মাঝে মধ্যে নিজেই নিজেকে বলি ‘অঘটনঘটনপটীয়সী’। তবে স্বীকার করতে হচ্ছে, আজ যে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরবো, তা ঘটেছে নেহায়েত আমার বোকামির দরুণ।
সে যাকগে, ফিরে আসি মূল ঘটনায়। গেলো বছর ঠিক এই ফেব্রুয়ারি মাসে গেলাম রোমান্সের শহর প্যারিসে। উদ্দেশ্য- ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একদিনের জন্য শহরটি ঘুরে আসা। যেমন চিন্তা, দেরি না করে ঠিক তেমনই পথচলা।
ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে লন্ডন থেকে বাসে রওনা দিলাম প্যারিসের উদ্দেশ্যে। সাথে কিছু ঘণ্টার জন্য সহযাত্রী হিসেবে পেলাম 'গ্যাদাকালে'র বন্ধু কাজী আরেফিন শশীকে। দু’জনে মিলে প্যারিস ঘুরে আমি ফিরবো লন্ডনের দিকে আর শশী যাবে ইতালিতে, এমন পরিকল্পনা নিয়েই শুরু ‘ট্রিপ টু প্যারিস’। এবারে এক একটি ঘটনা শুনে হয় কেউ হাসবে নয় তো কাঁদবে।
ঘটনা- এক
বাসের সময় রাত ১০টা লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে। অবশ্যই ৩০ মিনিট আগে পৌঁছাতে হবে চেকইনের জন্য আর কাউন্টার বন্ধ হয়ে যাবে বাস ছাড়ার দশ মিনিট আগেই।
আমরা গিয়ে যখন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালাম, তখন ঘড়ির কাঁটাতে বাজে ৯টা ৫০ মিনিট। গিয়ে দেখি কাউন্টার মোটামুটি ফাঁকা আর যিনি সেখানে বসা তিনি অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
লোকটি খুব গম্ভীর গলায় বললো, সে কোনওভাবেই কিছু করতে পারবে না। আর তখন আমরা কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে এমন একটা চেহারা বানিয়ে ‘প্লিজ’ ‘প্লিজ’ বলতে লাগলাম যে সে আমাদের আবদার রাখলো। পরে সে জানালো, বাস নাকি একটু দেরিতে যাবে বলে অনেক আগেই একটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো আর আমরা সেটা শুনতে পাইনি।
আমরা যখন নিজেদের অভিনয়গুণে মুগ্ধ, তখনই কাউন্টারের ভদ্রলোকের সেই মজা করার ঢঙ দেখে বিমোহিত হলাম আরও বেশি। আর এভাবেই কাঠ-কয়লা পুড়িয়ে বিজয়িনীর হাসি মুখে নিয়ে চড়ে বসলাম বাসে। শুধু মনে মনে ভাবছি, ঠিকমতো যেন শেষ করতে পারি এই ভ্রমণ।
ঘটনা-দুই
বাসে চড়ে যাচ্ছি প্যারিসে আর সেই সাথে শত রকমের উত্তেজনা। এই প্রথম আমি কোন দেশে যাচ্ছি, তাও কয়েক ঘণ্টার জন্য। শহরটি দেখবো আর সেই সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’-এর প্রশিক্ষক, জাদরেল অভিনেতা আমাদের প্রাণপ্রিয় হীরা ভাইয়ের সাথে। যিনি বহু বছর যাবত সেখানে আছেন।
কারও কি ‘দীপু নাম্বার টু’ চলচ্চিত্রটির কথা মনে আছে? সেখানে যে ছেলেটি পানির ট্যাংকে উঠতে গিয়ে সমানে কাঁপছিলো আর পরে সেখানে থেকে একা নামতে না পেরে শেষে নান্টুকে তারেকের ঘাড়ে চেপে নামতে হয়েছিলো, সিনেমার সেই 'নান্টু'ই আমাদের হীরা ভাই।
আশপাশের যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে বাস আবারও হনহন করে চলা শুরু করলো। আর তখনই টের পেলাম, আমরা ফেলে এসেছি আমাদের স্টপেজ 'চার্লস দ্য গল' বাস টার্মিনাল! কী করবো বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইলাম পরবর্তী স্টপেজের জন্য।
ইংরেজি জানা বাসের আরেক যাত্রী জানালো আরও ৪৫ মিনিট পর আরেকটি স্টপেজ আসবে। আর সেখানে যদি আমরা নেমে যাই তবে হয়তো কিছুটা সময় বাঁচাতে পারবো।
প্যারিসের প্রথম ধাক্কা কারও উচ্চারণ বুঝতে না পারা। দিনের শুরুতে আমাদের যা গেলো, তাতে মোটামুটি ভয়েই আছি পরবর্তী ১৬ ঘণ্টা কেমন যাবে তা নিয়ে। যাই হোক কোনমতে পা রাখলাম প্যারিস শহরে। আইফেল টাওয়ার মিশন শুরু হবে একটু পরেই।
ঘটনা-তিন
সারাদিনের জন্য ট্রেনের টিকেট কেটে আমরা পৌঁছলাম আইফেল টাওয়ার এলাকায়। দুই বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, আগে উদরপূর্তি করবো, তারপর ফূর্তি। যেই কথা সেই কাজ।
সে সুন্দর করে মাথা নাড়লো আর তারপরে আমরা আপেল ও কমলার জুস নিলাম কাপে করে। যা দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের হাতল ছাড়া চায়ের কাপের মত। খাওয়া-দাওয়ার সাথে সাথে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করে যেই বিল দিতে যাবো , ওম্নি চোখ কপালে!
