেলে বাড়ি ফিরে বিয়ে করুক বাঙালি কোনো মেয়েকে আর হোক সংসারী।

তবে এহসান বলেন, “যখন ভিসা বাড়ানোর সময় ঘনিয়ে আসলো তখন আমার হাতে আর কোনো 'অপশন' ছিল না। স্টুডেন্ট হিসেবে আরও সাড়ে নয় হাজার পাউন্ড টিউশন দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।”

তিনি বলেন, “আর সেই টিউশন ফি দিলেও তাতে ভিসা পাওয়া যেত মাত্র ১৬ মাসের।”

তাই এতগুলো টাকা খরচ করে অল্প দিনের ভিসা নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না এহসান।

কফি শপে কাজ করার সুবাদে পরিচয় পোল্যান্ডের এক মেয়ের সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই তৈরি হয় সখ্যতা আর দিনে দিনে তার রং হতে থাকে গাঢ়। দেশে ফিরে গিয়ে নতুন করে শুরুর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এহসান প্রবাসে থাকার সিদ্ধান্তই বেছে নিলেন।

বিয়ে করলো পোল্যান্ডের মেয়ে আনাকে। প্রথমে চুক্তি বিয়ের চিন্তা মাথায় আসলেও পরে প্রেমিকার জোরাজুরিতে বিয়ে করতে হলো এহসানকে।

তার মতে, বিদেশে থাকার মোহে অনেক তরুণকেই এ ধরনের পথ বেছে নিতে হচ্ছে।

“তবে এতে যেমন আছে সুবিধা তেমনি বইতে হয় অনেক ঝক্কি-ঝামেলাও। আর সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা”, বলেন তিনি।

যদি নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশি অসুবিধা হয় তবে পাঁচ বছর পরে ভিন্ন পথের দিকে হাঁটতে দ্বিধা করবেন না বলেও জানালেন তিনি!

ঘটনা ৪.

তবে ছেলেদের পাশাপাশি এখন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণীও বৃটেনে কাগজের বিয়ে করছেন।   

২৬ বছরের শিক্ষার্থী সুবর্ণা চৌধুরী (ছদ্মনাম) পড়ালেখার শেষ করেছেন বছর দুয়েক হলো। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর ভিসা বাড়ানোর কোন উপায় না দেখে পা বাড়াতে হল চুক্তিবিয়ের পথে।

পর্তুগিজ হাউসমেটকে ছয় হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে রাজি করিয়ে তারপর বিয়ে করলেন।

এর পাশাপাশি কাগুজে স্বামীর হাত খরচ হিসেবে প্রতিবছর তিন হাজার পাউন্ড করে তিন বছর পর্যন্ত খরচ দিতে হবে।

শারীরিক ও স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক না থাকার পরেও ছেলেটিকে রাখতে হয়েছে একই বাসার পাশের কক্ষে যার খরচও দেন সুবর্ণা।

তিনি বলেন, “যেকোন সময় ভিসা তদন্ত দল বাসায় এসে খোঁজ-খবর নেওয়ার অধিকার রাখে। তাই একই বাসায় না থাকলে, বুঝতে বাকি থাকবে না যে এটি সত্যিকারের বিয়ে ছিল না।”

সুবর্ণা অনেকটা ক্ষোভের সুরে বললেন, “বাংলাদেশি ছেলেরা এ ধরনের বিয়ে করলে সামাজিকভাবে কোন হেনস্তার শিকার হয় না। বিপরীতে কোন মেয়ে যদি ভুলে কিংবা বাধ্য হয়ে কাগজের বিয়ে করেন তাকে হাজারও ধরনের কথা শুনতে হয়।”

আর সেইজন্য তিনি লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার আশপাশে না থেকে নতুন শহর ওয়েলস-এ বসবাস করছেন, যেখানে বাঙালিদের আনাগোনা নেই বললেই চলে, জানালেন সুবর্ণা।   

বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান আর শ্রীলংকান তরুণ-তরুণীরাও লন্ডন থাকার জন্য কাগজের বিয়ে করেন।

তবে আসছে দিনে ইউকে ভিসা অ্যান্ড ইমিগ্রেশন এজেন্সি (ইউকেভিআই) এ ধরনের ভূয়া বিয়ে তদারকিতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। সন্দেহের উদ্রেক হলেই মাঝরাতে স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে থাকছে কি না- তা যাচাই করতে অভিযান চালাচ্ছে সংস্থাটি।

এদিকে শুধু বাসা-বাড়িতে হানা দিয়ে ক্ষান্ত হবে না ইউকেভিআই। কাউকে সন্দেহ হলে রাখা হবে নজরদারিতে। আর সেই সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে কিনা, মেডিকেল পরীক্ষা করে দেখার জন্যও হুকুম আসতে পারে অদূর ভবিষ্যতে।

ভিসা নিয়ে কারও বিষয়ে কোনো ধরনের আপত্তি থাকলে ইউকেভিআই সেই ভিসা বাতিল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার