“স্টারমার সেদিন হেসেছিলেন; বলেছিলেন, ‘না, পাঁচ বছরেই আমি পারব।”
Published : 05 Jul 2024, 11:45 PM
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির বিপুল বিজয় কেবল আধুনিক ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত নয়, লেবার নেতা কিয়ার স্টারমারের জন্যও বিরাট এক সফলতার গল্প, যিনি দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী।
বিশেষ করে ২০১৯ সালের সর্বশেষ নির্বাচনের পর লেবার পার্টিকে যে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তারপর তিন অঙ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এবারের বিজয়কে একটি বড় ঘটনা হিসেবে দেখানো হয়েছে সিএনএন এর এক বিশ্লেষণে।
কট্টর বামপন্থি হিসেবে পরিচিত জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টিকে গত নির্বাচনে বহু যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরাজয় মেনে নিতে হয়েছিল।
ব্রেক্সিট বিপর্যয়ের পর বরিস জনসনের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে ওই নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল, তারপর ভোটারদের আস্থা অর্জন, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ার মত শক্তির জায়গায় পৌঁছাতেও লেবার পার্টির বহু বছর লেগে যাবে বলে মনে হচ্ছিল।
জনসন শুধু তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরই পরাজিত করেননি, ব্রিটিশ রাজনীতির কায়দা-কানুনই উল্টে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে ২০১৯ সালের নির্বাচনে শ্রমিক অধ্যুষিত আসনগুলোতেও জয় পেয়েছিল টোরিরা, যেসব আসন একসময় রক্ষণশীলদের নাগালের বাইরে বলেই মনে করা হত।
এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ৪ এপ্রিল ভগ্নপ্রায় লেবার পার্টির দায়িত্ব নেন স্টারমার। দলীয় সহকর্মী ডেভিড ল্যামি সেদিন তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, "আগামী নির্বাচনে আপনি হয়ত হেরে যাবেন, তখন নতুন করে যেন শুরু করতে পারেন, সেজন্য দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করুন।”
ডেভিড ল্যামি বলেন, “স্টারমার সেদিন হেসেছিলেন; বলেছিলেন, ‘না, পাঁচ বছরেই আমি পারব।”
কিন্তু ২০২১ সালের শেষ থেকে বৃহস্পতিবারের নির্বাচনের রাতের মধ্যে কী কী ঘটতে যাচ্ছে, সেদিন স্টারমারও তা কল্পনা করতে পারেননি।
গত নির্বাচনে বিপুল জয়ে উড়তে থাকা কনজারভেটিভ পার্টি শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়েছে একের পর এক আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের কারণে, যার শুরুটা হয়েছিল জনসনের ‘পার্টিগেট’ কেলেঙ্কারি দিয়ে। কোভিড মহামারীর ওই সময়ে সারা দেশে যখন কঠোর লকডাউনের মধ্যে, জনসনের ডাউনিং স্ট্রিটের কর্মীরা তখন আইন ভেঙে মেতেছিলেন মদের পার্টি।
নানা বিতর্কে জনসনের পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে উঠছিল। কিন্তু ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলেন। তাকে বাদ দেওয়ার পর টোরিরা লিজ ট্রাসকে তাদের নেতা বানিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে পাঠাল। কিন্তু তিনি এমন এক কর সংস্কার প্রস্তাব আনলেন, যা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকেই অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিল। মাত্র ৪৯ দিন ক্ষমতায় থাকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন ট্রাস।
মিউজিক্যাল চেয়ারে পরিণত হওয়া টোরি নেতৃত্বে এরপর এলেন ঋষি সুনাক, ২০২২ সালের শেষ দিকে তিনি ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু ততদিনে কনজারভেটিভরা বুঝে গেছে, ক্ষমতায় তাদের সময় আসলে ফুরিয়ে এসেছে।
আর ঠিক ওই সময়টায় নিজের ভিত শক্ত করেছেন লেবার নেতা স্টারমার। এমন উদার নীতি তিনি নিয়েছেন, যাতে রক্ষণশীল ভোটাররা শঙ্কিত হয়ে দূরে সরে না যায়। লেবার পরিবারকে তিনি এভাবেই ফিরিয়ে নিয়েছেন ব্রিটিশ রাজনীতির কেন্দ্রস্থলে।
লেবার পার্টিতে স্টারমারের সমালোচকরা অবশ্য অন্য কথা বলছে। তাদের মতে, সরকারে গিয়ে সাড়া জাগানোর মত পরিকল্পনা দিতে স্টারমার ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের শঙ্কা, অর্থনীতি নিয়ে স্টারমারের উদার নীতি এবং নমনীয় ভঙ্গি ভোটারদের মন জয় করতে পারবে না। তাতে হয়ত পাঁচ বছর পর, পরবর্তী নির্বাচনের সময় তাকে ডানপন্থি জোয়ারের সামনে ধরাশায়ী হতে হবে।
হয়ত তাদের সেই আশঙ্কা সত্যি হবে না। কারণ ডানপন্থি পপুলিস্ট দল রিফর্ম ইউকের সাফল্য ইতোমধ্যে দেখে ফেলেছে যুক্তরাজ্য, যে দলের নেতৃত্বে আছেন ডনাল্ড ট্রাম্পের বন্ধু নাইজেল ফারাজে। বলা হয়, তিনিই একমাত্র ব্রেক্সিট সমর্থক যিনি ব্রেক্সিটার হিসেবে বরিস জনসনের চেয়েও বেশি বিখ্যাত।
অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছিল, স্টারমার যদি লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় নিতে সফল হন, তার কৃতিত্ব আংশিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু কনজারভেটিভদেরই দিতে হবে। কারণ ১৪ বছর ধরে তাদের ক্ষমতায় দেখতে দেখতে ভোটারদের অনেকেই স্রেফ পরিবর্তন চাইছিল।
ফারাজের দলের ভোটের প্রচারের সময় যে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল, তাতে এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, ডানপন্থিদের ভোট এবার আরো ভাগ হয়ে যাবে। তাতে গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে লেবার পার্টির জয় পাওয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন আরো সহজ হবে।
অন্যভাবে বললে, স্টারমারের দল যাদের ভোট পেয়েছে, তাদের সবাই হয়ত তাকে নেতা মেনে বা পার্টির ইশতেহারে আস্থা রেখে তাদের ভোট দেননি, হয়ত তারা পরিবর্তন চেয়েছেন বলেই তাদের ভোট লেবারের পক্ষে গেছে। আর সেরকম হলে পরবর্তী সময়ে তা স্টারমারের জন্য তা সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে, কারণ আবারও মানুষ পরিবর্তন চাইতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বিপুল ভোটের মান্ডেটেও স্টারমারের জন্য একটুখানি সতর্কবাণী থেকে যাচ্ছে। ডানপন্থি উত্থানের ঝুঁকি আগামীতেও থাকবে। কনজারভেটিভরা পরাজিত হলেও ভেঙে পড়েছে বলা যাবে না। আর লেবার পার্টি বড় জয় পেলেও তা ততটা বড় হয়নি, যতটা কোনো কোনো জরিপের ফলে দেখানো হয়েছিল।
স্টারমার হয়ত এসব নিয়ে এখনই অতটা উদ্বিগ্ন হবেন না। পার্লামেন্টে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি পেয়েছেন, তাতে সহজেই দলের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। আর দেশ শাসন করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের পূর্ণ সহযোগিতা তিনি পাবেন।
এটা সেই ক্ষমতা, যা অনেক লেবার নেতার নাগালের বাইরে থেকে গেছে। শেষ পর্যন্ত সেই ক্ষমতা ধরা দিল স্টারমারের হাতে, যিনি কিছুদিন আগেও একজন আইনজীবী ছিলেন।
প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা লেবার পার্টির অনেকের জন্য এটাই এখন অনেক কিছু।