ইসরায়েলিদের হামলায় ধ্বংসস্তূপ হাওয়ারা

পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছেন, তারা এক ‘নৃশংস ও পাশবিক’ হামলার শিকার হয়েছেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2023, 06:53 PM
Updated : 28 Feb 2023, 06:53 PM

পশ্চিম তীরের হাওয়ারার স্থানে স্থানে ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন। ছোট্ট শহরটির ঘরবাড়িগুলো এখন ভষ্মস্তূপ। পুড়ে যাওয়া গাড়িগুলো উল্টে আছে রাস্তায়। সবখানেই ধূসর ছাইয়ের পুরু আস্তরণ। বাতাস ভারী হয়ে আছে উৎকট পোড়া গন্ধে।

শহরটির বাসিন্দাদের কাছ থেকে বিবিসির সাংবাদিক যখন ঘটনার বর্ণনা শুনছিলেন, তখনও বাতাসে থাকা পোড়া ছাইয়ের তেতো গন্ধ পাচ্ছিলেন তিনি।

হাওয়ারার ফিলিস্তিনিরা বিবিসিকে জানাচ্ছে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের একটি উন্মত্ত গোষ্ঠী কীভাবে ঘণ্টাব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদের শহরতলীতে। হামলাকারীরা শুরুতে লোহার পাইপ আর পাথর নিয়ে আক্রমণ করে। এরপর তারা বাড়িঘর, গাড়ি, গাছপালায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

ফিলিস্তিনের এই শহরতলীটি দীর্ঘ কয়েক বছরের মধ্যে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সবচেয়ে বড় হামলার শিকার হয় রোববার রাতে।

এক ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীর গুলিতে দুই ইসরায়েলি যুবক খুন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর চালানো হয় এই হামলা। এতে এক ফিলিস্তিনি নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

নিজের পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আবদেল নাসের আল-জুনাইদি বিবিসিকে বলেন, “বসতি স্থাপনকারীরা আমাদের বাড়িতে হামলা করে, তারা জানালাগুলো ভেঙে ফেলে এবং আমার ভাগ্নের গাড়ি ও ট্রাকগুলো জ্বালিয়ে দেয়। তারা আমার গাড়ির শোরুম ভেঙে ফেলার এবং সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।”

দ্রুত সন্তানদের নিয়ে ছাদে উঠে গিয়ে প্রাণটি বাঁচাতে পারেন নাসের। তিনি বলেন, “ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা হামলাকারী বসতি স্থাপনকারীদের সাহায্য করেছে এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। বসতি স্থাপনকারীরা এবং সেনারা - দুই পক্ষই আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করেছে। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।”

“যা ঘটেছে তা হল একটি নৃশংস ও পাশবিক হামলা,” বলেন এই ফিলিস্তিনি।

ইসরায়েলের রুট ৬০ মহাসড়কের, যেটা ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে উত্তর-দক্ষিণমুখী মূল মহাসড়ক, পাশেই হাওয়ারার অবস্থান। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনের এই অংশটি পুরোপুরি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে এবং এর নিরাপত্তার সমস্ত দায়দায়িত্বও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হাতে।

বিবিসি লিখেছে, যে কেউ এখন হাওয়ারা শহরের এমাথা থেকে ওমাথা হেঁটে গেলে বুঝতে পারবে কী বীভৎস হামলা চালানো হয়েছিল এবং তাতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কতখানি ভয়াবহ।

একটির পর একটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, দোকানপাটে আগুন দেওয়া হয়েছে, রাস্তায় কয়েকশ গাড়ির ভষ্মাবশেষ, অনেক গাড়ি আগুনে বিস্ফোরিত হয়ে ছিটকে গেছে বিভিন্ন স্থানে।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, রোববার রাতে জাতারা এলাকায় হামলা চলার সময় ৩৭ বছরের সামেহ আকতাশের পেটে গুলি করা হয়। এই ব্যক্তি মারা যান, আহত হন কয়েকশ ফিলিস্তিনি।

