তিনি যখন গুহায় প্রবেশ করেন, তখন তার বয়স ছিল ৪৮; গুহার ভেতরে দুটি জন্মদিন একাই উদযাপন করেন।
Published : 16 Apr 2023, 03:42 PM
আধুনিক যুগে মানুষের সহচার্যের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে গভীর গুহায় নির্জনে দিনের পর দিন একা থাকা সম্ভব?
বেশিরভাগ মানুষের কাছে এটা কল্পনাতীত মনে হতে পারে, যদিও স্প্যানিশ এক পর্বতারোহী সম্প্রতি সেটিই করে দেখিয়েছেন। কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ নয়, টানা ৫০০ দিন তিনি কাটিয়েছেন ৭০ মিটার (২৩০ ফুট) গভীর এক গুহায়।
সিএনএন জানিয়েছে, ৫০ বছর বয়সী অ্যাথলেট বিয়েত্রিজ ফ্লামিনি শুক্রবার গ্রানাডার বাইরের একটি গুহা থেকে বের হয়ে আসেন। তবে তার আগে সেই গুহায় টানা ১ বছর ৪ মাস ১৫ দিন কাটে তার। ওই সময়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগও ছিল ন্যূনতম।
গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ স্পেনের বসন্তের আলোতে এসে এই পর্বতারোহী সাংবাদিকদের বলেন, সময়টা যেন উড়ে গেছে। আর তার বাইরে আসার ইচ্ছাও ছিল না।
“ওরা যখন আমাকে নিতে এল, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু একটা হয়েছে। আমি বললাম, ‘এর মধ্যেই (সময় হয়ে গেছে), নিশ্চয় না’। আমি এখনও আমার বই-ই শেষ করতে পারিনি।”
যে গুহায় ফ্লামিনি একা ৫০০ দিন কাটানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, তার বাইরে একটি সহায়তা টিম ছিল।
তারা জানান, গুহার ভেতরে মানুষের মন এবং ২৪ ঘণ্টার চক্রে সেখানে তার শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত কী কী পরিবর্তন ঘটে সেটা জানতেই বিজ্ঞানিদের পরীক্ষামূলক চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে ফ্লামিনি দীর্ঘ সময় গুহায় কাটানোর একটি ‘বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছেন’।
তিনি যখন গুহায় প্রবেশ করেন, তখন তার বয়স ছিল ৪৮ বছর; দুটি জন্মদিন একা একাই গুহার ভেতরে পালন করেছেন তিনি।
২০২১ সালের ২০ নভেম্বর তার সেই চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। সময়টা ইউক্রেইন যুদ্ধ ও ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর আগে।
ফ্লামিনির সহায়তা টিম বলছে, আট দিনের জন্য বাইরে এসেছিলেন তিনি। তবে একটি তাঁবুতে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। গুহার ভেতরে থেকে সহায়তা টিমকে অডিও, ভিডিও পাঠাতে সেখানে একটি রাউটার মেরামতের কাজ চলে সেই কয়েক দিন।
দীর্ঘদিনের সেই অভিযান শেষে শুক্রবার যখন তিনি গুহা থেকে বের হয়ে আসেন, চারপাশে ক্যামেরা তাকে ঘিরে ধরে। সহায়তা টিমের সদস্যরা স্বাগত জানিয়ে আলিঙ্গন করেন।
গুহার ভেতরে একা থাকলেও গুরুতর কোনো সমস্যা কিংবা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সহায়তা টিমকে সিগন্যাল পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল। ফ্লামিনি যখন বাইরে বের হয়ে এলেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কখনও তিনি ‘প্যানিক বাটন’ চাপা কিংবা বাইরে বের হয়ে আসার কথা ভেবেছিলেন কিনা।
জবাবে তিনি বলেন, “কখনোই না। আসলে আমি বের হতেই চাইনি।”
সময় কেটেছে কীভাবে
গুহায় বাস শুরুর আগে পরিকল্পনা মাফিক সকল বন্দোবস্তোই করা হয়েছিল। ফ্লামিনি সেখানে ব্যায়াম, ছবি আঁকা আর পশমি টুপি বুননের কাজ করে সময় পার করেছেন।
কীভাবে তিনি সময় পার করছেন, সেসবের ভিডিও ধারণ করতে ‘গো প্রো’ প্রযুক্তি কোম্পানির দুটি ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ৬০টি বই আর ১ হাজার লিটার পানি নিয়েছিলেন।
ফ্লামিনি বলেন, ঘড়ির কাঁটা ধরে বা সময় হিসাব করে তিনি চ্যালেঞ্জ শুরু করেন। কিন্তু ৬৫তম দিনে গিয়ে সময়ের হিসাব করা বাদ দিয়ে দেন। আর সময়ের প্রতি নিজের খেয়ালও হারিয়ে ফেলেন।
তার ভাষ্য, “কিছু কঠিন মুহূর্ত ছিল, যেমন- গুহায় মাছির আক্রমণ…যা করছেন সেটি যদি আপনার স্বপ্নই হয়, আর আপনি তা উপলব্ধি করেন, তাহলে কেনই বা কান্নাকাটি করতে যাবেন?”
তিনি জানান, নিজেকে সংহত রাখার ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছেন। ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া এবং নীরবতা উপভোগ করেছেন। অ্যাভোকাডো ও সতেজ ডিমের প্রতি উন্মুখ ছিলেন, যেগুলো তার সহায়তা টিম আগেই পাঠিয়েছিল।
গুহার জীবন থেকে বের হয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে ফ্লামিনি জানান, সহায়তা টিমের সদস্যরা খাবার সরবরাহের কাজটি করত এবং আবর্জনাও নিয়ে যেত। তার সঙ্গে সাক্ষাতের মত দূরত্বে না এসেই সেগুলো আনা-নেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা হত।
“খুব জোরে জোরে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলিনি। তবে নিজে নিজে কথা বলেছি এবং নিজের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই চলেছি।… সেখানে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। যদি ভয় পান, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু নিজেকে আতঙ্কিত হতে দেবেন না।”
এই নারী জানান, তার দলকে বলা হয়েছিল, কোনো অবস্থাতেই তারা যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ না করে। এমনকি তার পরিবারের কেউ মারা গেলেও যেন তা না জানায়।
একদন মনোবিজ্ঞানী, গবেষক, গুহা বিশেষজ্ঞ এবং শারীরিক প্রশিক্ষকরা ফ্লামিনিকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তারা দেখছিলেন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক বিচ্যুতি কীভাবে সময়, মস্তিষ্ক আর ঘুমকে প্রভাবিত করে। খুঁটিনাটি ওই বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখছিলেন তারা।
এর আগে দীর্ঘসময় ভূগর্ভে থাকার রেকর্ডের স্বীকৃতি হিসেবে চিলি ও বলিভিয়ার ৩৩ জন খনিশ্রমিক গিনেস বুব রেকর্ডে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে তারা খনির ৬৮৮ মিটার (২২৫৭ ফুট) গভীরে আটকা পড়েছিলেন। সেসময় তাদের ৬৯ দিন কাটে ভূগর্ভেই।
গুহার ভেতরে স্বেচ্ছায় দীর্ঘ সময় পার করার আলাদা রেকর্ড কিংবা ২০১০ সালের খনি দুর্ঘটনার পর যে রেকর্ড হয়েছে, সেটি অ্যাথলেট ফ্লামিনি ভাঙতে পেরেছেন কিনা, গিনেস কর্তৃপক্ষের এক কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে সিএনএনকে নিশ্চিত করতে পারেনি।