সৌদি আরবে প্রবেশের চেষ্টারত শত শত মানুষকে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, অভিযোগ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের।
Published : 21 Aug 2023, 06:45 PM
সৌদি আরবের সীমান্তরক্ষীরা ইয়েমেন সীমান্তে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নির্বিচারে হত্যা করেছে বলে নতুন এক প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন অতিক্রম করে সৌদি আরবে প্রবেশ করার চেষ্টারত শত শত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, এদের অনেকেই ইথিওপিয়া থেকে এসেছিলেন।
অভিবাসন প্রত্যাশীরা বিবিসিকে জানিয়েছেন, গুলির আঘাতে তাদের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল আর পথে তারা মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন।
এর আগে সৌদি আরব এ ধরনের পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।
‘তারা আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়েছিল’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিস্তারিত সাক্ষ্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে তারা বলেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে ইয়েমেনের বন্ধুর উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে সৌদি পুলিশ ও সেনারা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে আবার কখনো কখনো তাদের লক্ষ্য করে গোলা ছুড়েছে।
সৌদি সীমান্তে গুলিবর্ষণের শিকার হওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যোগাযোগ করেছে বিবিসি। তারা রাতের বেলা সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টার সময় ঘটা ভয়াবহ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে কাজের সন্ধানে নারী ও শিশুসহ ইথিওপিয়া থেকে আসা বড় একটি গ্রুপ গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে।
মুস্তফা সৌফিয়া মোহাম্মদ (২১) বিবিসিকে বলেন, “গুলি চলতেই থাকে আর চলতেই থাকে।”
তিনি জানান, গত জুলাইতে তাদের ৪৫ জনের একটি দল গোপনে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করার সময় গুলির মুখে পড়েছিলেন, এ সময় কয়েকজন নিহত হন।
তিনি বলেন, “আমার শরীরে গুলি লেগেছে বুঝতেই পারিনি। কিন্তু আমি যখন উঠে হাঁটার চেষ্টা করছি আমার পায়ের একটি অংশ আর আমার সঙ্গে ছিল না।”
ইথিওপীয় ও ইয়েমেনি মানব পাচারকারীদের বিভিন্ন অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে বিপদ, ক্ষুধার সঙ্গে তিন মাস ধরে লড়াই করে ওই সীমান্তে উপস্থিত হওয়ার পর এমন নৃশংস, বিশৃঙ্খলভাবে তাদের যাত্রা শেষ হয়।
এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে মুস্তফার বাম পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পরে তার ওই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। ইথিওপিয়ায় ফিরে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি, এখন ক্রাচে ভর করে ও কৃত্রিম পাঁ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয় তাকে।
“আমি আমার পরিবারের অবস্থা উন্নত করার জন্য সৌদি আরব গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি যা আশা করেছিলাম তা বাস্তবায়িত হয়নি। এখন আমার বাবা-মা আমার জন্য সবকিছু করে দেন,” বলেন দুই সন্তানের এই পিতা।
‘মৃত্যুপুরী’
বেঁচে থাকা কিছু মানুষের মধ্যে গভীর আঘাতের লক্ষণ দেখা গেছে।
ইয়েমেনের রাজধানী সানায় অবস্থানরত জারা যা ঘটেছিল তা নিয়ে কথাই বলতে পারেন না। তিনি নিজের বয়স ১৮ বলে জানান, কিন্তু তাকে আরও কম বয়সী দেখায়। পরিচয় গোপন রাখতে তার প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি।
এই দীর্ঘ যাত্রায় তিনি ইতোমধ্যে মুক্তিপণ ও ঘুষ দিতে গিয়ে প্রায় আড়াই লাখ ডলার ব্যয় করে ফেলেছেন, আর তা শেষ হয় সীমান্তে গুলির বৃষ্টির মধ্যে।
একটি বুলেট তার এক হাতের সবগুলো আঙ্গুল কেড়ে নিয়েছে। তার আঘাতের কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেন আর উত্তর দিতে পারেন না।
জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী, বছরে দুই লাখেরও বেশি মানুষ বিপদসঙ্কুল পথে রওনা হন, তারা হর্ন অব আফ্রিকা (আফ্রিকার শিং) থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইয়েমেনে আসেন, তারপর সৌদি আরবের পথে যাত্রা শুরু করেন।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তাদের অনেকেরই কারাবাসের অভিজ্ঞতা হয় আর পথে অনেকে মারধরের শিকার হন।
ওই পথে সাগর পাড়ি দেওয়াই যথেষ্ট বিপজ্জনক। গত সপ্তাহে জিবুতির উপকূলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী একটি জাহাজ ডুবে ২৪ জনেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হন।
ইয়েমেনে অভিবাসন প্রত্যাশীদের ব্যবহার করা প্রধান রুটগুলো পথে মৃত্যু হওয়া লোকজনের কবর দিয়ে ভরা।
দুই বছর আগে সানায় একটি আটক কেন্দ্রে আগুন লেগে বহু অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছিল। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ করা হুতি বিদ্রোহীরা ওই আটক কেন্দ্রটি পরিচালনা করত।
কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সর্বশেষ প্রতিবেদনটি এসব নির্যাতনের প্রকৃতি ও ব্যাপকতার ভিন্ন একটি রূপরেখা তুলে ধরেছে।
