সাইকেলের শহরে একদিন

ঢাকাকে যদি রিক্সার শহর বলা হয়ে থাকে, তবে দুই চাকা বা সাইকেলের শহর বলা যেতে পারে আমস্টারডামকে।

শারমিন জান্নাত ভুট্টো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Jan 2017, 11:27 AM
Updated : 14 Jan 2017, 11:44 AM

নিজ শহর ঢাকায় তিন চাকার বাহনটি ছিলো আমার অনেক পছন্দের। বন্ধুরা মিলে ঘণ্টায় রিক্সা ভাড়া করে ঘোরাঘুরি করা ছিল আমাদের বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম। দেশের বাইরে পড়তে এসে কিছু মিস করি আর না করি, রিক্সা ভীষণ মিস করি।

যাহোক, কথা বলছিলাম সাইকেলের শহর অ্যামস্টারডাম নিয়ে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে সেমিস্টার বিরতিতে যাওয়া হল নেদারল্যান্ডসে। বাল্যকাল আর থিয়েটারের বন্ধু অমিত হৃদয় সেখানে থাকে বলে ঘোরার জন্য প্রথমেই বেছে নিলাম দেশটি। এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো।

লন্ডন থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টার ফ্লাইট অ্যামস্টারডামের। নভেম্বরের ৮ তারিখে নামলাম দেশটির বিমানবন্দরে। তখন কী যে উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষা গ্যাদাকালের বন্ধুকে দীর্ঘ সাত বছর পর দেখার জন্য। ওই মুহুর্তের অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না!

আমার বন্ধুটি অ্যামস্টারডাম শহর থেকেও আরও দুই ঘণ্টা দূরের শহর গ্রোনিনগ্যানে থাকে। আমরা দোতলা ট্রেনে চড়ে সেই শহরে যাচ্ছিলাম। দু'পাশে দেখা মিলছিল সারি সারি উইন্ডমিলের।

ট্রেনের জানালা দিয়ে যতই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলাম, মুগ্ধ হচ্ছিলাম ততই! ট্রেনের গতি বাড়ার সাথে সাথে তেজ ও আলো ছড়াচ্ছিল আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি আর গল্পে।

কথা বলতে বলতে কখন যে আমরা দু'ঘণ্টা পার করেছি তা ঠাওর করতে পারিনি। পিপলস লিটল থিয়েটারে থাকাকালীন আমাদের সময়, বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে একসঙ্গে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা, একসাথে বেড়ে ওঠা, অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব, দেশ, রাজনীতি- সবকিছুই জায়গা করে নিয়েছিল আমাদের আড্ডায়।

যাহোক, গ্রোয়েনগেন পৌঁছে প্রথম যে জিনিসটি চোখে পড়লো, তা হলো সাইকেল পার্কিং-এর জন্য বিশাল জায়গা। সব সময় গাড়ি পার্কিং-এর জন্য বরাদ্দ জায়গা দেখে আসতে এমন অভ্যস্থ ছিলাম যে সেখানে সাইকেলের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম!

বন্ধু অমিত আমার বিস্ময়ভরা চোখ দেখে বেশ কিছু তথ্য দিল সাইকেলের এ শহরটি নিয়ে। নেদারল্যান্ডসের প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ তাদের বাহন হিসেবে সাইকেলকে বেছে নিয়েছে। আর মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ পাবলিক পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। শুনে অবাক না হয়ে পারছিলাম না!

শুধু তাই নয়, সাইকেল চালকদের জন্য রাস্তায় আলাদা লেন ও পথ আর সাইকেল পার্কিংয়ের জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। তবে এখানে সাইকেল চোরের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। তাই যার যার সাইকেলের দায়িত্ব ঠিক তার তার কাঁধেই।

আরেকটি তথ্য অমিত জানালো, পুরো নেদারল্যান্ডসে যে তিনটি শহরে সাইকেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে অমিতের শহর গ্রোনিনগ্যানের অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ সাইকেল ব্যবহার করে।

নেদারল্যান্ডসের অন্যতম আরেকটি শহর জোয়ালাতে প্রায় ৪৬ শতাংশ আর অ্যামস্টারডামে প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষের প্রথম পছন্দ সাইকেল।

আমার মতো ক্ষণিকের পর্যটক কীভাবে সাইকেল চালিয়ে তার মনের আশা পূরণ করবে, তার সুব্যবস্থাও কিন্তু করে রেখেছে 'নেদারল্যান্ডস ন্যাশনাল সাইকেল নেটওয়ার্ক'। এদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় 'বাইসাইকেল ট্যুরিজম'।

নতুন সাইকেল ভাড়া নেওয়া থেকে শুরু করে কোন পথে কীভাবে সাইকেল চালানো যাবে, তার নির্দেশনা এবং সতর্কতা পর্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করা আছে সাইকেল স্মরণিকাগুলোতে।

অমিতের কাছ থেকে মজার আরেকটি তথ্য জানা গেল, দেশটিতে অনেকেই সাইকেল তাড়াহুড়ো করে পার্ক করতে গিয়ে ভুলে যায় নির্দিষ্ট কোন লেনে তা রেখে এসেছিলো। আর এ কারণে অনেককেই সেই দিনের মতো পায়ে হেঁটে নয়তো বা পাবলিক পরিবহনে করে বাসায় ফিরতে হয়।

অমিতের কথার সত্যতা যাচাই হলো তখনই। সে নিজেও তার সাইকেলটি খুঁজে পাচ্ছিল না আমাকে দেখাবে বলে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তিনতলা বিশিষ্ট সাইকেল পার্কিং স্ট্যান্ডটি পর পর তিনবার ঘুরে আরও শ'খানেক সাইকেলের ভীড়ে খুঁজে বের করা হলো বন্ধুর সাইকেলটি।

সেদিন অবশ্য আমরা সাইকেলে করে বাড়ি যাইনি। যেহেতু আমার হাতে ও কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ ছিলো আর তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষুধা, সেহেতু কোনমতে বাসে চড়ে বাড়ি পৌঁছালাম। সাইকেলে চড়তে না পারার বেদনা ও আবদার ঘণ্টাখানেক বাদেই পূরণ করলো আমার বন্ধুটি।

সাইকেল একটি থাকায় অমিতের সাইকেলের পেছনে বসে আমরা ঘুরে দেখলাম গ্রোনিনগ্যান শহরটি। সাথে এও জানলাম যে শহরটি ২০০২ সালে নেদারল্যান্ডসের অন্যতম সাইকেলের শহর হিসেবে পেয়েছে বিজয়ীর খেতাব।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার

ই-মেইল:  Sharminbhutto@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!