কয়েক মুহূর্তেই নাটকীয় মোড় পাকিস্তানের রাজনীতিতে

দু'দিন আগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তারের পর নজিরবিহীন এক আদেশে সেই গ্রেপ্তারকেই অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2023, 04:25 PM
Updated : 11 May 2023, 04:25 PM

মাত্র কয়েক মুহূর্তেই সবকিছু উল্টে পাল্টে নাটকীয় মোড় নিয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতি, যার মূল ভূমিকায় আছে সুপ্রিম কোর্ট।

দু'দিন আগেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তারের পর নজিরবিহীন এক আদেশে সেই গ্রেপ্তারকেই অবৈধ ঘোষণা করা হল।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের এমন রায় ইমরান খানের জন্য যেমন স্বস্তির, তেমনি তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর জন্য এ এক বড় ধরনের আইনি জয়।

বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পরই ইমরান খানের জামান পার্কের বাড়িতে পিটিআই কর্মীরা আনন্দে মিষ্টি বিলি করেছে। সত্যেরই যে সবসময় জয় হয় তা নিয়ে কথা বলাবলি করছে তারা।

ইমরান খানের মুক্তির খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথও। এক লাইনের টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, অবশেষে বোধের জয় হয়েছে।

কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সবাই যে খুশি তা নয়, অনেকে এ রায় নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ইমরানের ক্ষেত্রে যা করা হল, তেমন ন্যায়বিচার পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজ (পিএমএল-এন) প্রধান নওয়াজ শরিফ এবং আমাদের অন্যান্য আরও মানুষের ক্ষেত্রে করা হল না কেন?

পিএমএল-এন নেতাদের ক্ষেত্রে ইমরান খানের মতো একইরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন আসিফ।

ইমরানকে সুপ্রিম কোর্টে নেওয়া হয় একজন বন্দির মতো। আর সেখান থেকে তিনি মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন একজন অতিথি হয়ে। আদালত তাকে সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টে নেওয়ার সময় ইমরানের সঙ্গে ১০ জনকে সঙ্গে যেতেও দেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়েছে। তার ব্যাপারে আদালতের এই দ্বিমুখী নীতি কেন- তা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন খাজা আসিফ।

ওদিকে, পিটিআই এর এক নেতা ইমরান ইসমাইল সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ‘ব্যতিক্রমী কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এমন নজির আছে। এর আগে রাজনীতিবিদ সাইফুর রেহমানকে এনএবি’র গেপ্তার থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল।

তাছাড়া, শরিফ কিংবা জারদারি পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে ইমরান খানের গ্রেপ্তারের ঘটনার কোনও মিল নেই বলেও উল্লেখ করেন ইসমাইল। তিনি বলেন, শরিফ, জারদারিদের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরেই তদন্ত চলছে।

অন্যদিকে, এক ভিডিও বার্তায় পিটিআই সিনেটর আজম স্বাতী বলেছেন, আইনের চোখে সবাইকে সমানভাবে বিচার করা হলেই কেবল একটি দেশ সফলতা অর্জন করতে পারে। একটি দেশ আইন অনুযায়ী চললে কেউই আইনের উর্ধ্বে থাকতে পারবে না।

তবে সরকারের মন্ত্রীদের কেউ আবার ইমরান খানের সঙ্গে আদালতের সখ্য আছে বলে কটাক্ষ করেছেন। ইমরানকে গ্রেপ্তার ঘিরে যে সহিংসতা চলেছে তাতে আহত পুলিশ সদস্যরা যদি ন্যায়বিচার না পান, পক্ষান্তরে ওই ব্যক্তি যিনি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন, তিনি ছাড় পেলে দেশ কেবলই জ্বলবে বলে ভাষ্য তাদের।

আবার পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর জন্যও আদালতের এই রায় এক ধাক্কা। পাকিস্তানের সরকার সাধারণত প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সমর্থন খোঁজে। সেনাবাহিনী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটি শাসন করেছে।

দেশটিতে তিনবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইমরানের অভিযোগের নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এক বিরল বিবৃতি ইস্যু করার পরই ইমরান খান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তিনি ছাড় পাওয়ায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতই আরও বাড়ার পট প্রস্তত হল।

সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার ইমরান খানকে এক ঘণ্টার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে হাজির করার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ আসে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পিটিআই এর করা আবেদনের শুনানি চলার সময়।

এরপর একঘন্টার কিছু বেশি সময়ের মধ্যে ইমরান সুপ্রিম কোর্টে হাজির হলে শুনানির পরপরই অপ্রত্যাশিত আদেশে তার গ্রেপ্তারের পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত।

গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাই কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় ইমরানকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো-এনএবি। এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে এ আবেদনের শুনানি চলাকালে ইমরানকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা দেশের বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অসম্মানের বলে প্রধান বিচারপতি উমর আতা বন্দিয়াল মন্তব্য করার পর ইমরানকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয় ন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটি ব্যুরোকে (এনএবি)।

এনএবি’র গ্রেপ্তারের ধরণ নিয়ে বন্দিয়াল প্রশ্ন তুলে বলেন, আদালত চত্বর থেকে কীভাবে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যায়? যদি কোনও ব্যক্তি আদালতে আত্মসমর্পণ করে থাকে, তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করার অর্থ কী?’

তিনি আরও বলেন, এনএবি “আদালত অবমাননা করেছে। গ্রেপ্তারের আগে তাদের আদালতের রেজিস্ট্রারের অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল। আদালতের কর্মীরাও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।”

পরে ইমরানের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের প্রতি অবিচল আস্থা প্রমাণ করেছে আদালত।

সুপ্রিম কোর্টের লিখিত আদেশে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যেভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তা ‘অকার্যকর এবং বেআইনি’। আদালতের ‘পবিত্রতা এবং নিরাপত্তা’ লঙ্ঘন ছাড়াও এভাবে গ্রেপ্তার করে পিটিআই চেয়ারম্যানের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল তার আদেশে আরও বলেছেন, শুক্রবার ফের ইসলামাবাদ হাই কোর্টে হাজির হবেন ইমরান খান। পুলিশ লাইন্সের অতিথিশালায় একজন অতিথি হিসাবেই তিনি থাকবেন। তাকে সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বভার থাকবে সরকারের ওপর।

গত বুধবার ইমরানকে ইসলামাবাদের পুলিশ লাইনসে স্থাপন করা একটি অস্থায়ী আদালতে তোলা হয়েছিল। সেখানে এনএবি ইমরানের ১৪ দিনের জন্য রিমান্ডে চেয়েছিল। পরে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

রিমান্ডে পাঠানোর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ইমরান ছাড়া পেলেন, যা এ যাবতকালের সবচেয়ে দ্রুত ছাড় পাওয়ার ঘটনা। যদিও ইমরান খানকে ছাড় দিলেও তাকে এখনও বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। কখন দেওয়া হবে তাও এখনও স্পষ্ট নয়।

তবে ইমরানকে গ্রেপ্তার ঘিরে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আদালতের রায়ের পর তা আপাতত নিভেছে। বৃহস্পতিবার মাঝে মাঝে দু’একটা বিক্ষোভ ছাড়া রাস্তাঘাট অনেকটাই ছিল শান্ত। তবে পিটিআই এখনও সতর্ক রয়েছে। শুক্রবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে যাবে বলে জানিয়েছে তারা।

ওদিকে, সুপ্রিম কোর্টের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া রায় নিয়ে এখন চলছে নানা পর্যালোচনা। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার এখন কী করবে? সেনাবাহিনীর ভূমিকাই বা কী হবে? উঠছে এমন নানা প্রশ্ন।

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, “আমরা তাকে আবার গ্রেপ্তার করব।” পাকিস্তানের দুনিয়া টিভি-কে তিনি বলেন, “যদি তিনি (ইমরান) আগামীকাল (শুক্রবার) হাই কোর্টে জামিন পান। আমরা সেটি বাতিল হওয়ার অপেক্ষায় থাকব এবং তাকে আবার গ্রেপ্তার করব।”

ওদিকে, পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইমরান খানকে বিরোধীদের সঙ্গে সংলাপ শুরুর তাগাদা দিয়েছেন। বলেছেন, রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে ইমরান পছন্দ না করলেও আলোচনা শুরু করাটাই তার জন্য ভাল পদক্ষেপ হবে এবং এতে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে।