মনমোহন সিংকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের মুখ্য সচিব একদিন ফোন করে বলেন, অর্থমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে তিনি সবার আগে রয়েছেন। এরপর…।
Published : 27 Dec 2024, 11:52 PM
মনমোহন সিংহ তখন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। নেদারল্যান্ডসে একটি সম্মেলনে শেষে দেশে ফিরেই একটি ফোনকল পেলেন, এরপর ঘুরে গেলে তার জীবনের চাকা, সঙ্গে ভারতের অর্থনীতিও।
ঘটনাটি ১৯৯১ সালের। পিভি নরসীমা রাও তখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সোভিয়েত পতনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত ভারতও বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ঠিক সেসময় নরসীমা রাওয়ের মুখ্য সচিব পিসি আলেক্সান্ডারের অপ্রত্যাশিত ফোন পেলেন মনমোহন সিং; ওপাশ থেকে বলা হল- অর্থমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে তিনি সবার আগে রয়েছেন।
“তিনি (আলেক্সান্ডার) রসিকতা করে বললেন, অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয়, আমরা সবাই এর কৃতিত্ব নেব। আর যদি ঠিকঠাক কাজ না হয়, তবে আমাকে বরখাস্ত করা হবে,” মেয়ে দামা সিংয়ের লেখা ‘স্ট্রিক্টলি পারসোনাল: মনমোহন অ্যান্ড গুরশরণ’ বইতে বলে গেছেন মনমোহন সিং।
এনডিটিভি লিখেছে, এরপর ১৯৯১ সালের ২১ জুন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মনমোহন সিং। সেই শপথই ছিল ভারতের অর্থনৈতিক আমূল পরিবর্তনের শুরু। দেশটির উদার অর্থনীতির দ্বার খুলে যায় সেসময়।
প্রথম দিককার স্মৃতি স্মরণ করে মনমোহন সিং তার মেয়ের বইতে বলেছেন, “তখন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওকে আমার প্রভাবিত করতে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল তিনি ভরসা পাচ্ছেন না। কিন্তু পরে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমরা সঠিক জিনিসটাই করছি। এর বাইরে কোনো বিকল্প নেই।
“কিন্তু তিনি মধ্যম পন্থা নিতে চেয়েছিলেন। যেমন- আমাদের উদারনীতি নেওয়া উচিত; কিন্তু প্রান্তিক, গরীব মানুষদেরও দেখতে হবে।”
অর্থমন্ত্রী হয়ে মনমোহন সিং বেশিরভাগ শিল্পকে লাইসেন্সের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করেন। একচেটিয়া ও কঠোর বাণিজ্য আইন সংশোধন করেন। করের নতুন ব্যবস্থা চালু করেন। সরকারি খাতে একচেটিয়া ক্ষমতার অবসান ঘটান।
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্য দিয়েই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এরপর ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে মনমোহন সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।
ওই ঘটনা ছাড়াও দামান সিং তার বইতে বাবা মনমোহন সিং ও মা গুরশরণ কৌরের ১৯৩০ থেকে ২০০৪ সালের জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। মা-বাবার সঙ্গে আলাপ এবং বিভিন্ন বই ও আর্কাইভ ঘেঁটে তিনি বইটি লিখেন।
বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির একটি হাসপাতালে মারা যান ৯২ বছর বয়সী মনমোহন সিং। তার মৃত্যুর পর থেকেই ‘স্ট্রিক্টলি পারসোনাল: মনমোহন অ্যান্ড গুরশরণ’ বইটির নানা ঘটনাপ্রবাহ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে আসছে।
ভারতের উদার অর্থনীতির ‘স্থপতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া মনমোহন সিংকে। মৃত্যুর পর বিশ্ব নেতারা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সততা এবং ভারতের উন্নয়নের নেপথ্যে অবদানের প্রশংসা করছেন।
তার অর্থনৈতিক সংস্কারের মধ্য দিয়েই ভারতের বাজারে বিশ্বায়নের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছিলেন তিনি। পাশাপাশি দেশকে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডের ডিগ্রিধারী এই অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদের জন্ম ১৯৩২ সালে পাঞ্জাবের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। শিখদের মধ্যে মনমোহন ছিলেন প্রথম রাজনীতিক, যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে বসেছিলেন।
আরও পড়ুন-
কীর্তিমানের মৃত্যু নেই: মনমোহন সিংকে বিশ্ব নেতাদের শ্রদ্ধা
'ঘনিষ্ঠ বন্ধু' মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণে ব্যথিত মুহাম্মদ ইউনূস