অপরাধ দমনের নামে এ নজরদারি ব্যবস্থাপনা জনগণের স্বাধীনতা সংকুচিত করছে এবং মানুষের মৌলিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে, বলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
Published : 28 Feb 2025, 11:18 AM
মার্কিন বাহিনীকে হটিয়ে আফগানিস্তানের শাসনভার নেওয়ার সময় তালেবান রাজধানীসহ সারা দেশে হামলা, ছিনতাই, অপহরণসহ নানান অপরাধ দমনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা বাস্তবায়নে কাবুলজুড়ে বসানো তাদের হাজার হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা এখন শহরের প্রতিটি কোণে নজরে রাখছে।
এই নজরদারি নেটওয়ার্ক অপরাধ দমনে ব্যাপক কাজে দিচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষ বললেও সমালোচকদের সন্দেহ, ভিন্নমত দমন আর কঠোর শরিয়া আইনের প্রয়োগেই তালেবান এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
প্রথম আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম হিসেবে বিবিসি সরাসরি এই নজরদারি ব্যবস্থা দেখার সুযোগ পায়, জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটি।
বিবিসি কয়েক ডজন টিভি স্ক্রিনে ঠাসা একটি নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে গিয়েছে, যেখান থেকে তালেবানের পুলিশ বাহিনী পরিচালনা করছে ৯০,০০০ সিসিটিভি ক্যামেরার বিশাল নেটওয়ার্ক—যার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
তালেবান পুলিশ প্রধানের মুখপাত্র খালিদ জাদরান এক স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আমরা এখান থেকে পুরো কাবুল শহর পর্যবেক্ষণ করছি।”
কর্তৃপক্ষের দাবি, এই নজরদারি ব্যবস্থা অপরাধ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এটি ভিন্নমত দমন এবং শরিয়া আইনের নিজস্ব ব্যাখ্যার ভিত্তিতে কঠোর নৈতিকতা বিধি বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হতে পারে।
কন্ট্রোল রুমের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে বসে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা হাজার হাজার ক্যামেরার লাইভ স্ট্রিম পর্যবেক্ষণ করছেন, কাবুলের ৬০ লাখ বাসিন্দার ওপর তাদের নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন।
তালেবানের নতুন নজরদারি ব্যবস্থায় গাড়ির লাইসেন্স প্লেট থেকে শুরু করে মানুষের মুখের অভিব্যক্তি পর্যন্ত সবকিছু দেখা যায়।
তালেবান পুলিশ প্রধানের মুখপাত্র খালিদ জাদরান জানান, “নির্দিষ্ট কিছু এলাকায়, যখন আমরা কোনও মানুষজনের জটলা লক্ষ্য করি বা যদি কাউকে সন্দেহ হয় যে তারা মাদক সেবন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা সন্দেহজনক কোনো কিছুতে জড়িত, তখন আমরা দ্রুত স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করি।”
আফগানিস্তানের আগের সরকারগুলোর আমলে কাবুলে প্রতিদিন তালেবান ও তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জঙ্গিদের হামলা, হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের অপহরণ ও গাড়ি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ ছিল নিয়মিত। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করে তালেবান এসব অপরাধ দমনের প্রতিশ্রুতি দেয়।
সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তালেবান যে ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে, বিপুল সংখ্যক নজরদারি ক্যামেরা তারই ইঙ্গিত হচ্ছে। তালেবান ফেরার আগে কাবুলজুড়ে মাত্র ৮৫০টি নজরদারি ক্যামেরা ছিল বলে জানিয়েছেন নিরাপত্তা বাহিনীর এক মুখপাত্র।
এর মধ্যে গত তিন বছরে তালেবান সরকার বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, যা মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা বিশেষ করে নারী স্বাধীনতাকে আরও সীমিত করেছে। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ তাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি।
বিবিসি কাবুলে যে নজরদারি ব্যবস্থা দেখেছে, তাতে ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে, যা মানুষের গতিবিধি ট্র্যাক করতে পারে। একটি স্ক্রিনের কোণে প্রতিটি ব্যক্তির মুখ বিশ্লেষণ করে তাদের বয়স, লিঙ্গ এবং তারা দাড়ি রেখেছে কিনা বা মাস্ক পরেছে কিনা তা নির্ণয় করা যায়।
তালেবান পুলিশ মুখপাত্র খালিদ জাদরান বলেন, “আবহাওয়া ভালো থাকলে দিনের বেলায়, আমরা কয়েক কিলোমিটার দূরের ব্যক্তিকেও খুব পরিষ্কারভাবে দেখতে পারি।”
তালেবানরা এমনকী নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরও নজরদারিতে রেখেছে।
তাদের দাবি, উন্নত নজরদারি প্রযুক্তির ব্যবহার নিরাপত্তা বৃদ্ধি, অপরাধ দমন এবং অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তারে সহায়ক হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিসিটিভি ক্যামেরা ও মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালুর ফলে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে অপরাধের হার ৩০ শতাংশ কমেছে।
বিবিসি এই পরিসংখ্যান স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি।
এদিকে অধিকার সংগঠনগুলো তালেবানের নজরদারি কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, কার ওপর, কতক্ষণ নজরদারি চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা নেই।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ নামে তালেবান যে নজরদারি ব্যবস্থা চালু করেছে, তা তাদের কঠোর নীতিগুলো টিকিয়ে রাখারই একটি কৌশল।