হামলা থেমে যাওয়ার পর একটি পরিবারকে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মীরা উদ্ধার করে। পরিবারটি বাড়িতে আটকা পড়েছিল, কারণ হামলাকারী বসতি স্থাপনকারীরা বাড়ির দরজায়ও টায়ার জ্বালিয়ে বের হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। মহাসড়ক থেকে কয়েকশ মিটার দূরে আরেকটি বড় পরিবার পালিয়ে বেঁচে যায়, কারণ তাদের বাড়িতেও হামলা চালায় ইসরায়েলিরা।

পুড়ে যাওয়া বাড়ির বসার ঘরে দাঁড়িয়ে ওদে আল-দোমাদি বিবিসিকে বলেন, “আমার স্ত্রী, আমার ভাইয়ের স্ত্রী এবং আমাদের সন্তানেরা হামলার সময় বাসায় ছিল। আতঙ্কে তারা চিৎকার করছিল, বাচ্চারা কাঁদছিল। তারা সাহায্য চাচ্ছিল। কিন্তু আমরা পৌঁছাতে পারিনি।”

আল-দোমাদি তখন কাজে ছিলেন, যখন তিনি শুনতে পান যে ইসরায়েলিরা একটি ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি দ্রুত কর্মস্থল থেকে রওনা দেন।

এই ফিলিস্তিনি বলেন, “আমার হিসাবে মুখোশ পরা ৩০ জনের একটি দল পিস্তল নিয়ে হামলা করে। তারা বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। আমরা যখন ঘরে ঢুকি তারা আমাদের দেখতে পায় এবং আমাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারে। আমার ভাইয়ের কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে।

“অন্তত শিশুদের রক্ষার জন্য হলেও সাহায্য চেয়েছি সেনাদের কাছে এবং আবেদন করেছি যাতে তারা হামলাকারীদের বাধা দেয়। কিন্তু সেনারা উল্টো আমার দিকে গুলি চালায় এবং আমাকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলে ঘরে থাকতে।”

আল-দোমানি অবশ্য শেষ পর্যন্ত তার পরিবারকে নিয়ে সরে যেতে পেরেছেন। বাড়ির আরেকটি কোণে আশ্রয় নিয়ে হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান তারা।

তিনি বলেন, “সবচেয়ে খারাপ ঘটনা যেটি ঘটেছে, তা হল বাচ্চারা যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, আতঙ্ক ও অসহায়ত্বের অনুভূতি। তারা আমার কোলে ভয়ে কাঁপছিলো, আমাকে বারবার বলছিল তাদের পাশে থাকতে, তাদের ছেড়ে না যেতে।”

এই সহিংসতা মোকাবেলায় নিজেদের অবস্থান সঠিক ছিল বলে দাবি করছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তবে একজন সামরিক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো অনেক দিন থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের পরিচালিত সহিংসতা নিয়ে কর্তৃপক্ষ বরাবরই উদাসীন। বিশেষ করে হাওয়ারা ও নাবলুসের আশপাশের বসতি স্থাপনকারীরা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর বর্বরতা চালিয়ে এলেও কখনোই বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়নি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, সহিংসতার মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে বসতি স্থাপনকারীদের সমর্থনকারী উগ্র কট্টরপন্থিরা ইসরায়েলের নতুন সরকারের অংশ হওয়ার পর।

ইসরায়েলের পুলিশ বরাবরই বলে যে তারা এসব সহিংসতার তদন্ত করছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে বেশিরভাগ ঘটনাতেই অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হয় এবং মামলা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ফিলিস্তিনের শহরগুলোতে সম্প্রতি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর একের পর এক তল্লাশি ও আটক এবং সামরিক অভিযানে ফিলিস্তিনিদের হত্যা এবং অন্যদিকে ইসরায়েলিদের লক্ষ্য করে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র হামলা বেড়ে চলায় এমন আশঙ্কা বাড়ছে যে ওই অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা বাড়ছে।

বিবিসি লিখেছে, এমন একটি অনুভূতি টের পাওয়া যাচ্ছে যে সব পক্ষই একটি সীমায় পৌঁছে যাচ্ছে যেখান থেকে সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে এমন এক পরিস্থিতিতে যখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় তাদের সীমিত ক্ষমতা ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না।