নাস্তার বিল ২০ ইউরো আসার কথা থাকলেও জুস বাবদ আমাদের আরও দিতে হয়েছে ১০ ইউরো। আরেক ধরা খেলাম অতি আতিথেয়তায়। তবে একটা বিষয় বুঝলাম, প্যারিসবাসী সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ে।
তাই তাদের সাথে আপনি ‘হ্যাঁ’ মেলানোর আগে বারবার জিজ্ঞেস করবেন তারা আসলেই আপনার কথাটা বুঝেছে কি না!
ভোজন পর্ব শেষে রেস্তোরাঁ থেকে বের হতেই পড়লাম তুমুল বৃষ্টিতে। আর আমাদের সাথে ছিল না কোন ছাতা। রাস্তা থেকে একটা কিনে নেব, সেই উপায়ও ছিলো না। তাই কিছুটা সময় এক ছাউনিতে অপেক্ষা করে রওনা দিলাম টাওয়ার দর্শনে।
'চ্যাম্প ডি মারস' এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার। বিশাল সেই টাওয়ার দেখে আমাদের দুই বন্ধুরই চোখ ছানাবড়া। শুধুই অনুভব করলাম বিশালতা আর মুগ্ধতা। টাওয়ার দেখে একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল, গুস্তাফ আইফেল যা বানিয়ে রেখে গেছেন, মোটামুটি এর উপর নির্ভর করেই ফ্রান্সের পর্যটন খাত বিশেষত অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে সবসময়।
ঘটনা-চার
টাওয়ার দেখেই শুধু মন ভরাবো আর প্যারিস শহর দেখবো না, তাই কি হয়? আর তাই তো পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত বাস ‘হপ অন হপ অফ’-এ উঠলাম। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় বসলাম ছাউনিবিহীন দোতলায়, উদ্দেশ্য শুধু চোখ আর ক্যামেরাবন্দি করা।
যাই হোক, পুরো শহরের এক ঝলক বাইরে থেকে দেখতে হলেও কমপক্ষে দুই দিন লাগবে। ট্যুরিস্ট বাসে ঘণ্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে যখন এক স্টেশনে নামলাম, আমাদের সেই হীরা ভাইয়ের সাথে দেখা করতে তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি। কারণ আমরা যে রেলস্টেশনে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেটির ইংরেজিতে উচ্চারণ করলে যা হয় তা কোনভাবেই ফ্রেঞ্চ উচ্চারণের সাথে মেলে না। একবারেই ভিন্ন কিছু হয়।
অগত্যা হীরা ভাইকে বর্ণনা দিতে থাকলাম আমাদের আশপাশে কী কী স্থাপনা আছে তার। আর এটা শুনেই তিনি বুঝতে পারলেন, আমরা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।
১৫-২০ মিনিটের মধ্যে যখন আমাদের হীরা ভাই এসে পৌঁছলেন, তখন আমাদের আনন্দ দেখার মতো ছিলো। ভিনদেশে গিয়ে স্বদেশির দেখা পাওয়া চরম এক আনন্দ আর সৌভাগ্যের। খুব একটা দেরি না করে হীরা ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন প্যারিসের বাঙালি পাড়ায়। উদ্দেশ্য- আমাদের ভুনা খিচুড়ি খাওয়াবেন।
যেই কথা সেই কাজ। ভুরিভোজের পর বিকেলে আমরা তিনজন কাটালাম ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনে। দেরি হয়ে যাওয়াতে সেবারের মতো আমরা আর মোনালিসার দেখা পাইনি। তবে থিয়েটারের তিন বন্ধু মিলে যেভাবে চুটিয়ে আড্ডা দিলাম, তাতে হয়তো দূর থেকে মোনালিসাও আক্ষেপ করছিলো আমাদের কথাবার্তায় সেরকম ঠাঁই না পাওয়াতে।
ঘটনা-পাঁচ
প্যারিসের সবগুলো ঘটনার মধ্যে এই শেষ ঘটনাটিই আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো। কীভাবে- তা শুনলে আপনারও ঘুম আসতে দেরি হবে। যেই আমরা হীরা ভাইকে বিদায় দিলাম, ঠিক করলাম টাওয়ারের উপরে উঠবো।
দীর্ঘ এক ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করে টিকেট কেটে উঠলাম স্বপ্নের টাওয়ারে। মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরছিলো, কীভাবে টাওয়ার দেখে বাস তাড়াতাড়ি টার্মিনালে যাবো। রাত সাড়ে ৮টায় টাওয়ারে উঠে ঘুরলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর সাড়ে ৯টার দিকে শশীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছিলাম একা বাস টার্মিনালের দিকে।
১১টায় বাস, তাই হাতে দেড় ঘণ্টা রেখেই রওনা দিলাম টাওয়ার এলাকা থেকে। সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট লাগবে গন্তব্যে পৌঁছতে। তাই অনেকটা নিশ্চিন্ত মনেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো, দ্বিতীয় ট্রেনটিতে ওঠার আগে স্টেশনের কাউকে একটু জিজ্ঞেস করে নেওয়াটা ভালো। হাতে তখনও সময় বাকি আছে এক ঘণ্টা। যেই ভাবা সেই কাজ।
স্টেশন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করার পর সে জানালো আমি ভুল জায়গায় আছি। এখন অন্য ট্রেনে করে যেতে হবে আরেক জায়গায় আর সেখান থেকে 'চালর্স দ্য গল' যাওয়ার ট্রেন নিতে হবে। শুনেই আমার হাত-পা কাঁপা শুরু করলো।
'চালর্স দ্য গল' এয়ারপোর্টে নেমে খোঁজা শুরু করলাম সেখানকার বাস টার্মিনাল। হাস্যকর বিষয় হলো, নির্দিষ্ট জায়গায় নেমেও মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে বাস টার্মিনাল খুঁজে পেতে আমার সময় খোয়াতে হয়েছে পাক্কা ২০ মিনিট। আর ততক্ষণে ঘড়ির কাটা ১১টা ১০ মিনিট ছুঁই ছুঁই।
লন্ডন যাওয়ার বাস আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছে ১০ মিনিট আগেই। এরপর সেই রাতের মতো আর কোন বাস নেই, আর আমাকে ফিরতে হবে পরের রাত অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার বাসে। মানে পুরো একদিন অপেক্ষা করতে হবে বাসের জন্য।
উপায়ন্তর না দেখে ফোনে রোববারের বাসের টিকেট বরাদ্দ করে রাখলাম। পরে অবশ্য উদ্ধারকর্তা হিসেবে লন্ডন থেকে সিরাজ ভাই পরের দিন সকাল ৯টার প্লেনের টিকেট করে দিলেন।
এদিকে সারাদিন সব টাকা ঘোরাঘুরি আর স্যুভেনিয়র কিনে শেষ করে ফেলায় পুরো রাত না খেয়ে এয়ারপোর্টে বসে আর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে সময় পার করলাম। আর সকালে সর্বপ্রথম যাত্রী হিসেবে প্লেনে ওঠার দুই মিনিটের মধ্যেই নাক ডেকে ঘুমালাম।
আর সেই এক ঘুমে লন্ডনের গ্যাটওয়েক এয়ারপোর্টে এসে নামলাম সকাল সাড়ে ১১টায়।
সারারাত না ঘুমিয়ে আমার চেহারার যা অবস্থা ছিলো, তা দেখে ইমিগ্রেশন অফিসারও কিছু জিজ্ঞেস না করে বললো, 'ইউ হ্যাড আ হেকটিক হলিডে, আই গেজ...'
আমি জীবনেও ভুলবো না ঘটনাবহুল প্যারিসের সেই 'মহান হলি ডে'!
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
ই-মেইল: Sharminbhutto@yahoo.com
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |