বিবিসি লিখেছে, প্রিগোজিনের বিমান যদি সত্যিই গুলি করে নামানো হয়, তাহলে কেউ খুব একটা অবাক হবেন না, কারণ তার ‘শত্রুর অভাব ছিল না’।
Published : 24 Aug 2023, 11:02 PM
গত জুনে রাশিয়ায় ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন থেকেই একটি কথা ঘুরছিল অনেকের মনে, রুশ মার্সেনারি দল ওয়াগনারের প্রধান হয়ত নিজের নামে বিশেষ এক মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে ফেললেন।
যে ব্যক্তি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বহু বছর ধরে, তার জন্য ওই বিদ্রোহ বাড়াবাড়িই হয়ে গিয়েছিল।
বুধবার মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাওয়ার পথে একটি প্রাইভেট জেট বিধ্বস্ত হয়ে ১০ আরোহীর সবার মৃত্যু হয়। আর ওই বিমানের যাত্রী তালিকায় ছিল প্রিগোজিনের নাম।
বিবিসি লিখেছে, প্রিগোজিন যদি সত্যিই ওই ফ্লাইটে থেকে থাকেন, তাহলে তার অস্থির জীবনের অবসান ঘটেছে নিষ্ঠুর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
বছরের পর বছর ধরে চাহিবা মাত্র প্রিগোজিনের সেবা পেয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু তাদের সেই সম্পর্ক টুটে যায় গত জুনে প্রিগোজিনের নেতৃত্বে কয়েক হাজার ওয়াগনার যোদ্ধার বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ওই বিদ্রোহকে বর্ণনা করেন ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে। মস্কোতে প্রিগোজিনের সুদিন যে শেষ হয়ে গেছে, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তখনই।
এ এমন এক ব্যক্তির জীবনের গল্প, যার যৌবনের শুরুর বছরগুলো কেটেছে সেন্ট পিটার্সবার্গের জেলে। সেই তিনিই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ক্যাটারিং ব্যবসায় বিপুল সম্পদের মালিক হন, পৃষ্ঠপোষকতা পান খোদ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছ থেকে।
২০১৪ সালে ভাড়াটে সৈন্যদল ওয়াগনার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন প্রিগোজিন। আফ্রিকা, সিরিয়া ও ইউক্রেইনে ওয়াগনারের ভূমিকা তাকে দেয় নতুন এক সামরিক পরিচয়।
তবে রাশিয়া যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু করল, প্রেসিডেন্ট পুতিনের এক সময়ের ‘শেফ’ প্রিগোজিন বিপুল সম্পদের সঙ্গে ক্ষমতারও অধিকারী হয়ে গেলেন।
আর এই ইউক্রেইনে যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ওয়াগনারের অন্তর্দ্বন্দ্বের শুরু। ইউক্রেইনে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েক মাস ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছিল প্রিগোজিনকে।
এরপর প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধরত সব ভাড়াটে গোষ্ঠীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসতে বললেন, তখন প্রিগোজিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক বাহিনীর অধীনে তার বাহিনী ঢুকে পড়লে, তার প্রভাব যে খর্ব হবে তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
গত জুনের শেষভাগে ৫ হাজার যোদ্ধাসহ সাঁজোয়া যানের বহর নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন ওয়াগনার বস। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তারা মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়।
তবে শেষ পর্যন্ত ঘটনা বেশি দূর গড়ায়নি। ক্রেমলিনের সঙ্গে সমঝোতার পর ওয়াগনারপ্রধান বিদ্রোহে ক্ষান্ত দেন এবং সৈন্যদের ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
গত ২৪ জুন রস্তোভ-অন-ডন শহর হয়ে এম-ফোর মোটরওয়ে ধরে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করে ওয়াগনার বাহিনী।
