রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান

৭০ বছর ধরে যুক্তরাজ্য শাসন করে আসছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Sept 2022, 05:48 PM
Updated : 8 Sept 2022, 05:48 PM

সত্তর বছর ধরে যুক্তরাজ্য শাসন করে আসা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আর নেই।

স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে ৯৬ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার বিকালে তার মৃত্যু হয় বলে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে জানানো হয়েছে।

এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে দ্বিতীয় এলিজাবেথ অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটল। রানির বড় ছেলে যুবরাজ চার্লসকে নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন ক্ষয়িষ্ণু, সমা্জ যখন বদলাচ্ছে, তখন রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজপরিবারের আসন অটুট রেখেছিলেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ, হয়েছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র।

তাই তার মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে গোটা যুক্তরাজ্যে। শোক জানিয়েছে কমনওয়েলভুক্ত দেশগুলোসহ অন্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতারাও।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।

রাজা ষষ্ঠ জর্জের মেয়ে হিসেবে ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়া এলিজাবেথের রাজত্বই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দীর্ঘতম।

শাসনকালে ১৪ জন প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তরাজ্যে সরকার গঠন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ জন প্রেসিডেন্টের আসা-যাওয়া।

Also Read: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসান

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বাস্থ্যের অবস্থা গত কিছুদিন ধরেই ভালো যাচ্ছিল না। বিশেষ করে জীবনসঙ্গী প্রিন্স ফিলিপ গত বছর মারা যাওয়ার পর দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি।

কয়েক মাস আগেই রানির সিংহাসনে আরোহনের ৭০ বছর উদযাপন করা হয়েছিল। এরপর তিনি গ্রীষ্মকালীন বিশ্রামে ছিলেন এবং গত জুলাই মাস থেকে স্কটল্যান্ডের বারমোরাল প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই বৃহস্পতিবার মৃত্যু ঘটেছে।

প্রায় একবছর ধরেই রানির চলাফেরায় সমস্যা হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে।

অসুস্থতার কারণে গত শরৎ থেকে তিনি বহু অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি। রানির পক্ষ থেকে তার ছেলে প্রিন্স চার্লস ওইসব দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।

রানি গত ১২ মাসে বিভিন্ন স্মরণ দিবস, বার্ষিক কমনওয়েলথ সার্ভিস এবং পার্লামেন্টের স্টেট ওপেনিংয়ের মতো এমন অনেক অনুষ্ঠানেই অংশ নিতে পারেননি।

এর মধ্যে গত মঙ্গলবার লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেতে স্কটল্যান্ডের বালমোরালে রানির কাছে গিয়েছিলেন। এটি ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্র রীতির ব্যতিক্রম।

সাধারণত রানি লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে থাকেন। সেখানেই নতুন প্রধানমন্ত্রীদের অভিষেক হয়। কিন্তু এবার সেরকম হয়নি।

রানির মৃ্ত্যুতে শোক প্রকাশ করে ট্রাস বলেছেন, “তিনি ছিলেন আধুনিক ব্রিটেনের ভিত্তি।” বিবিসি জানায়, বৃহস্পতিবার রানির অসুস্থতার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যান তার সন্তান-সন্ততিরা।

বাকিংহাম প্যালেসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘সকালে বেশকিছু পরীক্ষার পর রানির চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তাকে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।”

রানির স্বাস্থ্য ভালো না যাওয়ায় বুধবার একটি ভার্চুয়াল বৈঠকও পিছিয়ে দেওয়া হয়। তারপরই রানির স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগের ওই খবর আসে।

প্রাসাদ থেকে রানির স্বাস্থ্য নিয়ে বিবৃতি আসাটা উদ্বেগের বলে তখনই মন্তব্য করেছিলেন রাজকীয় লেখক রবার্ট হার্ডম্যান। বিবিসি-কে তিনি বলেছিলেন, প্রাসাদ থেকে সাধারণত রানির স্বাস্থ্য নিয়ে এমন বুলেটিন দেওয়া হয় না, যদি না সেটি গুরুতর হয়।

এর মধ্যেই বালমোরালে একে একে উপস্থিত হন চার্লস, ক্যামিলাসহ রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এর কয়েকঘণ্টা পরই রানির মৃত্যুর খবর আসে সংবাদ মাধ্যমে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্ম ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে, এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি উইন্ডসর হিসেবে। তার বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং মা এলিজাবেথ বাউয়েস-লিয়ন। রাজা ষষ্ঠ জর্জের দুই সন্তানের মধ্যে এলিজাবেথ ছিলেন বড়।

১৯৪৭ সালে প্রিন্স ফিলিপকে বিয়ে করেন এলিজাবেথ। তার স্বামী ছিলেন গ্রিসের এক রাজপরিবারের সন্তান। তবে ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মাউন্টব্যাটেনরা ছিলেন ফিলিপের মায়ের দিককার আত্মীয়।

তাদের সেই বিয়ে নিয়ে যুক্তরাজ্যের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, দ্বিতীয় যুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটেনে ধূসর দিনগুলোতে ওই বিয়ে ছিল ‘রঙয়ের ঝলকানি’।

