দুর্নীতির দায়ে ২০১৮ সালে সাত বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নওয়াজ গত চার বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন।
Published : 21 Oct 2023, 11:42 AM
সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে ফিরেছেন লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। শনিবার বিকালে দুবাই হয়ে তিনি ইসলামাবাদ পৌঁছান বলে জানায় দেশটির ইংরেজি ভাষার দৈনিক ডন।
এদিন নওয়াজকে স্বাগত জানাতে পাকিস্তানে তার আইনজীবীদের দল এবং দলীয় নেতারা বিমান বন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
লন্ডন থেকে বিমান উঠার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশে ফিরে যেতে পারছেন বলে তিনি দারুণ খুশি।
দুর্নীতির দায়ে ২০১৮ সালে সাত বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয় নওয়াজকে। সর্বশেষ পাকিস্তানে কারাগারে তিনি সাজা ভোগ করছিলেন। কিন্তু পরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২০১৯ সালের নভেম্বরে চিকিৎসার জন্য আদালত তাকে যুক্তরাজ্য যাওয়ার অনুমতি দেয় এবং এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি লন্ডন চলে যান।
নওয়াজ ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩, ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ এবং ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিন দফায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন, যদিও কোনোবারই তিনি মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি।
দীর্ঘ এ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নানা সময়ে নওয়াজ দেশটির রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধের কারণেই তাকে বার বার ক্ষমতা ছাড়া করা হয়েছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
বিবিসি জানায়, নওয়াজের এবারের দেশে ফেরা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন, বিরোধ মিটিয়ে তাকে আবারও স্বাগত জানাতে প্রস্তুত পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এমনকি নওয়াজকে আবারও দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে দেখা যেতে পারে।
নওয়াজ দেশে ফেরার পর কী ঘটতে পারে?
গত চার বছর লন্ডনে কাটিয়েছেন নওয়াজ। সেখানে শুরুতে রাজনৈতিকভাবে তিনি বেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে ছিলেন। হৃদরোগ, বহুমূত্ররোগ ও কিডনি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত এই নেতা নিজের চিকিৎসাতেই বেশি মনযোগ দেন। মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনী ও ইমরান খান সরকারের সমালোচনা করতে অবশ্য তাকে দেখা গেছে।
কিন্তু ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর পুনরায় রাজনীতিতে দারুণ সক্রিয় হয়ে ওঠেন নওয়াজ। নওয়াজের স্থলাভিষিক্ত হয়েই ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান।
ইমরান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলে পাকিস্তানের সরকার পরিচালনায় চলে আসে নওয়াজের দল পিএমএল-এন। দলটির বর্তমান নেতা নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরীফ।
এখন বড় ভাই দেশে ফিরছে। ইসলামাবাদ থেকে নওয়াজের তার বাড়ি লাহোরে যাওয়ার কথা রয়েছে। যেখানে তিনি একটি গণ সমাবেশে যোগ দেবেন।
নওয়াজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা এখনো চলছে। তবে তার গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় নেই। কারণ তিনি আদালতে পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত নিজের জামিন নিশ্চিত করেছেন।
স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে নওয়াজ অবশ্য এবারই প্রথম দেশে ফিরছেন না। এর আগে ২০০৭ সালেও দেশে ফিরে পাকিস্তানের প্রয়াত নেতা বেনজির ভুট্টোকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনীর সাথে একটি ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের পর পুনরায় পাকিস্তানে নির্বাচনের আয়োজন করেন। সেবার নির্বাচনী প্রচার যখন দারুণ জমজমাট তখনই এক সমাবেশে গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তান পিপুলস পার্টির (পিপিপি) নেতা বেনজির। তার কয়েক সপ্তাহ পর ভোটে বড় জয় পেয়ে ক্ষতায় আসে পিপিপি।
নওয়াজ কী আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন?
পাকিস্তানে এ বছর নভেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা পিছিয়ে আগামীবছর জানুয়ারি নাগাদ ভোট হতে পারে। পিএমএল-এন আগেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, নওয়াজই দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী।
তবে দল যতই তাকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করুক, ৭৩ বছর বয়সী নেওয়াজকে চতুর্থবারের মত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান আগে করতে হবে।
শাহবাজ শরীফ সরকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই। তার উপর ইমরান খান এখনো কারাগারে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে নির্বাচনে নওয়াজ বা ইমরান নয় বরং দেশটির সেনাবাহিনী যে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় হয়ে উঠবে তার প্রমাণ ইতিহাসেই পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান কিভাবে পরিচালিত হবে তার সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীকেই নিতে দেখা গেছে। যে কারণে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতার মেয়াদ শেষ করে সাংবিধানভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেননি।
বিদেশে থাকার সময় নওয়াজ নানা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্যও তিনি সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। তিনি ‘ভুয়া মামলার’ শিকার হয়েছেন এবং দেশটির বিচারকরা যোগসাজশ করে তাকে সাজা দিয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
যদিও তার রাজনৈতিক বিরোধীরা মনে করছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েই দেশে ফিরছেন নওয়াজ। তবে তিনিই যে নির্বাচনে জিতবেন সেটা তারা বিশ্বাস করেন না।
ইমরানের দল পিটিআই এর সদস্য জুলফি বুখারি বিবিসিকে বলেন, “আমি তার (নওয়াজ) প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা আর দেখছি না। কারণ, তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং আদালত তাকে রাজনীতিতে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।”
তবে পিটিআই যত কথাই বলুক, অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, নিশ্চিতভাবেই নওয়াজের পক্ষে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ওয়াজাহাত মাসুদ বিবিসিকে বলেন, “আমাদের রাজনীতির এই ল্যান্ডস্কেপ ও স্ক্রিপ্ট কখনো পরিবর্তন হবে না। শুধু রাজনৈতিক চরিত্রগুলো বদলে যাবে।
“২০১৮ সালে সেনাবাহিনী ইমরান খানকে জেতাতে কাজ করেছে। এবার নওয়াজের পক্ষে ভোটের পরিবেশ ঠিক করতে ব্যস্ত আছে।”
চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন নওয়াজ শরীফ
মরিয়মের কিছু হলে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনী দায়ী থাকবে: নওয়াজ শরীফ