উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনা: উদ্ধার অভিযান শেষ, কারণ অনুসন্ধানে মনোনিবেশ

এ দুর্ঘটনা অন্তত ২৭৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

রয়টার্স
Published : 4 June 2023, 04:53 PM
Updated : 4 June 2023, 04:53 PM

ভারতে দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে ভয়াবহতম ট্রেন দুর্ঘটনার পর ঘনটাস্থলে উদ্ধার কাজ রোববার আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়েছে।

এ দুর্ঘটনা অন্তত ২৭৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। যদিও শনিবার নিহতের সংখ্যা ২৮৮ বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে উড়িষ্যার চিফ সেক্রেটারি প্রদীপ জৈন জানান, কয়েকটি মৃতদেহ দুইবার গণনা করা হয়েছিল।

তবে প্রায় ১২শ মানুষ আহত হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছে।”

এদিকে, আহতদের মধ্যে প্রায় ৯০০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার। ২৬০ জনের চিকিৎসা এখনো চলছে। একজন রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।

রাষ্ট্র পরিচালিত ইন্ডিয়ান রেলওয়েস জানায়, প্রতিদিন তারা গড়ে এক কোটি ৩০ লাখ যাত্রী পরিবহন করে।

তারা শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটা ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার জন্য রেলের পুরাতন অবকাঠামোকে দায়ী করে বলেছে, তারা অগোছালো নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত চলছে বলেও জানায় রেল কর্তৃপক্ষ।

ভারতের রেলওয়ে বোর্ড এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-সিবিআই এর কাছে হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছে বলে জানান রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শনিবার দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন, ধ্বংসাবশেষ পর্যবেক্ষণ করেন এবং কয়েকজন আহতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

সেখানে তিনি এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের ‘অবশ্যই কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে’ বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটের দিকে উড়িষ্যার বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছে এই দুর্ঘটনা হয়, যা কলকাতা থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে।

দুর্ঘটনায় তিন ট্রেন

·         করমণ্ডল এক্সপ্রেস: দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে পশ্চিমবঙ্গের শালিমার রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা করে ট্রেনটি দক্ষিণের শহর চেন্নাইয়ের দিকে যাচ্ছিল।

·         হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস: বেঙ্গালুরুর যশবন্তপুর স্টেশন থেকে হাওড়ার দিকে যাচ্ছিল।

·         মালগাড়ি: বাহানগা বাজার স্টেশনে দাঁড়িয়েছিল।

সংঘর্ষ কীভাবে হয়েছে এবং প্রথম কোন ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন বিবরণ রয়েছে। তবে ভারতীয় রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা বলেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেসই প্রথমে লাইনচ্যুত হয়েছিল।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, বাহানগা বাজার স্টেশনে ট্রেনের চারটি লাইন রয়েছে। এর মধ্যে এক ও চার নম্বর লাইনে মালগাড়ি দাঁড় করানো ছিল। যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো মাঝের দুই ও তিন নম্বর লাইন দিয়ে দুই দিকে যাতায়াত করছিল।

“এখন তদন্তের বিষয় হল, করমণ্ডল এক্সপ্রেস কেন লাইনচ্যুত হল এবং মালবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দিল। লাইনচ্যুত ট্রেনের বগিগুলো যাত্রীবাহী হাওড়া সুপারফাস্টের পেছনের দুটি বগিতে গিয়ে পড়ে এবং সেটিকেও লাইনচ্যুত করে ফেলে।”

উড়িষ্যা সরকার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের মোট ১৭টি বগি লাইনচ্যুত এবং মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়রাও বলছেন, সংঘর্ষ হয়েছে তিনটি ট্রেনের।

দুইটি যাত্রীবাহী ট্রেনের চালকই আহত হয়েছেন।

রেলওয়ে বোর্ডের সদস্য জয়া ভর্মা সিনহা বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এখন কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের উপর মনযোগ দেয়া হয়েছে। যাকে ‘ইন্টারলকিং সিস্টেম’ বলা হয়, যা একটি ট্রেনকে একটি খালি রেললাইনের দিকে যেতে নির্দেশ করে, যেখানে দুটি রেললাইন মিলিত হয়েছে।

‘‘সিস্টেমটি ত্রুটিপূর্ণ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এবং সেটির করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে লুপ ট্র্যাকে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত ছিল না।’’ কবে রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু হবে?

ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন, দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার ট্রেনের বগি এবং ছিঁড়ে যাওয়া বৈদ্যুতিক তার সরিয়ে নিচ্ছেন। বিচলিত চোখে সেদিকে তাকিলে আছেন ওই তিন ট্রেনে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা। গত প্রায় তিন দিন ধরে দুর্ঘটনাস্থলে এই দৃশ্যই দেখা গেছে।

টুইটারে রেলমন্ত্রী জানান, এক হাজারের বেশি মানুষ উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন।

‘‘আমাদের লক্ষ্য বুধবার সকালের মধ্যে রেল যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ করা। রেললাইন মেরামতের কাজও করাতে হবে।”

পরিচয় সনাক্তের জন্য একটি বাণিজ্য কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের মৃতদেহ রাখা হয়েছে। তাদের শতাধিক স্বজনরা অপেক্ষা করছেন। অনেকে কাঁদছেন এবং প্রিয় মানুষেদের ছবি ও পরিচয়পত্র হাতে তাদের খুঁজছেন।

৪৯ বছরের কাঞ্চন চৌধুরি তার স্বামীকে খুঁজছেন। তার গ্রামের পাঁচ জন ওইদিন ট্রেনে উঠেছিলেন। চারজন আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একমাত্র কাঞ্চনের স্বামীই মারা গেছেন।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তিনি ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় আছেন। তার হাতে তার ও তার স্বামীর পরিচয়পত্র।

ভারত সরকার থেকে শনিবার নিহত প্রতিজনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লাখ রুপি, গুরুতর আহতদের দুই লাখ রুপি এবং বাকি সামান্য আহতদের ৫০ হাজার রুপি করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।