রাজা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর ১৯৫৩ সালের ২ জুন ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষেক হয় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের। তখন তার বয়স ২৬ বছর। ওই অনুষ্ঠান সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়।

এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সবার বড় প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লসের জন্ম ১৯৪৮ সালে। অন্য তিন সন্তান হলেন প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স অ্যান্ডু ও প্রিন্স এডওয়ার্ড।

রানির মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে রাজা ঘোষণা করা হয় ৭৩ বছর বয়সী প্রিন্স চালর্সকে। যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে তিনিই হচ্ছেন সবচেয়ে বর্ষীয়ান রাজা। তাকে রাজা তৃতীয় চার্লস নামে ডাকা হবে বলে বিবিসি জানিয়েছে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যে রাজদণ্ড ধরে ছিলেন, সেই ভূমিকায় অধিষ্ঠিত হওয়া যে চ্যালেঞ্জের সেটি চার্লস ভালো করেই জানেন।

মায়ের মৃত্যুর এই ক্ষণকে নিজের এবং রাজপরিবারের সবার জন্য ‘সবচেয়ে হৃদয়বিদারক’ বলে বর্ণনা করেছেন চার্লস।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “অতিমূল্যবান, একাধিপতী এবং অত্যন্ত প্রিয় একজন মায়ের এই চলে যাওয়ায় আমরা শোকাহত। আমি জানি, গোটা দেশ, রাজপরিবার, কমনওয়েলথ এবং বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ তাকে হারানোর দুঃখ গভীরভাবে অনুভব করবে।”

বাকিংহাম প্রাসাদ জানিয়েছে, চার্লস এবং তার স্ত্রী ক্যামিলা আপাতত বালমোরাল প্রাসাদেই থাকবেন। তারা শুক্রবার লন্ডনে ফিরে যাবেন।

হাজার বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অনেক রাজা-রানির মধ্যে দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তব্যনিষ্ঠা ও জনগণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে নিজেকে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।

ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান লিখেছে, নিয়মের অধীনে সিংহাসন পেলেও দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার দীর্ঘ শাসনকালের চিত্র এঁকেছেন প্রায় নির্ভুলতার সঙ্গে।

বিবিসি মূল্যায়ন করেছে এভাবে, কর্তব্য নিষ্ঠা আর সিংহাসন আর জনগণের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করার উদাহরণ তৈরি করে গেছেন দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৩ সালে যখন ব্রিটিশ সিংহাসনে দ্বিতীয় এলিজাবেথের অধিষ্ঠান ঘটে, তখন বিশ্ব খুব দ্রুত বদলাচ্ছে, অর্ধ পৃথিবীর অধিশ্বর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন পড়তির মুখে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন লিখেছে, যুদ্ধের ধাক্কায় যখন উপনিবেশিক সাম্রাজ্য ধসে একের পর এক আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছিল, তখনও নেতৃত্বের গুণে রাজপরিবারের উপর শ্রদ্ধার আসন অটুট রেখেছিলেন রানি এলিজাবেথ।

রয়টার্স জানিয়েছে, রানির মৃত্যুর খবরে লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদের বাইরে এরই মধ্যেই জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে। নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

সেখানো জড়ো হওয়া অনেকেই বলছেন, রানি এক কথায় বলতে গেলেন ছিলেন ‘নির্ভরযোগ্য’। তাই তারা শূন্যতা অনুভব করছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক, আলোকচিত্রীরাও বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে হাজির হয়েছেন। সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে মাত্র কয়েক মাস আগেই রানি এ প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে মানুষের অভিবাদনের জবাব দিয়েছিলেন।

বাকিংহাম থেকে রানির অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর ব্রিটিশ রাজপরিবারের জীবনী লেখক রবার্ট হার্ডম্যান বলেছিলেন, “আজকের এই খবর দেশে তার গুরুত্বের কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। রানি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে যে কোনও শাসকের চেয়ে অন্যরকম। তিনি আমাদের দীর্ঘজীবী, দীর্ঘদিন সেবা দেওয়া এবং দীর্ঘদিন সিংহাসনে থাকা শাসক।”

“রানি সিংহাসনে আরোহণের আগে থেকে জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি নির্ভরযোগ্যতা, স্থায়ীত্ব এবং স্থিতিশীলতারই অন্য নাম। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষও তাকে প্রায় সময়ই আপন করে নিয়েছে। এখন হঠাৎ, এমন এক সময়ে আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিনি।

রানির অসুস্থতার খবরেই লন্ডনে বাকিংহাম প্যালেসের সামনে লোকজন জড়ো হতে শুরু করেছিল। সেখানে উপস্থিত পর্যটকদের কারও কারও চোখে পানিও দেখা যায়।

রানির মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের নেতারা শোক জানিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন।

রানির সঙ্গে দুইবার বৈঠকের কথা স্মরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, রানি তার সদয় আচরণ দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন এবং ৯/১১ হামলার অন্ধকার দিনগুলোতে একাত্মভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিলেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোও রানিকে দয়ালু এবং ফ্রান্সের বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস রানিকে রোল মডেল আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা ছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন।