বিশ্বজুড়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রাসী নীতির জেরে এখন বিদেশে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় ভ্রমণে যেতে ভীত-উদ্বিগ্ন আমেরিকানরা। মার্কিনি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জা পাচ্ছেন কেউ কেউ।
Published : 13 Apr 2025, 05:17 PM
ভ্রমণ শিল্পে পাকা অভিজ্ঞতা থাকা যে কারও মতোই নেপালের ‘স্যোশালট্যুর’ ভ্রমণ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রাজ গয়াওয়ালিও বোঝেন, কখনও কখনও মানুষ ভ্রমণ বাতিল করে অসুস্থতার মতো কারণে। এ ব্যবসায় এরকম সাধারণত হয়েই থাকে।
কিন্তু সম্প্রতি রাজ তার ২০ বছরের ক্যারিয়ারে এই প্রথম একজন আমেরিকানকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ভয়ের কারণে নেপাল ভ্রমণ বাতিল করতে দেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন।
তার কথায়, “পুরোপুরি নিশ্চিত একটি বুকিং তখনই বাতিল হতে পারে, যখন একজন মানুষ ভ্রমণ করা নিরাপদ বলে মনে করেন না।”
কেবল একজন আমেরিকানই নয়, অন্য আরও আমেরিকান খদ্দেরের মধ্যেও একইরকম ভীতি-উদ্বেগ ইদানিং বেশি কাজ করার বিষয়টি নজরে পড়েছে বলে সিএনএন ট্র্যাভেল-কে জানিয়েছেন রাজ গয়াওয়ালি।
মানুষের এমন বোধ করার কারণটি পুরোপুরিই বোঝেন জানিয়ে রাজ বলেন, “নিজেদের সাফাই গাইতে হয় এমন একটি দেশ থেকে কোথাও ভ্রমণে যেতে মানুষের অস্বস্তি বোধ করারই কথা। কিংবা এই সময় কোথাও মানুষকে ক্ষমাপ্রার্থী হতে হলেও তা বিব্রতকর। আর এর প্রভাব অনেক দেশ এবং অনেক ভ্রমণের ওপরই যে পড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”
ট্রাম্প্র প্রশাসন বিশ্ব জুড়ে যে আগ্রাসী নীতি নিয়েছে, তার জেরেই এখন বিদেশে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় ভ্রমণে যেতে ভীত-উদ্বিগ্ন আমেরিকানরা। কেউ কেউ আবার ভ্রমণে গিয়ে লজ্জা পাচ্ছেন। দ্বিধা করছেন নিজেকে মার্কিনি বলে পরিচয় দিতেও।
ট্রাম্প কানাডা, গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকি-ধামকি দিয়েছেন। একের পর এক ঢালাওভাবে উচ্চহারের শুল্ক চাপাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের ওপর, যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু কিংবা মিত্র দেশ কোনোটিই।
কানাডা থেকে চীন পর্যন্ত প্রত্যেককেই ট্রাম্প ক্ষেপিয়ে রেখেছেন। আর এটাই আমেরিকানদের বিদেশ ভ্রমণে ভয় ও দ্বিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর তার কর্মকাণ্ডের কারণে কয়েকমাসের মধ্যেই বিদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণে যেতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা যেমন পড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বিদেশে যেতে মার্কিনিরা তেমন আগ্রহী হচ্ছে না।
বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা যারা করছেন সেইসব মার্কিনি এবং যারা এরই মধ্যে বিদেশ ভ্রমণে আছেন তাদের মধ্যে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্সির প্রভাব খুব গভীরভাবেই অনুভূত হচ্ছে। কারণ, তাদেরকে এখন আমেরিকা এবং আমেরিকানদের নিয়ে বিশ্বের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে।
মার্কিন এক পাবলিক রিলেশনস ও ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ সিয়েরা মেলোন তার অণুভূতি প্রকাশ করে সিএনএন ট্র্যাভেলকে বলেন, তিনি ইউরোপে ভ্রমণে যেতে এবার অনেক বেশি নার্ভাস বোধ করছেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে বিদেশে যেতে বিব্রত লাগত আর এখন তার ভয় লাগছে বলে জানান মেলোন।
এর কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, পরিবেশ এবার ভিন্নরকম হবে, আর বিশ্বের মানুষ আমেরিকানদের কি চোখে দেখবে সেটি চিন্তা করেই ভয় লাগছে।
আমেরিকানরা আর স্বাগত নয়?
এ বছর জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভ্রমণে ইচ্ছুক বেশিরভাগ মার্কিনিই মনে করে বিদেশে গেলে তারা আর সাদর অভ্যর্থনা পাবে না।
ব্রিটিশ বাজার গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণমূলক ফার্ম ইউগভ জরিপের সাম্প্রতিক তথ্যও বলছে, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেওয়ার পর ইউরোপে ৭ টি প্রধান দেশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমাদর উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
জরিপ প্রতিবেদন বলছে, ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আগে সর্বশেষ জরিপে যে পরিসংখ্যান দেখা গিয়েছিল, তার চেয়ে এখনকার পরিসংখ্যান ৬ থেকে ২৮ শতাংশ পয়েন্ট কম।
ডেনমার্কে যুক্তরাষ্ট্রের সমাদর সবচেয়ে কম দেখা গেছে। ড্যানিশদের মাত্র ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে মত দিয়েছে। এ হার ২০২৪ সালের অগাস্টের ৪৮ শতাংশের চেয়ে কম।
সুইডেন, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে মত দিয়েছে। আর ইতালি ও স্পেনে এই হার যথাক্রমে ৪২ এবং ৪৩ শতাংশ।
ইউগভের এক মুখপাত্র জানান, পশ্চিম ইউরোপে চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, সেখানে মানুষ ইউক্রেইন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থানের কারণে তার তুমুল সমালোচনা করেছে।
কিছু মার্কিনি যারা ভ্রমণপ্রিয় কিংবা কাজের কারণে প্রতিবছর ৫ থেকে ৭ সপ্তাহ বিদেশে কাটান, তাদের জন্য বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি-- যেমন: ইউক্রেইনকে সামরিক সহায়তা করা থেকে দূরে থাকা, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, বিশৃঙ্খল বাণিজ্য নীতি, ইউরোপীয় অ্যালকোহলের ওপর ২০০ শতাংশ শুল্কের হুমকি, আমদানি ইইউ পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক, যার জবাব দেওয়ার অপেক্ষায় আছে ব্লকটি।
এ সবই ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের তুলনায় দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্সির আামলে আমেরিকানদেরকে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বিব্রবতকর অবস্থায় ফেলেছে।
মার্কিন নাগরিক হিসেবে লজ্জা ও বিব্রতকর অনুভূতির কারণে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যের ডালাস থেকে প্রথমবার ফ্রান্স ভ্রমণে যাওয়া এক দম্পতি অভিনব কিছু পূর্সতর্কতা অবলম্বন করেন।
তারা ঠিক ছদ্মবেশ ধারণ না করলেও মার্কিনি পরিচয় লুকাতে চেয়েছেন। প্যারিসের হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে বারবারা ও রিক উইলসন দম্পতি ছোট্ট একটি কালো টেপ দিয়ে মাথার সাদা-কালো বেসবল ক্যাপে থাকা তারকাখচিত ও ডোরাকাটা মার্কিন পতাকা ঢেকে দেন।
বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণায় মার্কিন নাগরিক হিসেবে লজ্জা ও বিব্রতকর অনুভূতির কথা জানান এই দম্পতি। বারবারা বলেন, “আমাদের দেশ নিয়ে আমি হতাশ। শুল্ক নিয়ে আমরা বিচলিত।”
এই দম্পতির কয়েক গজ দূরেই বিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের সামনে মানুষের জটলার মধ্যে আরেক মার্কিন দম্পতিও নিজেদের পরিচয় কিছুটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন এবার; যেমনটি সাধারণত দেখা যায় না।
নিউ ইয়র্কে অ্যাটর্নি হিসেবে কাজ করা ক্রিস এপসও এবার ফ্রান্স সফরে একটু ভিন্ন পোশাক পরার পরিকল্পনা করেন। তিনি জানান, তার সঙ্গে নিউ ইয়র্কের কোনও ইয়াঙ্কি হ্যাট নেই। সেটি হোটেলে রেখে এসেছেন তিনি। কারণ, হ্যাট দেখে মানুষ তাদেরকে আলাদা মনে করতে পারে।
ট্রাম্প-প্রভাবিত বিশ্বে পর্যটন সুরক্ষিত রাখার চিন্তা:
ইউরোপীয় ট্রাভেল কমিশনের সিইও অবশ্য সিএনএন-কে বলেছেন, সর্বসাম্প্রতিক অ্যারাইভাল ডাটা থেকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কারণে ইউরোপে মার্কিনিদের ভ্রমণে প্রভাব পড়ার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি এবং আমেরিকার বাজার এখনও ইউরোপের পর্যটনের ভিত্তিপ্রস্তর।
তবে তারপরও কয়েকজন পর্যটন বিশেষজ্ঞ সামনের দিনগুলোর পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নেপালের ভ্রমণ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা রাজ গয়াওয়ালিও মনে করেন ভ্রমণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনের চ্যালেজ্ঞের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য আরও সুরক্ষামূলক অবস্থান নেওয়া দরকার।
অর্থাৎ, তার মতে, ট্রাম্পের প্রভাবে প্রভাবিত এই বিশ্বে পর্যটনকে কীভাবে নির্বিঘ্ন রাখা যায় সেই কৌশল নেওয়ার এখনই সময়।
নরওয়ের ট্যুর কোম্পানি এথিক্যাল ট্রাভেল পোর্টালও ইদানিং আমেরেকিান খদ্দেরদের ভ্রমণ বাতিলের মুখে পড়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। এই আমেরিকানরা তাদের ব্যবসার একটি বড় অংশ।
সূত্র: সিএএন/বিবিসি।