মধ্যপ্রাচ্যে মাদকের ‘রাজধানী’ হয়ে উঠছে সৌদি আরব

মাদকের সবচেয়ে বড় চালান ৪ কোটি ৭০ লাখ অ্যামফেটামিন বড়ি জব্দ করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2022, 05:08 AM
Updated : 4 Sept 2022, 05:08 AM

ইফতারের ঠিক আগে নিজের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে ভয়াবহ এক পরিণতির মধ্য দিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন পরিবারের চার সদস্য।

গত এপ্রিলের এমন ঘটনায় সচকিত হয়ে উঠেছিল সৌদি গণমাধ্যম। স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে পুলিশ বলেছিল, ওই ব্যক্তি ‘শাবু’ বা ‘মেথাফেটামিন’ নামে একটি মাদকের ঘোরে ছিলেন।

দেশটিতে মাদকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া নিয়ে ইদানিং সৌদি গণমাধ্যমগুলোতে শঙ্কার খবর আসছে।

একজন কলামনিস্ট দেশটিতে মাদকের চালান সম্পর্কে বলেছেন, “এটা আমাদের বিরুদ্ধে খোলা যুদ্ধের শামিল, যে কোনো যুদ্ধের চেয়ে যা বেশি বিপজ্জনক।”

বুধবার সৌদি কর্তৃপক্ষ রাজধানী রিয়াদের একটি গুদামে ময়দার ভেতর থেকে ৪ কোটি ৭০ লাখ অ্যামফেটামিন বড়ি জব্দ করার পর জানিয়েছে, এটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাদকের চালান।

রেকর্ড পরিমাণ এই মাদক জব্দের বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের চালান এভাবে বাড়তে থাকায় মধ্যপ্রাচ্যের মাদকের রাজধানী হয়ে উঠেছে সৌদি আরব।

মাদকের চাহিদা বাড়তে থাকায় সিরিয়া ও লেবাননের চোরাকারবারীদের প্রাথমিক গন্তব্য হয়ে উঠছে দেশটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মাদকের সবচেয়ে বড় এবং আঞ্চলিকভাবে সবচেয়ে লাভজনক গন্তব্যগুলোর একটি হয়ে উঠছে সৌদি আরব এবং দিন দিন এটা আরও বাড়ছে।

সৌদি আরবের জেনারেল ডিরেক্টরেট অব নারকোটিকস কন্ট্রোল এর মতে, অভিযানে জব্দ করা মাদকের পরিমাণ বিচারে বুধবারের চালানটি ছিল এককভাবে সবচেয়ে বড়।

অবশ্য জব্দ করা মাদকের নাম কী এবং কোত্থেকে এসেছে সে বিষয়ে কিছু জানায়নি কর্তৃপক্ষ।

এর আগে ইউনাইটেড ন্যাশন্স অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি)বলেছে, “মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে অ্যামফেটামিন জব্দ করার যেসব খবর আসছে তাতে ক্যাপ্টাগন লোগো যুক্ত বড়ি সম্পর্কেই বেশি ইঙ্গিত মিলেছে।”

‘ক্যাপ্টাগন’ মূলত উত্তেজক ফেনিথিলাইনযুক্ত একটি ওষুধি পণ্যের ব্র্যান্ড।

ইউরোপিয়ান মনিটরিং সেন্টার ফর ড্রাগস অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডিকশন বলছে- এখন আর এর বৈধ উৎপাদন নেই,তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রায়ই ‘ক্যাপ্টাগন’ নাম যুক্ত নকল ওষুধ জব্দ করা হচ্ছে।

সিএনএন জানায়, সৌদি আরব ও এর আশেপাশের অঞ্চলে মাদক উদ্ধার অভিযানে ‘ক্যাপ্টাগন’ বড়ি জব্দ করার পরিমাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে।

এ সপ্তাহের শুরুতে, মার্কিন কোস্ট গার্ড ওমান উপসাগরে একটি মাছ ধরার নৌকা থেকে ৩২০ কেজি অ্যামফেটামিন ট্যাবলেট এবং প্রায় ৩ হাজার কেজি গাঁজা জব্দ করেছে। যার দাম কয়েক মিলিয়ন ডলার।

ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো ভান্ডা ফেলবাব-ব্রাউন বলছেন, সৌদি আরবে প্রায় ১৫ বছর আগে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ মাদকের ব্যবহার গত পাঁচ বছরে আরও বেড়েছে।

এর ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সম্ভবত এটি গাঁজার মতোই হয়ে উঠেছে।”

ক্যাপ্টাগন ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ফেলবাব-ব্রাউন বলেন, “কারণ বানের তোড়ের মতো এই মাদকের চালান আসছে এবং বেশিরভাগই সিরিয়া থেকে।