এই প্রতিবেদনের প্রধান লেখক নাদিয়া হার্ডম্যান বিবিসিকে বলেন, “আমরা যা নথিভুক্ত করেছি তা মূলত গণহত্যা। লোকজন এমন সব স্থানের বর্ণনা দিয়েছে যাকে মৃত্যুপুরী বলে মনে হয়েছে, পাহাড়ের চারপাশে মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।”
এই প্রতিবেদনে ২০২২ এর মার্চ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ের বয়ান তুলে ধরা হয়েছে। এতে ২৮টি ভিন্ন ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, তার মধ্যে কোনো কোনোটিতে বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে আর আছে খুব কাজ থেকে গুলিবর্ষণ করার ১৪টি ঘটনা।
“আমি কয়েকশ স্পষ্ট ছবি ও ভিডিও দেখেছি। জীবিতরা এগুলো আমার কাছে পাঠিয়েছে। সেগুলোতে বেশ ভয়ঙ্কর আঘাত ও বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট ক্ষতের চিত্র উঠে এসেছে,” বলেন হার্ডম্যান।
তিনি জানান, সীমান্ত ক্রসিংগুলো অনেক দূরবর্তী ও বন্ধুর এলাকায় হওয়ায় আর বেঁচে যাওয়াদের খুঁজে বের করা বেশ কঠিন হওয়ায় ওই সীমান্তে ঠিক কতোজন মানুষ নিহত হয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা জানা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“আমরা বলছি কম করে হলেও ৬৫৫ জন নিহত হয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাটি সম্ভবত কয়েক হাজার হবে। অপব্যবহার ব্যাপক ও পদ্ধতিগত এবং এর অনেকগুলোই মানবতা বিরোধী অপরাধ, এমনটি বাস্তসম্মতভাবে তুলে ধরেছি আমরা,” বলেছেন হার্ডম্যান।
গত অক্টোবরে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা রিয়াদ সরকারকে দেওয়া এক চিঠিতে প্রথম তাদের দক্ষিণ সীমান্তে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের অপরাধগুলোর বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন।
ওই চিঠিতে তারা সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলেছিলেন, এই সীমান্তরক্ষীরা কামানের গোলা ছুড়ে ও গুলিবর্ষণ করে সীমান্তে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।
কিন্তু অভিযোগগুলো ভয়াবহ ধরণের হলেও এই চিঠি প্রায় অলক্ষ্যেই থেকে যায়।
সৌদির অস্বীকার
সৌদি আরবের সরকার বলেছে, তারা এসব অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে; কিন্তু হত্যাকাণ্ডগুলো পরিকল্পিত ও বড় ধরনের, জাতিসংঘের এমন বৈশিষ্ট্য প্রদানকে তীব্রতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে।
“প্রদত্ত সীমিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষগুলো অভিযোগগুলো নিশ্চিত বা প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য বা সাক্ষ্য খুঁজে পায়নি,” জবাবে বলেছে সৌদি আরব সরকার।
কিন্তু গত মাসে একটি বৈশ্বিক গবেষণা নেটওয়ার্ক ‘মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টার’ তাদের নিজেদের নেওয়া জীবিতদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে ওই সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আবার প্রকাশ করে।
তাদের প্রতিবেদনেও ওই সীমান্তজুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা পচে যাওয়া দেহাবশেষের স্পষ্ট বিবরণ উঠে আসে। ধরা পড়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের সৌদি সীমান্তরক্ষীরা জিজ্ঞেস করেছেন, তাদের কোন পায় গুলি করা হবে। এর পাশাপাশি আতঙ্কিত অভিবাসন প্রত্যাশীদের বড় দল লক্ষ্য করে মেশিনগান থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে এবং মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
তবে এখন পর্যন্ত হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনেই ওইসব ঘটনার সবচেয়ে বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদনটিতে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাৎকার, সীমান্তের ক্রসিং পয়েন্টগুলোর স্যাটেলাইট ছবি যেখানে বহু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে আর তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি করা কবরস্থানের ছবি এসেছে।
এই প্রতিবেদনে সীমান্তের কাছে ইয়েমেনের মোনাব্বিহে আটক কেন্দ্র শনাক্ত করা হয়েছে, যেখান থেকে সশস্ত্র মানব পাচারকারীরা অভিবাসন প্রত্যাশীদের পাহারা দিয়ে সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার আগে আটকে রাখে।
কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে নেওয়া একটি ছবিতে দেখা গেছে, চারদিকে বেড়া দিয়ে আটকে রাখা একটি কম্পাউন্ডের ভেতরে পাশাপাশি অনেকগুলো কমলা রঙের তাঁবু।
নতুন কবর
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে বিবরণ উঠে এলেও হত্যাকাণ্ড এখন চলছে এমন প্রমাণ উদ্ঘাটন করেছে বিবিসি।
ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় শহর সায়দার একটি হাসপাতালে শুক্রবার রাতে সীমান্তে আহত হওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের নিয়ে আসা হচ্ছে এমন ভিডিও দেখেছে বিবিসি; আর যারা মারা যাচ্ছে তাদের নিকটবর্তী একটি কবরস্থানে কবর দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, মিক্সড মাইগ্রেশন সেন্টার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য নেওয়ার জন্য সৌদি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে বিবিসি।