তদন্তকারীরা বলছেন, পুলিশ ধাওয়া দিয়ে গাড়ি থামিয়ে অস্ত্র তাক করলেও চালকের আসনে থাকা নাহেল সেটি ‘উপেক্ষা করছিলেন’।
Published : 02 Jul 2023, 03:24 PM
ফ্রান্সে পুলিশের গুলিতে কিশোর নাহেল এমের মৃত্যুর আগে কী ঘটেছিল সেটিই এখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা, এ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র প্রায় এক সপ্তাহ ধরে উত্তাল দেশটির বিভিন্ন শহর।
বিবিসি জানিয়েছে, নাহেলকে গুলি করা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনার অনুসন্ধানে প্রত্যক্ষদর্শীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুলিশ কর্মকর্তারা গাড়ি থামিয়ে যখন অস্ত্র তাক করেন, সেসময় চালকের আসনে থাকা নাহেল তাদের থামার নির্দেশনা ‘উপেক্ষা করছিলেন’।
গাড়িতে থাকা নাহেলের এক সঙ্গী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে সেই ঘটনা তুলে ধরেন, যে নিজেও একজন কিশোর।
সে জানায়, পুলিশ কর্মকর্তারা গাড়ি থামিয়ে তাদের বন্দুকের বাট দিয়ে নাহেলকে তিনবার আঘাত করেন, যে কারণে গাড়ির ব্রেক থেকে তার পা সরে গিয়েছিল। আর পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছিলেন তাদের নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল নাহেল।
ফরাসি সংবাদমাধ্যমগুলো এই বক্তব্য যাচাই করলেও বিবিসি সেটি যাচাই করতে না পারার কথা জানিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ওই কিশোরের সঙ্গে সোমবার তদন্ত কর্মকর্তারা কথা বলবেন বলে জানা গেছে।
তবে ফ্রান্সকে ভয়াবহ দাঙ্গার মুখে ঠেলে দেওয়া এই ঘটনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিবিসি।
কী বলছেন তদন্ত কর্মকর্তারা
নাহেলকে যেখানে গুলি করা হয়, প্যারিসের শহরতলী সেই নঁতেয়ার এক তদন্ত কর্মকর্তা প্যাসকেল ফাস সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে মোটরসাইকেলে থাকা দুই পুলিশ সদস্য বাসের লেইন ধরে দ্রুত গতিতে ছুঁটতে থাকা একটি মার্সিডিজকে চিহ্নিত করেন যেটিতে পোল্যান্ডের নম্বরপ্লেট লাগানো ছিল।
পুলিশের মোটরসাইকেলটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে পেছনে পেছনে গিয়ে একটি ট্রাফিক সিগন্যালে মার্সিডিজটিকে ধরে ফেলে। মার্সিডিজ গাড়িটির ভেতরে ছিল তিন তরুণ।
চালকের আসনে বসা তরুণকে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দেন ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা, কিন্তু সে ট্রাফিক সিগন্যালের লালবাতি উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। এরপর পুলিশ সদস্যরা ফের মোটরসাইকেল যোগে গাড়িটিকে ধাওয়া করেন এবং ওয়াকিটকির মাধ্যমে বিষয়টি তাদের পুলিশ ইউনিটকে জানান।
এর ১৬ মিনিটের মাথায় গাড়িটি বড় যানজটে আটকে যায়। সেই দুই পুলিশ সদস্য মোটরসাইকেল থেকে নেমে চালকের দিকে অস্ত্র তাক করেন।
এই পুলিশ সদস্যরা তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ফের যাতে ওই চালক গাড়ি না চালান সেজন্যই তারা অস্ত্র তাক করেছিলেন। চালককে তারা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করতে বললেও চালক গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতেই থাকে আর তার মধ্যেই এক কর্মকর্তা গুলি করে বসেন, যেটি ওই তরুণের বুকে লাগে।
চলন্ত গাড়িটি রাস্তার পাশের ব্যারিয়ারে গিয়ে ধাক্কা খায়। সেখান থেকে গাড়ির এক আরোহীকে আটক করা হয় এবং অন্যজন দৌড়ে পালিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
মার্সিডিজ গাড়িটির প্রত্যক্ষদর্শী সেই কিশোর আরোহী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে বলেন, নঁতেয়ায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন তারা তিন বন্ধু। তাদের গাড়িটি বাসের লেইনে ঢুকে পড়লে মোটরসাইকেলে থাকা দুই পুলিশ তাদের তাড়া করেন।
ওই তরুণ এক ভিডিওতে এবং ফরাসি সংবাদমাধ্যম লু প্যারিজিঁওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, গাড়ি থামানোর পরই এক পুলিশ কর্মকর্তা বন্দুকের বাট দিয়ে তাদের চালক বন্ধুকে আঘাত করেন। দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তাও চালককে আঘাত করেন। তারপর তাদের উপর্যপুরি আঘাতে নাহেল ‘খানিকটা হতবাক হয়ে যান’।
প্রত্যক্ষদর্শী ওই তরুণ আরও বলেন, তৃতীয়বার আঘাত করার পর গাড়ির ব্রেক থেকে নাহেলের পা সরে যায় এবং গাড়ি সামনের দিকে এগোতে থাকে। এরপর নাহেলকে গুলি করলে সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার পা সরে গিয়ে গাড়ির এক্সিলারেটরে চাপ দেয়। এর ফলে গাড়ি দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে রাস্তার পাশের ব্যারিয়ারে ধাক্কা খায়।
গাড়ি থেমে গেলে নাহেলের সঙ্গী এই তরুণ পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; কারণ তাকেও গুলি করা হতে পারে এই ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
ভাড়ায় চালিত গাড়ি
তদন্তকারীরা জানান, যে গাড়ি নিয়ে নাহেলসহ তিনজন রাস্তায় বের হয়েছিল সেটি ছিল মার্সিডিজ এ ক্লাস এএমজি গাড়ি, যেটি ভাড়া করা।
এ বিষয়ে বিস্তারিত না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই প্রত্যক্ষদর্শী তরুণ জানান, ‘কেউ’ তাদের সেটি ধার দিয়েছিল।
ফরাসি মোটরিং ওয়েবসাইট অটোপ্লাস বলছে, পোল্যান্ডের নম্বর প্লেটযুক্ত জার্মান স্পোর্টসকারগুলো প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩ হাজার ইউরোতে ভাড়া পাওয়া যায়। অল্প সময়ের জন্য এমন গাড়ি ভাড়া পাওয়ার বিষয়টি ফ্রান্সের যুবকদের কাছে আকর্ষণীয়।
নাহেলের কোনো অপরাধের রেকর্ড ছিল না, কিন্তু পুলিশের কাছে সে পরিচিত ছিল। বলা হচ্ছে, এর আগে সে লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালিয়েছিল এবং আগেও পুলিশের নির্দেশনা অনুযায়ী সড়কে গাড়ি থামায়নি। এছাড়া লাইসেন্স পাওয়ার বয়সও তার হয়নি।
আসছে সেপ্টেম্বরে একটি কিশোর আদালতে হাজির হওয়ার কথা ছিল নাহেলের।
আরও পড়ুন: