ব্রিটেনে ভূতের খোঁজে এক বাংলাদেশি নারী

ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি বা পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াটা বেশ কষ্টকর হবে। সন্ধ্যা-রাতে এ ভূতের গল্পই ছিলো ছোটবেলার একমাত্র বিনোদন।

শারমিন জান্নাত ভুট্টো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2016, 10:01 AM
Updated : 13 Nov 2016, 10:03 AM

কত যে নির্ঘুম রাত কেটেছে এ ভূতের গল্প শুনে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আর এ কারণে কবরস্থান কিংবা সিমেট্রির আশপাশ দিয়ে হাঁটতেই আমার রক্ত হিম হয়ে যেত। যদিও সময়ের স্রোতে সেই ভয়ে কিছুটা ভাটা পড়েছে।

শৈশবে মনে হত দুনিয়ার সব ভূত শুধু গ্রামের বাড়িতে বাস করে। কারণ আমার জীবনে এ পর্যন্ত যত ধরনের ভূতের গল্প শুনেছি, তার বেশিরভাগ ঘটনা গ্রামের।

দিন গড়ানোর সাথে সাথে আর বিভিন্ন দেশের বই পড়ে জানতে পারলাম- ভূত শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিচরণ করে। কম-বেশি সব দেশে তাদের ব্যাপক আনাগোনা আর তাদের নিয়ে গল্পও বেশ সমাদৃত সর্বজন মহলে। এমন কি প্রবাসের আড্ডায় ভূতের গল্প ও নানা ধরনের প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটিস স্থান পায় অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে।

ভূত,অশরীরী আত্মা আর প্যারানরমাল অ্যাকটিভিটিজ (অস্বাভাবিক কার্যকলাপ) এসবের অস্তিত্ব বিলেতের মাটিতেও পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, মাঝে-মধ্যে আমাদের দেশের কেচ্ছা-কাহিনীকেও হার মানিয়েছে।

একের পর এক কাহিনী বন্ধুদের থেকে শোনার পর আগ্রহের পারদ যখন চরমে, তখন বন্ধুদের সাথে একদিন বেরিয়ে পড়লাম বিলেতি ভূতকে একটু কাছে থেকে জানার এবং দেখার ইচ্ছায়। আর বিলেতে এসে কাছাকাছি ভূতের সাক্ষাত মেলা সেটি ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য দুটোরই কারণ হতে পারে। দেখা যাক, ভূতের খোঁজে আমার কপালে কী জোটে ?

আপাতত গ্রেট ইয়ারমাউথে ঘটে যাওয়া দু-একটি ঘটনার কথা জানানো যাক। আর ভূতের দেখা মিললে সেটা হবে ডাবল বোনাস কিংবা বাড়তি পাওনা। তবে এর জন্য থাকতে হবে অপেক্ষায়।

লন্ডন থেকে ১২৬ মাইল দূরে গ্রেট ইয়ারমাউথ শহর। সমুদ্র তীরবর্তী এ শহরটি বহুকাল ধরে এখানকার অন্যতম প্রধান মৎস বন্দর। আর সামুদ্রিক মাছ হেরিং-এর জন্য এ শহর বেশ জনপ্রিয়। এ শহরে কেউ বেড়াতে এলে ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে যেতে ভুলবেন না যেন!

যা হোক, এতক্ষণ ধরে এ শহরের এতো আলাপ করছিলাম কারণ এখানে নাকি নানা ধরনের অলৌকিক কেচ্ছা আর অশরীরী আত্মা ও ভূতের সন্ধান পাওয়া গেছে।

গ্রেট ইয়ারমাউথের মার্কেট প্লেসে সেন্ট নিকোলাস প্রাইওরি স্কুলের ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনা মোটামুটি এ এলাকার সবার জানা। আমার স্কুল বন্ধু যার আমন্ত্রণে আমার গ্রেট ইয়ারমাউথে যাওয়া, সে আর তার দুই বন্ধু মিলে আমরা গেলাম সেই স্কুলে। আগ্রহ শুধু আরেকটু জানবার, যদিও ঘটনা ঘটেছিল বহু বছর আগে।

উনিশ শতকের প্রথম দিককার কথা। বিজ্ঞানের ছাত্রদের গবেষণার জন্য বাক্সবন্দী ইজিপশিয়ান একটি মমি দান করা হয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে। আর এর কিছুদিন পরে সেই স্কুল থেকে তীব্র পঁচা আর আঁশটে গন্ধ বের হতে থাকে।

প্রথমদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল, হয়তো স্কুলের আনাচে-কানাচে কোথাও ইঁদুর মরে পঁচে আছে। কিন্তু কোথাও যখন কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না, তখন অনেকটা বাধ্য হয়ে সেই মমির বাক্সে হাত দেয়া।

বাক্স খুলতে না খুলতেই বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। অনেকদিনের পুরনো মমি আর বাক্সে আলো-বাতাসের স্বল্পতা থাকায় এমন হয়েছে বলে ধারণা করলো স্কুল কর্তৃপক্ষ। পরে সবার  সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই মমিকে কবর দেয়া হয় পার্শ্ববর্তী সেন্ট নিকোলাস চার্চের নির্ধারিত জায়গায়।

প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী মমি দাফন করা হয় মধ্য রাতে। আর সে প্রথা মেনে স্কুল কর্তৃপক্ষ মমিটিকে স্কুলের পেছনের দরজা দিয়ে চার্চের কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে কবর দেয়। আর পুনরায় সে বাক্সটি স্কুলে নিয়ে আসে।

এর কিছুদিন পর নিকোলাস চার্চের আশপাশে গড়ে ওঠা বসতির মানুষেরা নানা ধরনের বিকট ও অদ্ভুত ধরনের আওয়াজ শুনতে থাকেন। এমনকি মধ্য রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পর্যন্ত। কে বা কারা এ ধরনের শব্দ করছে তা নিয়ে যখন অনুসন্ধান চললো কেউ কিছুই খুঁজে পায় না।

আর এর মাঝে স্কুলেও ঘটলো সেই একই ঘটনা। তীব্র ও বিকট গন্ধ স্কুলের আঙিনায়। তবে এবার আর কারও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে সেই চেনা পঁচা গন্ধের উৎপত্তি কোথা থেকে!

স্কুল কর্তৃপক্ষ আবারো খুললো সেই বাক্স। আর এবার দেখা গেল সে বাক্সে পড়ে আছে মমির একটি দেহাবশেষ।

ধারণা করা হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে  মমিটিকে কবর দেয়ায় ভুলবশত একটি অঙ্গ বাক্সেই পড়েছিল। আর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় তাকে কেউ দেখতে পায়নি তখন। এ ঘটনার পর সাথে সাথে সেই দেহাবশেষটি কবর দেয়া হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এরপর থেকে ওই এলাকার সেই অদ্ভুত 'কড়া নাড়া'র শব্দ আর কেউ কখনও শুনতে পায়নি। তবে এখনও এলাকাবাসীর মন থেকে  ভয় দূর হয়নি, কবে কে এসে কড়া নাড়ে তাদের দরজায় !

গ্রেট ইয়ারমাউথে অলৌকিক ঘটনা পরিদর্শকদের যে দলটি কাজ করে তাদের সংগঠনের নাম 'এসএনপিআই'। প্রাইওরি স্কুলে কিছু ভৌতিক ঘটনার পর তারা ঠিক করে সেখানে রাতভর পর্যবেক্ষণ চালাবে। আর সে কারণে তারা একটি টিম গঠন করে। স্কুলের বিভিন্ন জায়গায় আর রুমে ভিডিও ক্যামেরা এবং সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন করে টিমটি। উদ্দেশ্য- ভূত কিংবা অলৌকিক আত্মার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা।

বলে রাখা ভালো, পর্যবেক্ষক দলটি স্কুল থেকে অনুমতি নিয়ে সন্ধ্যার অনেক পরে সেখানে দলবলে হাজির হয়। পুরো দল যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ ধরে, তখন এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে কেউ একজন তাদের গতিবিধি অনুসরণ করছে।

হঠাৎ একজন সন্ন্যাসীর আত্মাকে কথা বলতে শুনতে পাওয়া যায়। সে নিজের নাম বললো- 'যোসেফ'। যোসেফ জানায়, তার মৃত্যু হয় তারই ঘোড়ার সাথে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনায়। ঘোড়ার গাড়ির চাকার সাথে যোসেফের পা আটকে যায় আর তখন পুরো গাড়িটি তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।

এসএনপিআই পর্যবেক্ষক দল আরেকটি আত্মার সাথে কথা বলতে পারলো যার নাম 'চার্লি'। চার্লি জানায়, প্রাইওরির সন্ন্যাসীরা তার দেখাশোনা করতো আর এর বদলে তাকে স্থানীয় বাজারে তাদের জন্য খাগড়া পুতুল বিক্রি করতে হতো।  

প্রাইওরি স্কুলে রাতের অন্ধকারে যখন আত্মাদের সাথে কথাবার্তা চলছিল, তখন ক্যামেরায় ধরা পড়ে আরেক ঘটনা। ছোট্ট একটি কাঠের টুকরা রুমের টেবিলে এনে কেউ একজন রাখল। আর তার খানিকটা নড়াচড়ার শব্দ ও দৃশ্য রেকর্ড হলো ক্যামেরায়।

তবে যাকে দেখার জন্য এসএনপিআই অপেক্ষা করছিল, সেই ইজিপশিয়ান মমির কোন দেখা মিললো না। তবে পর্যবেক্ষক দল প্রাইওরি স্কুলটিকে ভৌতিক বলে তাদের মত দিয়েছে।

এতো ঘটনা জানার পর, প্রাইওরি স্কুল দেখার লোভ কী আর সামলানো যায় ? কোনভাবেই না! আর তাই তো বেশি দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম স্কুল আর ইজপিশিয়ান মমিকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছিল তা দেখতে।

স্কুলে এখনও নিয়মিত ক্লাস হয়। তবে মিশরিয় মমির ঘটনার পর এখন পর্যন্ত আর বড় কোন ধরনের কিছু সেখানে হয়নি। বাইরে থেকে স্কুলটি দেখা হলেও ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি নিরাপত্তার অজুহাতে। তবে দূর থেকে দেখে পরাণ জুড়ালাম।

এদিকে কথিত আছে, সেন্ট নিকোলাস চার্চ যেখানে ইজিপশিয়ান মমিকে সমাহিত করা হয়েছে সেটি পুরো তিনবার কেউ প্রদক্ষিণ করে এসে 'ব্লাডি কুইন মেরি' বললে নাকি সেই মমির চেহারা দেখা যায় চার্চের জানালা দিয়ে। বলা হয়ে থাকে এ চার্চের ভেতর ও আশপাশে বেশ কিছু অদ্ভুত শব্দ ও আলোর দেখা মিলতো।

নিকোলাস চার্চের উল্টো দিকে বেশ বড়-সড় একটা পাব (পানাশালায় মদের দোকান) ছিল। ভালোই বিক্রি-বাট্টা হতো। কিন্তু সেখানেও অদ্ভুত কাণ্ড ঘটতে লাগলো।

পাবের কিচেনে মাংস ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটতো হরহামেশাই। বিশেষত যখন পাবটি খালি থাকতো। শেফ এ ঘটনা জানানোর পর মালিকপক্ষ অনেকটা বাধ্য হয়ে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়।

সময় গড়ানোর সাথে সাথে বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে, দিনে ভূতের খোঁজে এলাকাবাসী এদিক-ওদিক দৌঁড়ালেও, আলাপ-আলোচনায় বসলেও রাতে কিন্তু কেউ কাজ ছাড়া একা বের হওয়ার সাহস করতো না। পাছে ভূতের খপ্পরে না কেউ পড়ে যায়!

তবে মমিকে কবর দেয়ার পর এখন কিছুটা শান্তি বিরাজ করছে সেখানে। তবুও সাবধানে থাকা। আর অলৌকিক কিছু হতে দেখলে তা যেন পুলিশ ও প্রশাসনকে জানানো হয় সেদিকে সবাইকে পরামর্শ দেয়া হয়। এমনকি চার্চ ও গ্রেভইয়ার্ডে যাতে কেউ সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত না থাকে সে ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আর হয়তো সে কারণে চার্চও ওই সময়ের মধ্যে বন্ধ রাখার বিধিমালা জারি করে চার্চ কর্তৃপক্ষ।

লেখক: সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার

ছবি কৃতজ্ঞতা: পিনাকী দেব

লেখকের অন্যান্য লেখা: