ভূমিকম্প: তুরস্কে এত ভবন ধসে পড়ল কেন?

ভূমিকম্পের তীব্রতা কি এতই বেশি ছিল যে তার দাপটে নতুন ভবনও টিকতে পারেনি? নাকি ভবন নির্মাণে ঘাপলা ছিল?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Feb 2023, 07:21 AM
Updated : 10 Feb 2023, 07:21 AM

তুরস্কে ভূমিকম্পে এমনকী নতুন বানানো ভবনও ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেশটিতে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।

ভূমিকম্পের তীব্রতা কি এতই বেশি ছিল যে তার দাপটে নতুন ভবনও টিকতে পারেনি? নাকি ভবন নির্মাণে ঘাপলা ছিল?

এসব প্রশ্নের জবাব পেতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া তিনটি নতুন ভবনের খোঁজখবর নিয়েছে বিবিসি।

৭ দশমিক ৮ এবং পরে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার দুটি বড় ভূমিকম্প তুরস্কের দক্ষিণ ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, প্রায় সব ধরনের ভবনকেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যে নতুন বানানো অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকও রয়েছে, যেগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় ভবন নিরাপত্তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

আধুনিক নির্মাণ কৌশলের অর্থ হচ্ছে, এমনভাবে ভবন বানানো যেন তা এই ধরনের ভূমিকম্পে টিকে থাকতে পারে। তাছাড়া তুরস্কে আগের ভূমিকম্পজনিত বিপর্যয়ের পর যেসব বিধিবিধান হয়েছে, সেগুলো করাও হয়েছিল নির্মিতব্য ভবনগুলো যেন ভূমিকম্পে সুরক্ষা দেওয়ার মতো সক্ষম হয়, তা নিশ্চিত করা।

ধসে পড়া যে তিনটি নতুন ভবন নিয়ে বিবিসি খোঁজখবর করেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফুটেজে তার একটিতে ভূমিকম্পের সময় কাছাকাছি থাকা মানুষজনকে আতঙ্কে চিৎকার করতে এবং আশ্রয়ের জন্য দৌড়াতে দেখা গেছে। 

মালাতিয়ার ওই ভবনটির নিচের অর্ধেক অংশ গুড়িয়ে যায়, উপরের বাকি অংশটুকু ধুলা আর জঞ্জালের ওপর কাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই অ্যাপার্টমেন্টটি গত বছরই বানানো হয়েছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হওয়া স্ক্রিনশটে একটি বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে, যেখানে বলা হয়েছে- ভবনটি ‘ভূমিকম্প সংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক বিধিবিধান অনুসরণ করে বানানো হয়েছে’।

যেসব সরঞ্জাম ও কারিগরদের ব্যবহার করা হয়েছে, সবই ছিল ‘গুণেমানে প্রথম শ্রেণির’, দাবি করা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে।

আসল বিজ্ঞাপনটি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে একই কোম্পানির একই ধরনের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরতে থাকা স্ক্রিনশট ও ভিডিওর মিল পাওয়া যাচ্ছে।

সম্প্রতি নির্মিত হওয়ার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এটি অনুসরণ করেছে ২০১৮ সালের সর্বশেষ বিধিবিধান, যেখানে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে ভবন নির্মাণে উচ্চ-মানের কংক্রিট এবং তাকে আরও শক্তিশালী করতে ইস্পাতের বার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

কলাম আর বিমগুলোকে এমন দূরত্বে বানাতে হবে, যেন সেগুলো ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করতে পারে।

কিন্তু এই ভবন এসব বিধিবিধান সত্যিই অনুসরণ করেছে কিনা, বিবিসি তা যাচাই করতে পারেনি।

একাধিক ছবিতে বন্দরনগরী ইস্কেন্দেরানে সম্প্রতি নির্মিত আরেকটি ভবনের সিংহভাগ ধসে পড়ার বিষয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে।

১৬ তলা ভবনটির এক পাশ ও পেছনের অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, সামনের অংশ কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। 

বিবিসি ধসে পড়া এই ভবনের সঙ্গে নির্মাণ কোম্পানি তাদের প্রচারে ব্যবহার করা একটি ছবি মিলিয়ে দেখেছে, যেখানে বলা হচ্ছে ভবনটি ২০১৯ সালে নির্মিত।

অর্থাৎ, এটিও সর্বশেষ বিধিবিধান ও মান অনুযায়ী হওয়ার কথা। বিবিসি ভবনটির নির্মাণ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু তাদের দিক থেকে কোনো ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি। 

বিবিসির যাচাই করে দেখা আরেকটি ছবিতে আনতাকিয়ায় একটি ধসে পড়া ৯ তলা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ধ্বংসস্তূপ দেখা যাচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেবল প্রকল্প গুসলু বাসে’র নাম সম্বলিত একটি অংশ।

হাউজিং কমপ্লেক্সটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও মিলেছে, যেখান থেকে সেটি যে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নির্মিত হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ওই ভিডিওতে সের-আল কনস্ট্রাকশনের মালিক সেরভেত অ্যাটলাসকে বলতে শোনা যায়, “গুসলু বাসে সিটি প্রকল্পটি এর স্থান ও নির্মাণ কৌশলের দিকে থেকে বিশেষভাবে অনন্য।”

ধসে পড়া ভবন প্রসঙ্গে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে অ্যাটলাস বিবিসিকে বলেন, “হতাইয়ে (তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ, আনতাকিয়া যার রাজধানী) আমি কয়েকশ ভবন বানিয়েছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর মধ্যে দুটি ধসে পড়েছে।”

ভূমিকম্পের তীব্রতা এত ভয়াবহ ছিল যে শহরের প্রায় কোনো ভবনই আর অক্ষত নেই, বলেছেন তিনি। 

“কিছু গণমাধ্যম দৃষ্টিভঙ্গি বদলে প্রতিবেদনের নামে যে বলির ছাগল খুঁজছে, দুঃখের সঙ্গে তারও সাক্ষী হচ্ছি আমরা,” বলেছেন তিনি।

ক্ষতিগ্রস্ত ওই অঞ্চলে এত এত ভবন ধসে পড়েছে যে তুরস্কের অনেকেই এখন ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত বিধিবিধানের ধরন ও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। 

যদিও এবারের ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে বেশ শক্তিশালীই ছিল, তারপরও সঠিকভাবে নির্মিত ভবন এই ধাক্কা সামলে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জরুরি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডেভিড আলেক্সান্ডার বলেছেন, “ভূমিকম্পের তীব্রতা মারাত্মক ছিল, কিন্তু এত মারাত্মক ছিল না যে তা ভালোভাবে বানানো ভবনকে ফেলে দেবে। বেশিরভাগ এলাকাতেই কম্পন ছিল সর্বোচ্চ মাত্রার (৭ দশমিক ৮) চেয়ে কম। যে হাজার হাজার ভবন ধসে পড়েছে, তার প্রায় সবই যে ভূমিকম্পজনিত নির্মাণ বিধি মেনে তৈরি করা হয়নি তা আমরা বলতেই পারি।”

ভবন নির্মাণবিধি কার্যকরে ব্যর্থতা

তুরস্কে আগে হওয়া দুর্যোগগুলোর পর নির্মাণ বিধিমালায় বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। এসব দুর্যোগের মধ্যে ১৯৯৯ সালে উত্তর-পশ্চিমের ইজমিত শহরের আশপাশে হওয়া ভূমিকম্পও আছে, যেটি ১৭ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

কিন্তু সেসব বিধিমালা বা আইন, এমনকী ২০১৮ সালে হওয়া সর্বশেষ বিধানও দেশটির কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাক কার্যকর করতে পারেনি।

“একে তো আগের ভবনগুলো সংস্কার হয়নি, তার মধ্যে নতুনগুলোতেও ভবন নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ হয়েছে সামান্য,” বলেছেন আলেক্সান্ডার।

বিবিসির এক প্রতিবেদক তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আদানার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, সেখানে ধসে পড়া ভবনগুলোর মধ্যে একটি এমন ভবনও ছিল, যেটি ২৫ বছর আগে আরেকটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঠিকমতো সংস্কার করা হয়নি।

জাপানেও বড় বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস আছে, কিন্তু সেখানে লাখ লাখ মানুষ জনবহুল এলাকাগুলোর সুউচ্চ ভবনগুলোতে বসবাস করছে। ভবন নির্মাণ বিধিমালা কী করে দুর্যোগেও মানুষকে নিরাপদে রাখতে পারে এতেই তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