এই নজরদারি কার্যক্রম আফগানিস্তানের মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করছে, বিশেষত জনসমাগমস্থলে নারীদের স্বাধীনতাকে আরও সংকুচিত করছে, বলছে তারা।
দেশটির এখনকার আইন অনুযায়ী, নারীদের উচ্চস্বরে কথা বলার অনুমতিও নেই, তবে এটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। এছাড়া, কিশোরীদের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে; নারীদের অনেক ধরনের চাকরি করার ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে ধাত্রী ও নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণরত কয়েকজন নারী বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, তালেবান কর্তৃপক্ষ তাদের ক্লাসে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
কাবুলের মতো শহরের রাস্তায় নারীদের দেখা গেলেও তাদের মুখ ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক।
যে পরিস্থিতি তাতে চাকরি পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে কাবুলের নারীদের। এদেরই একজন ফারিবা (নিরাপত্তার স্বার্থে আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি), স্নাতক পাস এই তরুণী থাকেন বাবা-মায়ের সঙ্গে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, নারীদের হিজাব (পর্দা) পর্যবেক্ষণে এসব নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার করা হতে পারে সন্দেহে তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
এই নজরদারি নেটওয়ার্ক তালেবান শাসনের বিরোধীদের আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলবে, অনুমান তার।
“অনেক ব্যক্তি, বিশেষ করে সাবেক সামরিক সদস্য, মানবাধিকারকর্মী এবং প্রতিবাদী নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চাইলেও তা কঠিন হয়ে পড়েছে, তাদেরকে গোপনীয়তার সঙ্গে বসবাস করতে হচ্ছে।"
আরেক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজ কীভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য আফগানিস্তানে কোনো ডেটা সুরক্ষা আইন নেই।
পুলিশের দাবি, এসব ডেটা শুধু তিন মাসের জন্য সংরক্ষণ করা হয়।
আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ক্যামেরাগুলো সম্পূর্ণ নিরাপদ। এগুলো ‘একটি নির্দিষ্ট ও সম্পূর্ণ গোপনীয় কক্ষ থেকে’ দায়িত্বপ্রাপ্ত পেশাদাররা পরিচালনা করেন।
আফগান তালেবানরা তাদের নজরদারি ব্যবস্থাপনায় এখন যে ক্যামেরাগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলো চীনের তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কাবুলের কন্ট্রোল রুমের সরঞ্জাম ও ব্র্যান্ডিংয়ে এগুলো চীনা সরকার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দাহুয়ার বলে বুঝতে পেরেছে বিবিসি।
এর আগে চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ের কাছ থেকে ক্যামেরা কেনা নিয়ে তালেবান আলোচনা করছে বলে খবর প্রকাশিত হলেও হুয়াওয়ে পরে তা অস্বীকার করে।
নজরদারি নেটওয়ার্কের সরঞ্জাম কোথা থেকে এসেছে, সে বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি তালেবান কর্মকর্তা।
নতুন এই নেটওয়ার্ক স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার খরচও তোলা হচ্ছে সাধারণ আফগানদের কাছ থেকে—যাদেরকে এই সিস্টেমের মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
কাবুলের মধ্যাঞ্চলের বাসিন্দা শেলা বিবিসিকে জানান, তার বাড়ির আশপাশের রাস্তায় লাগানো কিছু ক্যামেরার জন্য তাকে অর্থ প্রদান করতে বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, “তারা প্রতিটি পরিবার থেকে হাজার হাজার আফগানি (আফগানিস্তানের মুদ্রা) দাবি করেছিল।”
একটি দেশে যেখানে চাকরিজীবী নারীরা মাসে মাত্র পাঁচ হাজার আফগানি (প্রায় ৬৮ ডলার) আয় করেন, সেখানে এই ব্যয় অনেকের জন্যই বোঝা।
বহু বছরের যুদ্ধের পর কাবুলসহ পুরো আফগানিস্তানের মানবিক পরিস্থিতিও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
দেশটির অর্থনীতি সংকটে, তালেবান পুনরায় ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তাও অনেকাংশে বন্ধ। জাতিসংঘের তথ্য মতে, দেশটির তিন কোটি মানুষের এখনি জরুরি সহায়তা প্রয়োজন।
শেলা বলেন, “যদি পরিবারগুলো ক্যামেরার জন্য টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে তিন দিনের মধ্যে তাদের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেওয়া হয়।”
“মানুষ ক্ষুধার্ত—এই ক্যামেরাগুলো তাদের কী কাজে আসবে?”
তালেবান বলছে, কেউ চাইলে এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানাতে পারে, আর ক্যামেরার জন্য অনুদান দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
পুলিশের মুখপাত্র খালিদ জাদরান বলেন, “এই অনুদান ঐচ্ছিক, আর পরিমাণও বেশি নয়।”
যদিও মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, এই নজরদারি ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
কাবুলের একজন সবজি বিক্রেতা জাবের বলেন, ক্যামেরাগুলো আফগানদের আরও অসহায় করে তুলেছে।
“আমাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়, কাজের সুযোগ নেই, কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয় না। আমরা কিছুই করতে পারি না,” বলেন তিনি।