৬২ বছর বয়সী প্রিগোজিন ওই বিদ্রোহের শাস্তি এড়াতে পেরেছেন বলেই মনে হচ্ছিল এক সময়।
বিদ্রোহের অবসানে বেলারুশের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে প্রিগোজিনের যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতে ওয়াগনারের বিপুল সংখ্যক যোদ্ধাকে বেলারুশের ক্যাম্পে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
ওয়াগনার প্রধান নিজে রাশিয়ার ভেতরে ঘোরাফেরা করার সুযোগ পাচ্ছিলেন। জুলাই মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গে আফ্রিকা-রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের সময় সাধারণ পোশাকে ক্যামেরায় ধরা পড়েছিলেন তিনি।
অবশ্য ভিডিও বার্তায় আবির্ভূত হয়ে প্রিগোজিনের রুশ সামরিক বাহিনী নিয়ে কটাক্ষ করা বন্ধ হয়েছিল। পিটার্সবার্গের বাইরে তার বিলাসবহুল বাড়িতে রুশ নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের দৃশ্যও দেখানো হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ব টেলিভিশনে।
তবে প্রিগোজিন বেলারুশে কোনো গর্তের মধ্যে লুকাতে যাননি। বরং সেই বিদ্রোহের দুই মাসের মাথায় এক নতুন ভিডিও বার্তায় আবির্ভূত হন তিনি।
ওয়াগনার গ্রুপের টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে পোস্ট করা ওই ভিডিওতে প্রিগোজিনকে দেখা যায় যুদ্ধের সাজপোশাকে। তাকে বলতে শোনা যায়, আফ্রিকাকে তারা ‘আরও মুক্ত’ করছেন।
বুধবার তার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ওয়াগনার সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনে দাবি করা হয়, রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনী বুধবার মস্কোর উত্তরে তিভের অঞ্চলে প্রিগোজিনের এমব্রেয়ার-১৩৫ উড়োজাহাজটি গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
বিবিসি লিখেছে, যদি সত্যিই তাই হয়ে থাকে, তাহলে কেউ খুব একটা অবাক হবেন না, কারণ প্রিগোজিনের শত্রুর অভাব ছিল না।
ওয়াগনার বাহিনীর কমান্ডার দিমিত্রি ইউতকিন, যাকে প্রিগোজিনের ডান হাত বলা হয়, তিনিও ছিলেন বিধ্বস্ত ওই বিমানের আরোহীদের মধ্যে।
প্রিগোজিন কেবল ভাগনার গ্রুপ গড়ে তোলেননি, সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি বেনামা অফিসে ক্রেমলিনপন্থি ব্লগারদের নিয়ে তথাকথিত এক ট্রল-ফ্যাক্টরিও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যদিও বহু বছর তিনি সেটা অস্বীকার করে এসেছেন।
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রিগোজিনের ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সির বিরুদ্ধে ‘তথ্যযুদ্ধ’ শুরু করার অভিযোগ এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
এ বছর প্রিগোজিন পুরো বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, পশ্চিমাদের ‘রুশ-বিরোধী প্রচার’ থেকে রাশিয়াকে রক্ষার জন্য ওই উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন।
সোভিয়েত আমলের শেষ দিনগুলোতে ডাকাতি ও প্রতারণার দায়ে প্রায় এক দশক জেলে কাটাতে হয়েছিল প্রিগোজিনকে। এরপর নতুন রাশিয়া যখন তার সোভিয়েত অতীতকে ঝেড়ে ফেলল, মুক্ত প্রিগোজিন শুরু করলেন ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা। শুরুতে হটডগ বিক্রি করলেও পরে সেন্ট পিটার্সবার্গে রেস্তোরাঁ খুলে অভিজাত খাবার পরিবেশন শুরু করেন তিনি।
প্রিগোজিনের এই উত্থান নজরে এসেছিল সেন্ট পিটার্সবার্গের তখনকার ডেপুটি মেয়র ভ্লাদিমির পুতিনের। তিনি যখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট জাক শিরাকের মত রাষ্ট্রনেতাদেরও তিনি প্রিগোজিনের রেস্তেরাঁয় খাইয়েছেন। আর তাতেই ‘পুতিনের ব্যক্তিগত শেফ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান প্রিগোজিন।
বিবিসি লিখেছে, মার্সেনারি ব্যবসা প্রিগোজিনকে সামরিক মর্যাদা আর সম্পদ এনে দিয়েছে, তবে তার কাটারিং ব্যবসা পুরোটা সময় তাকে নিয়মিত অর্থের যোগান দিয়ে গেছে।
ব্যর্থ সেই বিদ্রোহের পরপরই প্রেসিডেন্ট পুতিন জানান, প্রিগোজিনের বাহিনীকে পুরা এক বিলিয়ন ডলার দিয়ে ১২ মাসের জন্য ভাড়া করেছিল রাশিয়া। সেই সঙ্গে প্রিগোজিনের কনকর্ড ক্যাটারিং ফার্মকে আরও এক বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে ওয়াগনার বাহিনীর খাওয়ার খরচ হিসেবে।
পুতিন যে অর্থের কথা বলেছেন, সেটা কেবল এক বছরের জন্য। বিবিসি লিখেছে, ২০১৪ সালে প্রিগোজিনের সঙ্গে চুক্তি করার পর থেকে ওয়াগনার বাহিনীকে ১৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে রাশিয়া সরকার।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি কিসেলিয়ভ বলছেন, ওই মোটা টাকাই প্রিগোজিনকে ‘লাইনচ্যুত’ করে। আর তার বাহিনীর লোকজন যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম করে পার পেয়ে গেছে, সেসব ঘটনাই তার মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করে দেয় যে, সব কিছুতেই হয়ত তার দায়মুক্তি মিলবে।
“সে মনে করতে শুরু করেছিল, সে হয়ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, রাশিয়া, এমনকি খোদ প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।”
রাশিয়ার সেনাবাহিনী গতবছর ইউক্রেইন থেকে পিছু হটে আসার পর প্রিগোজিনের ওয়াগনার যোদ্ধারা ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর বাখমুতের দখল নিতে এক রক্তাক্ত অভিযান চালায়। তখন থেকেই প্রিগোজিনের মনে ওই ধারণা পোক্ত হতে থাকে।
গত সেপ্টেম্বরে প্রিগোজিন রাশিয়ার বিভিন্ন কারাগার পরিদর্শন করেন এবং ওয়াগনারের হয়ে কাজ করার বিনিময়ে বন্দিদের সাজা কমানোর সুযোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেন।
বাখমুতের লড়াইয়ে ওয়াগনার বাহিনীর হাজার হাজার যোদ্ধার প্রাণ যায়, তাদের অনেকেই ছিলেন অনভিজ্ঞ সাবেক বন্দি, যাদের হাতে যথেষ্ট অস্ত্র ছিল না।
ওই যুদ্ধ যখন চরমে পৌঁছেছে, তখন প্রিগোজিন সোশাল মিডিয়ার ভিডিওবার্তায় হাজির হয়ে মৃত মার্সেনারিদের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আরও গোলাবারুদের দাবি তোলেন। প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুগত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
প্রিগোজিন বলেন, “শোইগু! গেরাসিমভ! গোলাবারুদ গেল কোথায়?... এরা এখানে এসে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, অথচ তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে, যাতে মেহেগনি কাঠে সাজানো অফিসে বসে তোমরা আরও মোটা হতে পার।”
তখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচনা এড়িয়ে গিয়ে তার কমান্ডারদের দায়ী করেই বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন প্রিগোজিন।
কিন্তু রাশিয়ার সামরিক কর্মকর্তারা যখন ওয়াগনার বাহিনীকে তাদের কমান্ডের অধীনে নেওয়ার পরিকল্পনা জানাল, প্রিগোজিন তখন আরও ক্ষেপে গেলেন।
ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি হাজার হাজার রুশ সৈন্যের মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে। সেই সঙ্গে নিজের বাহিনী নিয়ে তিনি যাত্রা করলেন মস্কো অভিমুখে, তার ভাষায় যা ছিল ‘সুবিচারের জন্য অভিযাত্রা’।
কিন্তু ক্রেমলিন একে পাগলামি আখ্যা দিয়ে বলল, প্রিগোজিন খোদ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছেন।
শেষ পর্যন্ত প্রিগোজিনের সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়, সেই সঙ্গে সূচনা হয় তার পতনের।