ভবনের ব্যবহার এবং এলাকার ধরন বিবেচনায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে নির্মাণের সময় নানান ধরনের কৌশল নেওয়া হয়। কখনো কেবল ভবনকে শক্তিশালী করতে উপকরণে জোর দেওয়া হয়, কখনো ড্যাম্পার ব্যবহার করা হয়, কখনো এমনভাবে ভবন বানানো হয় যেন ভবনের উপরের অংশে মাটির কম্পনের ধাক্কা খুবই কম লাগে। 

ভবন নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ কেন দুর্বল হল?

তুরস্কে সরকার সময়ে সময়ে নির্মাণ বিধিমালার শর্ত না মেনে বানানো স্থাপনাগুলোকে জরিমানার বদৌলতে বৈধতা দিয়ে এসেছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে এই ছাড় দিয়ে আসছে তারা।

এই ধরনের ছাড় যে বড় কোনো ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে, সমালোচকরা তা নিয়ে অনেক দিন ধরে সতর্কও করে আসছিলেন। 

ইউনিয়ন অব চেম্বারস অব তার্কিশ ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস চেম্বার অব সিটি প্ল্যানার্সের ইস্তাম্বুলের প্রধান পেলিন পিনার গিরিতলিওগ্লুর তথ্য মতে, দক্ষিণ তুরস্কের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার প্রায় ৭৫ হাজার ভবন এই ছাড় পেয়েছে।

সোমবারের ভূমিকম্পের কয়েকদন আগে তুর্কি গণমাধ্যম জানিয়েছিল, নতুন একটি খসড়া আইন পার্লামেন্টের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, তাতে সাম্প্রতিক সময়ে বিধিমালা বহির্ভূতভাবে নির্মিত স্থাপনাগুলোর জন্যও ছাড়ের সুযোগ রাখা হচ্ছিল।

পৃথিবীর ভূ-স্তরের বাইরের অংশটি (ভূ-পৃষ্ঠ) অনেকগুলো টুকরো দিয়ে গঠিত, যেগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। পৃথিবী সৃষ্টির পর প্রথমদিকে এই প্লেটগুলো একসঙ্গে ছিল, পরে লাখ লাখ বছর ধরে ক্রমে সরতে সরতে এখন বিভিন্ন মহাদেশের আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে।

সঞ্চরণশীল এই প্লেটগুলোর সীমানা ‘সিস্টেম অব ফল্টস’বা চ্যুতি হিসেবে পরিচিত। ফল্ট হচ্ছে দুই প্রস্থ প্লেটের মধ্যখানের ফাটল বা চ্যুতি। টেকটোনিক প্লেটের এই চ্যুতিগুলোতে চাপ তৈরি হলে সেগুলো হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে ভূমিকম্পের কারণ হয়। 

তুরস্কের ভূভাগের মধ্য দিয়ে এমনই দুটি ফল্ট লাইন চলে গেছে যার নাম ‘নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’ ও ‘ইস্ট আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’। এই দুই ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত হওয়ায় তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল।

এমন ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত কোনো দেশে ভবন নির্মাণে জরিমানার বিনিময়ে ছাড় দেওয়া ‘অপরাধ’, চলতি বছরের শুরুর দিকেই এমনটা বলেছিলেন তুর্কি ভূতত্ত্ববিদ সেলার সেনগর।

২০২০ সালে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইজমিরে আরেকটি প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পর শহরটির ৬ লাখ ৭২ হাজার ভবন এ ধরনের ছাড়ের সুবিধা পেয়েছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল।

সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ভবন নির্মাণ বিধিমালার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তুরস্কের পরিবেশ ও নগরায়ন মন্ত্রণালয় বলেছে, “আমাদের প্রশাসনের বানানো কোনো ভবনই ধসে পড়েনি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে।”

আরও খবর:

Also Read: ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃত ২১ হাজার ছাড়াল

Also Read: বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার পথে ত্রাণের প্রথম বহর

Also Read: ভূমিকম্প: দুইদিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ফিরলেন, ফিরল না পরিবার