দেশটিতে এর উৎপাদন হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “বাশার আল আসাদ প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া রাসায়নিক কারখানাগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন হয়।”

তার অনুসারীরা এর সরবরাহ করেন বলেও উল্লেখ করেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এই ফেলো।

এ বিষয়ে সৌদি আরবের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন এর বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সিএনএন।

ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডিকশন জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি ‘ক্যাপ্টাগন’ বড়ি ১০ থেকে ২৫ ডলারে বিক্রি হয়। সম্প্রতি সৌদি কর্তৃপক্ষ যা জব্দ করেছে সেটি যদি একই মাদক হয়, তবে এর খুচরা মূল্য দাঁড়াবে ১১০ কোটি ডলার।

ক্যাপ্টাগনের বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ করা ওয়াশিংটন ডিসির নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিশ্লেষক ক্যারোলিন রোজ বলেন, “ক্যাপ্টাগনে অ্যামফেটামিনের মতো বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

“এটি মানসিক চাপ কমানোর কৌশল হিসেব ব্যবহার করা হয়, যা ক্ষুধা দমনে সহায়ক এবং ‘তাৎক্ষণিক উদ্দীপনা’ তৈরি করে মানসিক চাপ মুক্ত রাখতে পারে বলে দাবি করেন ব্যবহারকারীরা।

“বলা হয়, কাজের মান বাড়াতে সৌদি আরবের মতো ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোর বিদেশি শ্রমিকরাও ক্যাপ্টাগনের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এর খোঁজ করেন।”

সিএনএন লিখেছে, সৌদি আরবে গাঁজা ও ‘খাট’ (তামাকের মতো এক ধরনের পাতা) সাধারণ মাদক হলেও অ্যামফেটামিন সৌদি যুবকদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়।

ক্রাইম, ল অ্যান্ড সোশাল চেঞ্জ জার্নালে ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় একজন মাদক ব্যবহারকারীর উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, “ক্যাপ্টাগন ছোট। আমি ও আমার স্কুলের সহপাঠীরা গাঁজার চেয়ে এটি বেশি পছন্দ করি।

“এটি গাঁজার মতো নয়, আমরা ট্যাবলেট হিসেবে কিনতে পারি… একবার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ২৫ রিয়াল পেয়ে গেলে আমরা একটি ট্যাবলেট কিনে সেবন করতে পারি।”

ক্যারোলিন রোজ বলেন, “ধনী ভোক্তাদের বাজারে এই মাদকের একটি আলাদা আবেদন রয়েছে। সামাজিক সংস্কার সত্ত্বেও বিনোদনমূলক কার্যক্রমে এর ব্যবহার হয়…

“বেকারত্বের পাশাপাশি অবসরে করার কিছু না থাকায় একঘেয়েমি কাটাতে তাদের বেগ পেতে হয়। কেউ কেউ কড়া মাদক আফিম এবং কোকেনের মতো ক্যাপ্টাগনকে ট্যাবু মনে করেন না।”

মাদকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে সরকার লাইসেন্স নিয়ে পুরো সৌদি আরব জুড়ে মাদকসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠছে।

কাউইম নামে এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী খালিদ আল মাশারি বলেন, গত দুই বছরে প্রায় চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। সরকার মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে যে গুরুত্ব দিচ্ছে এটি তারই প্রমাণ।

তবে সৌদি আরবে মাদকসক্তির সমস্যা যে বাড়ছে এটা সেই বিষয়টিকেও সামনে নিয়ে এসেছে।

সিএনএনকে খালিদ আল মাশারি বলেন, “দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের চাহিদা বাড়ছে। এখন চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার পরিবর্তে অন্তত মানুষের কাছে একটি বিকল্প আছে।”

তবে পুনর্বাসন কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও ক্যাপ্টাগন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সতর্ক বার্তা বা প্রচারণা কম বলে মনে করেন ক্যারোলিন রোজ।

ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো ফেলবাব-ব্রাউন বলছেন, মাদকের বিষয়ে কঠোর নীতির ওপর জোর দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য।

“বিশ্বের বড় একটি অংশই যখন কঠোর এবং বস্তুত অকার্যকর বা সরাসরি বিপরীতমুখী নীতিগুলো থেকে সরে এসেছে; সেখানে মধ্যপ্রাচ্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এই নীতি দ্বিগুণ কঠোর হয়েছে।

“মাদকগ্রহণকারীদের জেলে দেওয়া মূলত অকার্যকর এবং এর বিপরীতমুখী প্রভাব রয়েছে।”